বর্ণালী কোলের গল্প
গলন
গতকাল তোমার মৃত্যু হইতে পারিত । অন্তত দুইবার তুমি নির্ঘাত মৃত্যু হইতে রক্ষা পাইয়াছ। দেখিলে মৃত্যুর পূর্ববর্তী মুহূর্ত। ক্যাফেতে বান্ধবীর সহিত বসিয়া তোমার বিলম্ব হইয়াছিল। ট্রেন পাঁচ ঘটিকায়। সাড়ে চারটের সময় তোমরা ঘাট হইতে দূরে। লঞ্চ পার হইলে গেলে তবে স্টেশন। তোমার বান্ধবী সুরঞ্জনা দেউলবাটী নগরীতে আসিতে ও রাস্তা পারাপার করিতে অভ্যস্ত। ও দ্রুত রাস্তা পারাবার করিল।তুমি উহাকে অনুসরণ করিতে গিয়া মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখিলে, বাস ও অটোর চালক যদি না অত সুনিপুণ হইত, গতকাল তোমার মরণ অনিবার্য ছিল। ভালোই হইত। প্রত্যহ বাঁচিবার জন্য এত ক্লেশ সহ্য করিতে হইত না। ঘুমাইয়া যেতে। কল্পনায় তোমার মৃত্যুর পর তুমি হিন্দু হইয়াও কখনও অগ্নি চাও নি। গোরস্থান জন্ম থেকে তোমাকে যতটা আকৃষ্ট করেছে,শ্মশান কখনও নয়। মৃত্যর পর তোমার শেষ কৃত্য সম্পর্কে এই অভিলাষ প্রকাশ করিয়া যাওয়ার বড়ই ইচ্ছে তোমার। সমাধি চেয়েছে কোনও বাগানের মধ্যে। মাটির মধ্যে তোমার কোনওদিন না জাগিবার শরীরখানি থাক। পোকাদের খাবার হইবে। মাটির সঙ্গে মিশিয়া মাটি হইবে। ঝুরঝুরে, নরম । গাছ, লতা, পাতা, গুল্মের খাদ্যরস হইবে। ওদের বাড়িয়া উঠিবার সময় তুমি ঝলমল করিবে। হয়তো বা রৌদ্রোজ্জ্বল পল্লব হইবে , হয়তো বা মুখরিত কুসুম, হয়তো বা লাজুক পাপড়ি । প্রজাপতিরা গান হইবে তোমার জন্য। বঙ্গভূমি আবার রূপসী , আবার সকাল। কল্লোল থামিলে তোমার দীর্ণ একটি একটি অঙ্গ ভূমি ফুঁড়িয়া উঠিয়া আসবে, নির্জন জ্যোৎস্নায় ছমছমে আলোয় তুমি বসিবে সান বাঁধানো গাছের তলায়। তুমি নৈঃশব্দ্য এত পান করিয়াও ক্লান্ত হও নাই। জীবিত অবস্থায় কতবার তুমি চাহিয়াছ রাত্রি- পরিক্রমণ। মৃত্যুর পর তোমার ইচ্ছাপুরণ হইবে। জ্যোৎস্নায় ভাসমান পৃথিবীকে দেখিবে। পুরুষের আক্রমনের ভীতি নাই কোনও। শান্তি পাইবে, শান্তি।
কী ভাবিতেছ, লঞ্চে একা চলিতেছ? সমুখে প্রসারিত জাহ্নবী । দূরে কবিতা। দূরে নগরী। ঢেউয়ের পর ঢেউ। স্মৃতির পর স্মৃতি। স্মৃতির গায়ে প্রহার। বিপন্ন বিস্ময়। আর ঢেউয়ের মধ্যে ওলটপালট খাইতেছে দালির সেই ঘড়ি। মস্তিষ্ক স্থির হইয়া আসিতেছে। নয়ন বিস্ফোরিত। ওই ঘড়ির মধ্যে তোমার হৃদয় দেখিতেছ, কেমন পিষ্ট, দুমড়ে -মুচড়ে যাইতেছে, প্রসারিত হইতেছে, ঘড়ির চক্ষু দিয়া জল গড়াইতেছে, ঢেউ তাহাকে তীরে ফেলিয়া গিয়াছে, একাকী, নিঃসঙ্গ, তবুও উহার চকচকে গাত্র, ভয় পাহিতেছে সকলে ওই ঘড়ির নিকট আসিতে, সময় স্থির হইয়াছে,মানবজগতের সঙ্গে এক অনতিক্রম্য দূরত্বে ওই হৃদয়..ওহার নাম প্রণাম, ওহার নাম বিজয়? রবীন্দ্রনাথের চিত্রের রমণীরা একে একে আসিতেছে ঘড়ির সন্নিকটে..আজ সাররাত্রি নাচ হইবে…“ পাড়া গাঁর মেয়েদের নাচ”..ফুরাইবে আবার এই জীবনের কিছু ভাঁড়ার!