ফয়েজ় পরিক্রমা – ৩
নীলাঞ্জন হাজরা
"আসলে তার আগের সন্ধ্যাতেই এই সত্যটার মুখোমুখি হয়েছিলাম। প্রেমানন্দ ধাম। ক্লাস ফোরের ছেলেদের হস্টেলটার নাম। দোতলা। দুপাশে দুটো চৌকো বাগান রেখে মাঝখানে খিলান করা খোলা পোর্টিকো সোজা একটা লম্বা বারান্দায় উঠেছে। যার পিছনে একটা বড়ো হলঘর, ডান পাশে দুটো ছোটো ঘর। তার একটা ওয়ার্ডেন বলাইদার। আর বাঁ পাশে আরো দুটো ছোটো ঘর। ওপর তলাটা ‘বিজ্ঞানানন্দ’, ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের। প্রেমানন্দের সেই হলঘরে শেষ জানুয়ারির এক কুয়াশাচ্ছন্ন হিম সন্ধ্যায় বাবা আমায় বলাইদার হাতে গচ্ছিত করে চলে যাওয়ার পর থেকে ট্যাংট্যাংট্যাংট্যাং করে ডাইনিং বেল পড়ার পর হইহই করে ডাইনিং হলে খেতে যাওয়া, কাঁপতে কাঁপতে থালা বাসন ধোয়া, ফিরে এসে বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে-গুঁজে, কাঁটায় কাঁটায় রাত ন’টায় লাইট্স অফ পর্যন্ত সময়কালে বুঝে ফেলেছিলাম যে একটা হার্ডল রেসে ‘অন ইওর মার্ক’ হয়ে গেছি। এই হার্ডল রেস-এ আমায় ভাষার হার্ডল টপকাতে হবে। অনেকেই বাংলায় কথা বললেও, অধিকাংশই অবাঙালি — হিন্দিভাষী, মণিপুরী, গুজরাটি, দক্ষিণ ভারতীয়… ভারতের হরেক প্রান্তের ছোটো ছোটো প্রাণ। কাজেই যে সম্মিলিত হৈচৈটা হচ্ছে সেটা বিচিত্র! এমনটা আমি পাইকপাড়ার গ্যাঞ্জাম বা ১৯৭৫-এর আড়ষ্ট-নতুন-বৌ-চুপচাপ কল্যাণীতে মোটেই দেখিনি।" - ফয়েজ পরিক্রমার তৃতীয় পর্ব। নীলাঞ্জন হাজরার কলমে।
প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন – ফয়েজ় পরিক্রমা-১
দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন- ফয়েজ় পরিক্রমা –২
‘হাম কো দিয়া পরদেস?’
(বিশেষ অনুরোধ — এই লেখা লিখছি আবহমান পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণের জন্য। ইন্টারনেট আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একাধারে পড়া দেখা শোনার অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব সুযোগ। সেই ভাবেই এ লেখার বয়ন। তাই সঙ্গের লিঙ্কগুলি অতিরিক্ত মনে করে উপেক্ষা করবেন না)
‘ভোমা-আ-আ-আ, এ ভোমা-আ-আ-আ… গাইয়া ভাগলওয়া রে-এ-এ-এ-এ…’
দূর… কে জানে কোথা থেকে ভেসে আসা এ বাক্যের গুরুত্ব আমার ফয়েজ় পরিক্রমায় অপরিসীম! বাক্যটার বিষয়বস্তুর নয়, ভাষার। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে ঘুম থেকে ওঠার প্রথম বেল পড়ত ভোর পৌনে পাঁচটায়। তারপর থেকে প্রত্যেক পনেরো মিনিট অন্তর একটা করে তিনটে বেল। ছটায় মন্দিরে প্রার্থনা। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারির সেই প্রবল শীতের প্রথম ভোর-রাতে কিন্তু বেল পড়ার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল দূর থেকে ভেসে আসা এই চেঁচানিতে। আজও শুনতে পাই পরিষ্কার। কোথায় আছি, কেন আছি ঠাওর হওয়ার আগেই যা ইন্দ্রিয়কে প্রথম স্পর্শ করল তা হলো, আমি বাংলা ভাষার মাতৃক্রোড়ে আর নেই!
সেটা একটা তীব্র অনুভূতি। কারণ মাতৃভাষা সেই কোল, বুক-হিম-করা ভীষণ বিপদের মুহূর্তে, যখন মনে হয় জীবনটাই ভয়ঙ্কর বিপণন, আমরা নিজের অজান্তেই, সহজাত প্রবৃত্তির বশে তার মধ্যে কুঁকড়ে যাই — হয়তো প্রার্থনায়, হয়তো গালাগালিতে, হয়তো দিশেহারা ভয়ের উচ্চারণে। পাবলো নেরুদার সেই অতল কবিতার সেই সব পংক্তি:
‘‘…and there I was, a foreigner, in the solitudes of the jungle,
there, marooned in that truck stranded in night,
twenty years old, waiting for death, shrinking into my language.’’
(The Watersong Ends. Pablo Neruda. The Poetry of Pablo Neruda (p. 767). Farrar, Straus and Giroux. Kindle Edition.)
সেই যে ‘my language’, আসলে আমার মায়ের ভাষা, বিপদে-বিপন্নতায়-একাকিত্বে আমরা, মানুষ মাত্রেই, যার মধ্যে ‘shrink’ করে যেতে পারি, আমরা বুঝতেও পারি না সাধারণ পরিস্থিতে তা কীভাবে আমাদের ঘিরে থাকে। যাঁরা নিজের ‘দেশে’-ই — নিজের ভাষার দেশেই — বড়ো হয়ে উঠেছে, শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছে, তাদের পক্ষে এ অনুভূতিটা বোঝা একটু মুশকিল। সে জন্য ‘ভিন্দেশী’ হওয়া দরকার। ‘পরদেস’। পরবাস।
পাবলো নেরুদা ও ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়
আসলে তার আগের সন্ধ্যাতেই এই সত্যটার মুখোমুখি হয়েছিলাম। প্রেমানন্দ ধাম। ক্লাস ফোরের ছেলেদের হস্টেলটার নাম। দোতলা। দুপাশে দুটো চৌকো বাগান রেখে মাঝখানে খিলান করা খোলা পোর্টিকো সোজা একটা লম্বা বারান্দায় উঠেছে। যার পিছনে একটা বড়ো হলঘর, ডান পাশে দুটো ছোটো ঘর। তার একটা ওয়ার্ডেন বলাইদার। আর বাঁ পাশে আরো দুটো ছোটো ঘর। ওপর তলাটা ‘বিজ্ঞানানন্দ’, ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের। প্রেমানন্দের সেই হলঘরে শেষ জানুয়ারির এক কুয়াশাচ্ছন্ন হিম সন্ধ্যায় বাবা আমায় বলাইদার হাতে গচ্ছিত করে চলে যাওয়ার পর থেকে ট্যাংট্যাংট্যাংট্যাং করে ডাইনিং বেল পড়ার পর হইহই করে ডাইনিং হলে খেতে যাওয়া, কাঁপতে কাঁপতে থালা বাসন ধোয়া, ফিরে এসে বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে-গুঁজে, কাঁটায় কাঁটায় রাত ন’টায় লাইট্স অফ পর্যন্ত সময়কালে বুঝে ফেলেছিলাম যে একটা হার্ডল রেসে ‘অন ইওর মার্ক’ হয়ে গেছি। এই হার্ডল রেস-এ আমায় ভাষার হার্ডল টপকাতে হবে। অনেকেই বাংলায় কথা বললেও, অধিকাংশই অবাঙালি — হিন্দিভাষী, মণিপুরী, গুজরাটি, দক্ষিণ ভারতীয়… ভারতের হরেক প্রান্তের ছোটো ছোটো প্রাণ। কাজেই যে সম্মিলিত হৈচৈটা হচ্ছে সেটা বিচিত্র! এমনটা আমি পাইকপাড়ার গ্যাঞ্জাম বা ১৯৭৫-এর আড়ষ্ট-নতুন-বৌ-চুপচাপ কল্যাণীতে মোটেই দেখিনি।
এই হৈচৈতে আমাকে মিশে যেতেই হবে, নইলেই মুশকিল — বাড়ির মায়া, হোমসিকনেস্, এক বিশ্রী অসুখ। কুরে কুরে খায়, অকারণ। চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষের ভুলতে-না-পারা চুমুর মতো। আসলে আমি দেওঘরে এসেছিলাম সেশন শুরু হওয়ার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে, ঠিক কী কারণে আমার মনে নেই। ততদিনে ঘর ছেড়ে আসা হৃদয়গুলো মিলেমিশে, সব মনখারাপকে পরাস্ত করে, বেশ একটা আনন্দের লপসি তৈরি করে ফেলেছে। আমাকে তাতে মিশে যেতেই হবে, কোনও বিকল্প নেই। সেইটা করতে গিয়ে দেখলাম সব্বোনাশ, এ ক’ বছরে ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ আমার ঠোঁটে যে অদ্ভুত স্বাদের লিপস্টিক ঘষে ছিল, এখানে সেটা অচল — এখানে বরং সরু সরু গলায় সবাই হিন্দি বলছে — ভাঙাচোরা, দন্ত-স কে তালব্য-শ বলে, ‘ছুটি’-কে ‘ছুটা’ বলে, আবার অনেকেই এক্কেবারে গড়গড় করে, কারণ সেটা তাদের মাতৃভাষা, যদিও তার মধ্যেও আছে চলনের বিস্তর তফাত। মোদ্দা, এ ভাষাটা আমি এক্কেবারে জানি না। অথৈ জলে।
ঠিক, ঠিক এই রকমই ছিল সেই আনন্দঘন লপসি (শুধু আমাদের কালে সিলিং বা অন্য কোনও পাখা ছিল না) https://www.youtube.com/watch?v=yXOiDWvFpZI&list=PLIPLOlDorGzNiABOWgYI52bbAfE4PxmGK&index=9&t=0s
এই উপলব্ধি আগের সন্ধ্যায় হলেও, বাঙালি সহপাঠীদের সঙ্গে বাঙলাতেই সময় কেটে গেল। তারপর নিশ্চিন্ত, নিরপরাধ ঘুম। বিষ্ণুপুর-হাওড়া-জসিডি-দেওঘরের দীর্ঘ একবেলার যাত্রায় ক্লান্ত শরীরে। আর তা ভাঙল সক্কাল সক্কাল দলছুট গরুর ভারি মুশকিলে পড়া কোনও বাগালের ওই দূরাগত তারস্বর সোজা বুকে এসে বিঁধে। সেই প্রথম আমার মনের মধ্যে এই সত্যটা আধলা ইটের মতো ডুবল যে আমি মাতৃভাষার কোলের বাইরে ‘marooned’।
আর সেই মুহূর্তেই একটা দুনিয়ার দরজা খুলে গেল। অথৈ জলে সাঁতার শেখা শুরু হলো। কুঁদির মুখে দ থাকে না। বাধ্য হয়ে বলতে বলতে শেখার মতো নতুন ভাষা শেখার ভালো উপায় আর হয় না। তাতে শব্দের আভিধানিক অর্থের বাইরে তার নানা দ্যোতনা, আর ভাষার চলনটা শিখে ফেলা যায়। তবে খুব সুবিধে হল দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিও থাকায়। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি— ক্লাসে তিনটেই পড়তে হতো আমাদের। ইংরেজি পড়াতেন বৃদ্ধ আইরিশ শঙ্ভু মহারাজ, যাঁর ছিল ঝলমলে একটা গোলাপ বাগান, আর মিশনে সদ্য যোগ দেওয়া অতি মৃদুভাষী ব্রহ্মচারী অ্যামেরিকান ব্রাদার জ্যোতি, যাঁর সোনালি শিখাটি ছিল হবহু একটি কাঁকড়া বিছের মতো। বাংলা— শ্রীনিবাস-দা, যাঁর নাটকীয় ‘রাজসিংহ’ পাঠ আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। হিন্দি মাস্টারমশাই দশরথ-জি-র নানা কাণ্ডকারখানার কথা মনে পড়লে আজও হেসে কুটিপাটি হই। আর ছিল একটা দুরন্ত লাইব্রেরি, যাতে এই তিন ভাষার বইপত্তর, পত্রপত্রিকার কোনও কমতি ছিল না। লাইব্রেরি পিরিয়ড বলে একটা পিরিয়ডই ছিল, যখন সব্বাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে লাইব্রেরিত কাটাতেই হতো। রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে আমার ঋণের কোনও শেষ নেই। অচিরেই হিন্দি আমার মজ্জায় প্রবেশ করতে শুরু করল।
(এ কাহিনির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, কেবল আগ্রহীদের জন্য দিলাম) এ ভিডিওটি দেওঘর বিদ্যাপীঠের কোনও প্রাক্তন ছাত্রের। আমাদের সময়ে এত সবুজ ছিল না ক্যাম্পাস, আর ছিলনা খরগোশের ঘরদুটো। মন্দিরের প্রধান সিঁড়িটা তখন সবে তৈরি হচ্ছে — https://www.youtube.com/watch?v=cKMZZzOBss4&feature=emb_rel_end
কাজেই সেই গ্রীষ্মে আমার প্রাচীন শহরে ছুটিতে এসে যখন পাকিস্তানের কবি ও গায়কের গান ‘গুলোঁ মে রঙ্গ্ ভরে’ আমার ধমনীতে আগুন ধরাল, উর্দু ভাষা না জানা সত্ত্বেও, হেলেন কেলারের আঙুলে রবীন্দ্রনাথের ঠোঁটের স্পর্শের মতো আমি গজ়লটার কথাগুলোকে আধো আধো স্পর্শ করতে পারছিলাম।
রবীন্দ্রনাথ ও হেলেন কেলার
হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয় ঘটছিল একটা নতুন কিছুর সঙ্গে। অক্ষর-বাপ ফারসির নাসতালিক হলেও, হিন্দি হলো উর্দুর মা। উর্দুর বিপুল সংখ্যক শব্দই শুধু নয়, তার ব্যাকরণের কাঠামোটাই হিন্দির।
তগজ়্জ়ুল যা কিনা ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের কবিতার প্রাণভ্রমর, তা বুঝতে গেলে যেমন গজ়ল ব্যাপারটা জানতেই হবে, তেমনই গজ়ল জানতে গেলে উর্দু ভাষার ইতিহাসও খানিকটা জানা দরকার বইকি।
আর ওমনি পৌঁছে যাব আমরা এক পরমাশ্চর্য কবি-সুরকার-ইতিহাসকার-ভাষাবিদ-বাদ্যযন্ত্রের আবিস্কর্তা-ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের অন্যতম দিশারী-আভিধানিক-এবং সুফি দার্শনিকের দরজায়। আবু’ল হাসান ইয়ামিন উদ্দিন খুসরো। ওরফে আমির খুসরো দেহলভি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা জানাচ্ছে, ইনিই সেই নবীন ‘মিশ্র ভাষা’-র প্রথম প্রধান রচয়িতা, যে ভাষার পরিচয় অনেক নামে — হিন্দওয়ি (हिन्दवी), জ়বান-এ-হিন্দ, হিন্দি, জ়বান-এ-দিল্লি, রেখতা, গুজরি, দক্কনি, জ়বান-এ-উর্দু-এ-মুঅল্লা, জ়বান-এ-উর্দু, কিংবা স্রেফ উর্দু। সেটা ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। খুসরোর জীবনকাল ১২৫৩ থেকে ১৩২৫।
দুই ছাত্রের মাঝখানে আমির খুসরো। ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের গোড়ায় তৈরি মজলিস অল-উস্শাক নামের পাণ্ডুলিপি থেকে
আমরা গাইতে লাগলাম এ রকম গান — https://www.youtube.com/watch?v=1kXqEPPwqUs
‘গুলোঁমে রঙ্গ্ ভরে’ গজ়ল যদি সাত দশক পার করে নতুন সাজে এখনও প্রাণবন্ত থাকে, আশ্চর্য এই গান সাতশো বছর পার করেও উত্তর-মধ্য-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কনের চোখের জলে আজও ঝলমলে। এ গান ছাড়া বিয়ে সম্পূর্ণ হতেই পারবে না বহু গ্রামে গ্রামান্তরে। সামান্য পাঠভেদে বিপুল এলাকা জুড়ে প্রচলিত এ গানের কথা, লিরিক্স, পড়লে চমকে উঠতে হয়। ইদানীং কালে নুসরত ফতে আলি, ফরিদ আয়াজ়, সবরি ব্রাদার্স, জগজিৎ কওর সহ বহু ডাকসাইটে গায়ক বারবার এ গান গেয়েছেন। কিন্তু (মাথা-গরম-করা দুটো বিজ্ঞাপন বিরতি সত্বেও, ‘skip ad’ করার সুযোগ আছে অবশ্য) তুলনামূলক ভাবে অখ্যাত নবীন কাওয়াল রইস মিয়াঁ-র কোনও কারিকুরি ছাড়া, কালোয়াতিহীন চলনে, খোলা গলাই সব থেকে ভালো লেগেছে আমার। ফরিদ আয়াজ় দুম করে গানটার শুরুতে মির্জা গালিবের একেবারে অপ্রাসঙ্গিক একটা শে’র আর মাঝখানে কী সব হাবিজাবি কিছু লাইন ঢুকিয়ে গানটির দফা রফা করে ছেড়েছেন, অন্তত আমি যে রূপে সেটা শুনেছি তাঁর গলায়। রইস মিয়াঁ ছাড়াও দিলাম আর একটা লিঙ্ক —
বিখ্যাত লোকসঙ্গীত গায়িকা মালিনী অবস্তির গলায় — https://www.youtube.com/watch?v=VynaAjXAZTs
এ গানের এখানে যে তরজমা দিলাম তা রয়িস মিয়াঁ-র গাওয়া গানের কথারই অনুসারী, দু-একটি শব্দ আর দুটি পঙ্ক্তি বাদে —
কেন বিদেশে বিয়ে দিলে আমার?
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
আমি যে, বাবা, তোমার খাঁচার পাখি
ভোর হলে উড়ে যাব,
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
আমি যে, বাবা, তোমার খোঁটে বাঁধা গাই
যেখানে তাড়াবে চলে যাব,
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
ভাইদের দিলে, বাবা, দুই মহলা পুরী
আমায় দিলে পরবাস?
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
একটা চিরুনিও যে দাওনি সঙ্গে বাবা
শাশুড়ি ননদের কতো কথা
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
ফেলে এলাম তাক ভরা পুতুলের মেলা
হারাল খেলার সাথি,
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
আমি যে, বাবা, তোমার বাগানে চারা
লোকে নিয়ে যায় নিজঘরে,
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
পর্দা সরিয়ে পাল্কির, সহসা দেখি
পৌঁছে গেছি অন্য কারও দেশে
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
আমির খুসরো, আজ এমনই বলে বাবা —
বেঁচে থাকে যেন সিঁথির সিঁদুর তোর,
ও আমার লক্ষপতি বাবা।।
কন্যকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে ভাইদের সব সম্পত্তি দেওয়া চোখে পড়ে। তার থেকেও বেশি চোখে পড়ে ‘তাক ভরা পুতুল’ ফেলে চলে যেতে হওয়ার হাহাকার — অমোঘ ইঙ্গিত— এ বিয়ে সহেলিদের সাথে হৈহৈ করে পুতুলখেলা নাবালিকার। কিন্তু আমার কাছে এ গানের আসল মোচড় — যা হৃদয় বিদীর্ণ করে যায়, তা হলো শেষের পঙ্ক্তি ক’টা। বিয়ে হওয়া মাত্র বাপ-মেয়ের সম্পর্কটাই কেমন বদলে গেল। মাঝখানে ঢুকে পড়ল ‘সুহাগ’। সুহাগ শব্দের অর্থ ‘সধবা থাকা অবস্থা’। কোলে-পিঠে বড়ো করা মেয়েটির অস্তিত্বের, পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেল তাঁর স্বামী, এমনকী বাবার কাছেও! এ কী ভীষণ অনতিক্রম্য প্রাচীর, সে এখন ‘বাবুল মোরা’-র বিটিয়া নয়, স্বামীর পরিচয়ে তার পরিচয় — তরুণীটির দিশেহারা হাহাকার। ‘সুহাগ’ ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দ। সিঁথির সিঁদুর তা নয়। তবুও অনেক অনেক ভেবে তরজমায় সিঁথির সিঁদুরই করতে ইচ্ছে হলো।
ভয়াবহ কথা এই যে, আজ আমরা এমনই এক কঠিন দিনের কিনারে, যখন একদল সুসংগঠিত, রক্তপিপাসু, আপাদমস্তক ধান্দাবাজ, বিপুল অর্থবলে বলীয়ান ফাশিস্ত আজ দেশটাকেই বদলে দিতে চাইছে। তাদের সঙ্গে এই উপমহাদেশের কোনও নাড়ির যোগ নেই। যে গুরুদের তত্ত্বের তারা অনুসারী বলে দাবি করে, সেই গুরুকুল ভারতীয় নয়, খোলাখুলি ভাবে মদমত্ত অ্যাডল্ফ হিটলারের খুনি বিদ্বেষবিষে ভরা ইওরোপীয় তালিম-শিবিরের পরম্পরায় বিশ্বাসী। বিপদ এখানেই যে এই ফাশিস্তগুলো চিৎকার করছে — মুসলমানরা বহিরাগত, আগমার্কা ভারতীয় নয়, একাদশ-দ্বাদশ শতকে মুসলমানরা আসা ইস্তক নাকি এ দেশ পরাধীন। আর অযুত সমস্যায়, রাজনৈতিক-সামাজিক বঞ্চনায় জর্জরিত, মূল ধারার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসঘাতকতায় পর্যূদস্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ তাতেই তাল দিয়ে ভাবছেন এরাই দিতে পারে সব সমস্যার যাদু-সমাধান। মুনাফাতাড়িত গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যম মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে গভীর মুসলমান আমির খুসরোর এই গানের ইতিহাস, সেই খুসরো যিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছিলেন একটিই বিশেষণে — ‘তোতি-এ-হিন্দম’, আমি হিন্দের তোতা। ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাঁর মধ্যেও ছিল না, এ কথা বললে অনৃত ভাষণ হবে। জীবনচর্যায় দ্বিখণ্ডিত এই মানুষটির সংকট নিয়ে অন্যত্র বিশদে আলোচনা করেছি। এখানে শুধু এটুকুই যে, সেই সংকীর্ণতা বাহ্য। সে সব লেখা টেকেওনি। কেউ মনে রাখে না। কিন্তু তা ছাপিয়ে, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত এই সব গোত্রের গান, কবিতা, দোহা। এই উপমহাদেশের হাজার উত্থান পতন, ঘোড়ার খুরের ধুলোর ঝড়, তলোয়ারের ঝংকার, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ সাতশো বছরেও এই গান মুছে দিতে পারেনি। ইওরোপীয় খুনে দর্শনের অনুসারী এই পিদ্দি ফাশিস্তগুলোও পারবে না। হয়তো অনেক রক্তপাত হবে। আরও একবার।
এখানে অবিশ্যি তথ্যনিষ্ঠ থাকার প্রয়োজনেই বলে রাখতে হবে যে, এ প্রশ্ন উঠেছে, পণ্ডিতি মহল থেকেই উঠেছে, আমির খুসরো কি আদৌ লিখেছিলেন ওপরের ওই গান কিংবা নীচের এমন গান? —
সকল বন ফুল রহি সর্সোঁ, আমওয়া বোরে, টেসু ফুলে
কোয়েল বোলে ডার ডার অওর গোরি করত সিঙ্গার
মলনিয়া গড়োয়া লে আয়ে কর্সোঁ, সকল বন ফুল রহি
তরহ্ তরহ্ কে ফুল লে খিলায়ে, লে গড়োয়া হাথনমে আয়ে
নিজামুদ্দিন কে দরওয়াজে পে আবন কে গয়ে আশ্ক-রঙ্গ
অওর বীত গয়ে বর্সোঁ, সকল বন ফুল রহি
(পলাশে পলাশ, আমের মুকুলে ভরা চারিপাশ, সর্ষের ফুলে
কুহু-কুহু ক’রে কোকিলেরা ফেরে রূপসী মগন রূপশৃঙ্গারে
এসে গেছে মালি, সাথে ভরা ডালি, ফুলে ফুল চারি ধারে
প্রেম-রাঙা তার কথা আসবার নিজ়ামুদ্দিন পীরের দুয়ারে
আসেনি যদিও কতো যুগ ধরে, ফুলে ফুল চারিধারে)
এ প্রশ্নের সুনিশ্চিত উত্তর দিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট আভিধানিক এবং যাঁকে বলা যেতেই পারে উর্দু সাহিত্যের এ সময়ের সব থেকে শ্রদ্ধেয় গবেষক, গোপী চন্দ নারঙ্গ। সেই দীর্ঘ বিতর্কে না ঢুকে শুধু এটুকু যে, অধ্যাপক নারঙ্গ ১৯৭৪ সালে একটি বইয়ের ভূমিকার এই শিরোনাম দিয়েছিলেন — ‘আমির খুসরো কা হিন্দওয়ি কাব্য: প্রামাণিকতা কী সমস্যা’। কারণ এই যে, দেশের বিপুল অঞ্চল জুড়ে লোকমুখে খুসরোর নামে চলা এত গীত, এত দোহা, এত কাওয়ালি, এত ধাঁধা (পহেলি) এ সবের যে একটিও হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি নেই, সম্পূর্ণটাই ‘ওরাল লিটারেচার’। একটা কিছু অন্তত না পাওয়া গেলে, কঠোর পণ্ডিতেরা যে কিছুতেই মানতে নারাজ। শুরু হল অধ্যাপক নারঙ্গের খোঁজ? সে যেন সেরা হলিউড থ্রিলার। ‘দারুণ কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় এই যে,’ লিখছেন নারঙ্গ, ‘অবধ রাজ্যের পতন এবং ১৮৫৭-র বিদ্রোহের ব্যর্থতার পরে এই সব হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির কপি কোথায় গেল? সব থেকে বেশি বিপর্যয় ঘটেছিল দিল্লি আর লখনও-তে — সেখানের সোনা-রুপো, হিরে-জওহর, মালপত্র এবং অন্যান্য বহুমূল্য সামগ্রীর পাশাপাশি দুর্লভ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পত্তিও ঈশ্বর জানেন কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়েএ গেল।… ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, প্যারিসের বিবিলিওথেক নাসিওনাল এবং ইওরোপের অন্যান্য অনেক সংগ্রহালয়ে শোভা বর্ধন করতে চলে গেল।’ (আমির খুসরো কা হিন্দওয়ি কাব্য। গোপী চন্দ নারঙ্গ। বাণী প্রকাশন। ২০১৩।)
খোঁজ জারি রইল। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে মিলে গেল একটা একটা লেখা — বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে এ. স্প্রেঙ্গার নামে নামেক এক পেশাদার এম.ডি. চিকিৎসকের তৈরি একটা ক্যাটালগ — A Catalogue of the Arabic, Persian and Hindustany Manuscripts of the Libraries of the King of Oudh, compiled by the orders of the Govt. of India, Vol I, containing Persian and Hindustany Poetry, Calcutta Baptist Mission Press, 1854. ‘এই পুস্তকসূচীতে আমির খুসরোর উল্লেখ এক জায়গায় নয় তিন তিন স্থানে রয়েছে।’। এই প্রথম ক্লু কে হাতিয়ার করে কলকাতা, পাটনার খুদা বক্শ ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি (এই গ্রন্থাগারের যে সব আনাচ কানাচে সাধারণের প্রবেশ নিশেধ সেখানেও ঘুরে ঘুরে একটা বেলা কাটানোর রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, যদি তা নাও হয়, তথাপি একবার ঘুরে আসুন, গায়ে কাঁটা দেবে!), লন্ডন, প্যারিস, হাইডেলবার্গ, ট্যুবিঙ্গেন, স্টুটগার্ট, কাস্সেল, মারবুর্গ, হামবুর্গ তলাশ করতে করতে বের্লিনের স্টাট্সবিবলিয়োথেক-এ মিলে গেল সেই বিবর্ণ ভঙ্গুর দুর্লভ সাত-রাজার-ধন — হিন্দওয়ি-তে লেখা খুসরোর অনেক ধাঁধার হাতে লেখা প্রামাণ্য প্রতিলিপি, ‘নস্খ্’ অক্ষরে লেখা।
বার্লিন পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা (সূত্র আমির খুসরো-কা হিন্দওয়ি কাব্য)
শেষমেশ অধ্যাপক নারঙ্গের স্পষ্ট কথা, ‘এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আমির খুসরোর জনপ্রিয়তার ফলেই হিন্দওয়ি কাব্য কিছু কিছু নিশ্চয়ই বদলে গিয়েছে… সেই সমস্ত হিন্দওয়ি ভাণ্ডার, যা শতশত বছর ধরে পরম্পরাগত রূপে আমির খুসরোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে যদি সামগ্রিকরূপে স্বীকার নাও করা যায়, কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তার পুরোটাই বাতিল করে দেওয়াও ন্যায়সঙ্গত নয়।’ (আমির খুসরো কা হিন্দওয়ি কাব্য। পৃ ৫২)। আমি বিগত অন্তত ২০ বছর ধরে নানা অঞ্চলে ‘কাহেকো বিয়াহি বিদেস’ শুনে আসছি, কখনও শুনিনি এ গানের রচয়িতা অন্য কেউ।
আসল কথা হলো, খুসরো যেমন চোস্ত্ ফারসিতে অনেক কিছু লিখছিলেন, তেমনই, লিখছিলেন একেবারে খাঁটি ভারতীয় সাধারণ মানুষের মুখের এই মিশ্র ভাষায়, অধ্যাপক নারঙ্গের মতে ‘দেহলওয়ি হিন্দি’-তে, আরও অনেক কিছু। যে ভাষা দারুণ জনপ্রিয় না হলে, দিকে দিকে ছড়িয়ে না পড়লে আমরা আজকের উর্দু ভাষায় পৌঁছতাম না। এইখানে এও মনে রাখতে হবে, ভারতীয় ফাশিস্তরা এক ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে এই ধরনের হরেক চলনের ভাষার ওপরেও। হিন্দি বলে চালান হচ্ছে সেই ‘শুদ্ধ্ শাকাহারী’ হিন্দি, যে হিন্দি আমরা শুনেছি অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবানি, গোবিন্দাচার্য প্রমুখ বাঘা বাঘা আরএসএস প্রচারকদের মুখে, তেমন জোর-করে-সংস্কৃত-শব্দ-গুঁজে-দেওয়া সংস্কৃত-পণ্ডিতি উচ্চারণের বিচিত্র হিন্দি ভারতের কোনও অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কদাচ বলে না। বিহার, উত্তর প্রদেশের গঙ্গা-কিনারের হিন্দিভাষীরা বলে না। সোন-কিনার ভোজপুরের হিন্দিভাষীরা না। গুমতি-কিনার অবধের হিন্দিভাষীরা না। মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থানের চম্বেলা গাওঁ-র হিন্দিভাষীরা না। যমুনা-কিনার দিল্লির হিন্দিভাষীরা না। ছোটানাগপুরী, সিংভূমী… কেউ না। বরং নিজেকে ‘দেহলওয়ি’ — দিল্লিবাসী — বলতেই ভালোবাসা খুসরো তাঁর বহু রচনায় যে ‘হিন্দওয়ি’ ব্যবহার করছিলেন, যমুনা-কিনারের সেই ভাষাকেই বলা যেতে পারে উর্দু ভাষার মা। আর ‘ম্যায় তো বাবুল তোরে খুঁটেকি গাইয়া / হাঁকো জিধর হাঁক যায়ে’-র থেকে এ সব শোনা-পড়া-জানা-বোঝার অনেক অনেক আগে দ্রুত আমার রক্তে মিশে যাওয়া সেই রাতভোরের চেঁচামেচির ‘গাইয়া ভাগলওয়ারে’ ভাষার দূরত্ব অনেক বলে আমার মনে হয়নি!! যে উর্দু ভাষাতে ফয়েজ়ের কবিতা লেখা, তা অনেক ভিন্ন নিশ্চয়ই, কিন্তু নিজের অজান্তেই তার দিকে সেই আমার প্রথম কদম।
(ক্রমশ)
নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধ না হলে কোনও কবির সঠিক পাঠ সম্ভব নয়। এই লেখাগুলো না পড়লে এই কথাটা এত হাড়েহাড়ে টের পেতাম না।
ফ্যাসিবাদীদের বিকৃত ইতিহাসচর্চাকে মোকাবিলা করতে হলে এ দেশের এই সাহিত্য-শিল্পের পরম্পরাটি জানাও যে কতখানি জরুরি তাও এত গভীরভাবে মনে হত না।