আমেরিকার সাহিত্য ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সলোমন। যদিও অনেকদিন পর্যন্ত এই ঘটনার ওপর বেশিরভাগ গবেষক এবং ছাত্রদের দৃষ্টি পড়েনি। সলোমনই প্রথম হিস্প্যানিক কবি, যিনি ইংরেজি ভাষায় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেই হিসাবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ট্রপিকাল টাউন এন্ড আদার পোয়েমস' বা 'গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর ও অন্যান্য কবিতা' ইতিহাস রচনা করেছিল। এই বইয়ের কবিতা যে শুধুমাত্র আমেরিকান পাঠকদের উদ্বুদ্ধ এবং আলোড়িত করেছিল তাই নয়, একই সঙ্গে বলেছিল হিস্প্যানিক-আমেরিকান পাঠকদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথাও । 'গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর ও অন্যান্য কবিতা' যেন আমেরিকা মহাদেশের স্প্যানিশ ও ইংরেজিভাষী মানুষদের মাঝখানে শব্দে শব্দ জোড়া একটি সেতু। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে পোয়েট্রি ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত হয় সলোমন ডে লা সেলভার জনপ্রিয় কবিতা 'আমার নিকারাগুয়া'। একইসঙ্গে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও দুটি ছোট কবিতা , যাদের একটির নাম 'দ্য টাইনি মেইডেন' এবং অন্যটির নাম 'দ্য মার্চেন্ট'। সে সময় পোয়েট্রির সম্পাদক ছিলেন হ্যারিয়েট মনরো। 'আমার নিকারাগুয়া' কবিতায় সলোমন যেভাবে নিজের দেশের কথা, মানুষের কথা, ঘরবাড়ির কথা বলেছেন, কবিতাটি পড়লে মনে হয়- পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের যাপন কোন এক অদৃশ্য সুতোয় জোড়া আছে। 'গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর এবং অন্যান্য কবিতা' ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে এই কাব্যগ্রন্থের ১৯ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এখন এই মুহূর্তেও কেউ না কেউ তাঁকে পড়ছেন।
রুবেন দারিওর প্রায় সমসাময়িক কবি সলোমন ডে লা সেলভা। তাঁর জন্ম ১৮৯৩ সালের ২০ মার্চ নিকারাগুয়ার লিওন শহরে। সলোমনের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, সেই সময় নিকারাগুয়ার তৎকালীন শাসক জোস স্যান্টোস জেলায়ার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাঁর বাবাকে বন্দী করা হয়। শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট জেলায়া লিওন সফরে এলে বালক সলোমন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। প্রেসিডেন্ট জেলায়া সলোমনের বক্তৃতায় হয়ে তাকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলেজে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন। ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজে ভর্তি হন সলোমন।
১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ তাঁর সঙ্গে কবি রুবেন দারিওর আলাপ হয়। এরপর সলোমন নিউইয়র্কের সাহিত্য বৃত্তে ক্রমশ হয়ে ওঠেন একটি পরিচিত মুখ। ১৯১৮ সালে তাঁর ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর ও অন্যান্য কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন সলোমন। তাঁর বেশকিছু কবিতায় সৈনিক জীবনের ছায়া পড়েছিল। সেসব কবিতা নিয়ে ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘এল সোলডাডে ডেসোনোসিডো’ বা ‘অচেনা সৈনিক’।এরপর তিনি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই নিকারাগুয়ার শ্রমিক সংঘ শেষ পর্যন্ত প্যান আমেরিকান ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল তথা আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবারের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৫ সাল নাগাদ সলোমান পাকাপাকিভাবে মেক্সিকোয় বসবাস শুরু করেন। মেক্সিকোর তৎকালীন রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তিনি প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল অ্যালেমান ভ্যালডেসের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। শেষ জীবনে তিনি ফ্রান্সে নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সৈন্য গান গায়’ (১৯১৯), ‘খ্যাতনামা পরিবার’ (১৯৫৪), ‘মেক্সিকোর স্বাধীনতা অধ্যায়’ (১৯৫৫) এবং ‘পিন্ডারের আহ্বান’ (১৯৫৭)।
আমেরিকার সাহিত্য ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সলোমন। যদিও অনেকদিন পর্যন্ত এই ঘটনার ওপর বেশিরভাগ গবেষক এবং ছাত্রদের দৃষ্টি পড়েনি। সলোমনই প্রথম হিস্প্যানিক কবি, যিনি ইংরেজি ভাষায় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেই হিসাবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ট্রপিকাল টাউন এন্ড আদার পোয়েমস’ বা ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর ও অন্যান্য কবিতা’ ইতিহাস রচনা করেছিল। এই বইয়ের কবিতা যে শুধুমাত্র আমেরিকান পাঠকদের উদ্বুদ্ধ এবং আলোড়িত করেছিল তাই নয়, একই সঙ্গে বলেছিল হিস্প্যানিক-আমেরিকান পাঠকদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথাও । ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর ও অন্যান্য কবিতা’ যেন আমেরিকা মহাদেশের স্প্যানিশ ও ইংরেজিভাষী মানুষদের মাঝখানে শব্দে শব্দ জোড়া একটি সেতু। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে পোয়েট্রি ম্যাগাজিন এ প্রকাশিত হয় সলোমন ডে লা সেলভার জনপ্রিয় কবিতা ‘আমার নিকারাগুয়া’। একইসঙ্গে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও দুটি ছোট কবিতা , যাদের একটির নাম ‘দ্য টাইনি মেইডেন’ এবং অন্যটির নাম ‘দ্য মার্চেন্ট’। সে সময় পোয়েট্রির সম্পাদক ছিলেন হ্যারিয়েট মনরো। ‘আমার নিকারাগুয়া’ কবিতায় সলোমন যেভাবে নিজের দেশের কথা, মানুষের কথা, ঘরবাড়ির কথা বলেছেন, কবিতাটি পড়লে মনে হয়- পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের যাপন কোন এক অদৃশ্য সুতোয় জোড়া আছে। ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহর এবং অন্যান্য কবিতা’ ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে এই কাব্যগ্রন্থের ১৯ তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এখন এই মুহূর্তেও কেউ না কেউ তাঁকে পড়ছেন।
আমার নিকারাগুয়া
তুমি সে রাস্তায় যাও যেদিকে বড় গির্জের মুখ
কুড়িটি বাড়ি পার হয়ে যাও, আর একটি পাহাড়
তিনটি খিলান-সেতু পার হয়ে গেলে যে গুয়াডালুপ
সেখানে কোনও প্রাসাদোপম অলস ও স্প্যানিশ বাড়ি
তেমনটি নয়, যেমনটি তুমি শহরে দেখেছ
তাদের দেহে আছে তিনটি শতাব্দীর ভার
রোদেও অভ্যাস আছে বা ভূমিকম্পেও
হঠাৎ ভোর, দীর্ঘদিন ও অকস্মাৎ এর সন্ধ্যায় এসে
প্রায় বিরক্ত, ভাবছ, এই স্বভাব, যা প্রকৃতির
ছোট্ট ছোট্ট, সুন্দর নয় এবং বড্ড দুর্বল
নিচু লাল চালা, অনভ্যস্ত হাতে কাটা দরজারা
ভারতীয় কুঁড়েঘরের চাইতে সামান্যতম ভালো
ছবির মতন নয় তো, বরং বিষন্ন আর সাধারণ
ঠিক যেমন নিম্নবিত্ত ফ্ল্যাট বিষণ্ণ হয়
এখানে, তোমার শহরে, যেখানে দরিদ্ররা বাস করে
অথচ তারা খুশি যে সূর্য কত ঝলমল করছে
খুশি যে এই শীতল বাতাস কী কুলকুল বইছে
বড় খুশি তারা, বড় পবিত্র, বলতে লজ্জা পাচ্ছে
এবং সারাটা ক্ষণ ধরে আগ্নেয় পাহাড়ের ভয়ে
শ্বাস চেপে আছে, যদি তারা জাগে, ছাই করে দেয় সব
দ্যাখো দ্যাখো ওই দরজা পেরিয়ে ভেতর-দেওয়ালে দ্যাখো
পবিত্র ছবি, সাধু, দেবদূত ওই তো ঝুলছে ওখানে
বিক্রি হচ্ছে, আমার লোকেরা কিনছে শ্রদ্ধা করছে
দরজা পেরিয়ে দ্যাখো কত শিশু নিজের মনে খেলছে
বাগবিতণ্ডা করছে, যেমন শিশুমাত্রেই করে
দরজা পেরিয়ে ওই দ্যাখো কত নারী সেলাইয়ে ব্যস্ত
টেবিল গুছানো, হাজার একটা কাজে তারা সারাদিন
দেখার মতন কিছু না, যেমন সব মেয়েরাই করে
নিজেদের ঘরবাড়ির জন্য, এইতো তাদের জীবন
আর যদি তুমি কান পাতো, হয়তো শুনতে পাবে
তারা কেউ কেউ গাইছে, যেমন গান আর কোথাও নেই
তেমন চমকপ্রদ কি! ভ্রমণপিপাসু লোকেরা শোনে না
যদি বা গাইড ভাড়া করে, তারা তোমাকে কখনও
এদিকে নিয়ে আসবে না। এই সামান্য মানুষের
অতি সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দেখতে
কিন্তু এই তো সেই মাটি যাকে সুন্দরের শিকড় চেনে
তবু যদিবা আমার দেশকে চিনতে ইচ্ছে করে- সে এখানে
প্রায় দু’হাজার সন্তের কথা মনে করে স্পেনীয়রা
যে গির্জাটি গড়েছিল, হাতে খোদাই করানো বেদি
প্রায় ধসে পড়া দুর্গ, যেখানে লোকে বলে যে নেলসন
যিনি তখন জলের দস্যু, বাঁ চোখ হারান এখানে
এক নারীর সঙ্গে যুঝতে যুঝতে, ভ্রমণার্থীরা দেখে
যে দেশটিকে, সে দেশ কখনও আমার ছিল, আজ নেই
‘ডিয়ার’ হোটেল, উঠোনে দাঁড়ানো সারি সারি তালগাছ
একটি পিয়ানো নিজে বাজছে, ড্রাম ঢাকা আছে কাপড়ে
জার্মান, ইংরেজ ও ফরাসি লোকের দোকান ঘর
শাসকের বৈঠকখানা সাজানো নিউ ইয়র্কের এর মতো
একই রকম রুচিহীনতায়, এ দেশও তো আমার নয়
কিন্তু যে সার দেওয়া এবং শ্রীহীন ছোট ছোট বাড়ি
যেখানে মানুষ মানুষীরা থাকে, বাঁচার তাগিদে ব্যস্ত
বাঁচবার ভান করতে করতে, সেই তো আমার দেশ
আমার নিজের নিকারাগুয়া সে, মহান কবিদের জননী
আর এসব যখন দেখবে, কী? শুধু এসবঃ যদিও
খবর-কাগজে বিপ্লব আর ইত্যাদি ও প্রভৃতি
অন্যরকম জলবায়ু ও অন্যরকম রেওয়াজে
আর পিতামহেরাও ভিন্ন যদিও, আমার দেশের লোকেরা
তোমার দেশের লোকেদের মতোই, প্রায় সব এক তাদেরও
সেই এক আশা, এক দুশ্চিন্তা, নিজেদের নিয়ে ভাবনা
রুটির জন্য খেটে মরা, আরও অধিক কিছুর জন্যেও
যা বদলে যায় বারবার, প্রায় কখনওই এক থাকে না
সুখে ও দুঃখে, তোমার লোকেরাও
যেমন সুখী ও দুঃখী, হৃদয়ে কেবল মানবতা ভরা
আর সেটুকুই পাও যদি, তবে ভ্রমণ অমূল্য
সলোমনের এই কবিতাটি পড়তে পড়তে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ‘কর্ম’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়।
পৃথ্বী-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই ;
পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি হাওয়া ভগ্নী-ভাই।
তৃপ্তি তাঁরই শস্যে-জলে, ক্ষুৎ পিপাসা দুঃসহ।
মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁকেই প্রত্যহ।
ক্ষুদ্র নহি- তুচ্ছ নহি- ব্যর্থ মোরা নই কভু।
অর্থ মোদের দাস্য করে- অর্থ মোদের নয় প্রভু। “
ডে লা সেলভার লেখার ধরন যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে মেলে না ঠিকই, তবে দুজনেরই কবিতায় মাটির গন্ধ, সাধারণের কথা। দেশের কথা বলেছেন দুজনেই। আরও অনেকেই বলেছেন। কিন্তু এত বলার পরেও ভেদভাব আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে আমাদের মাঝখানে, প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে পুষ্ট হয়ে ওঠে। কেন যে! (ক্রমশ)