‘ না’ এ নারী সইতে নারি
মানসী কবিরাজ
খেলতে খেলতে মেয়েটির ছোট বাইরে ( ওভাবেই শেখানো হতো ) পায় , সমবয়সী ছেলেটিরও পায় এবং তারা আবিষ্কার কোথাও একটা তারা আলাদা । ছেলেটি দাঁড়িয়ে সমাধা করতে স্বচ্ছন্দ মেয়েটি বসে তাছাড়াও … দুজনেরটা আলাদা ।
মেয়েটি অবাক হয় , অকারণে তার অস্বস্তি শুরু হয় সে খেলা ছেড়ে দৌড়ে চলে যায় এবং সেই অপার বিস্ময় সে খুলে বলে বাড়িতে আর ঠিক সেদিন থেকেই তার চারপাশে বুনে দেওয়া হয় প্রাচীর যেখানে এক অদৃশ্য চেতাবনি সাঁটা । যা ছেলেটি করতে পারে , সে তা পারে না । শুরু হয় ‘ না’ এর জীবন ।
তুমি এক্স-এক্স , তুমি নিয়ন্ত্রক নও
কাজেই ছেলেটির মতো তুমি যেখানে সেখানে বা কারো সামনে ছোট বাইরে নৈব নৈব চ , সে তোমার ব্লাডার ফেটে যাবার যোগাড় হ’লেও না ।
তুমি এক্স-এক্স , তুমি নিয়ন্ত্রক নও
ছেলেদের সঙ্গে খেলা , ছেলেদের মতো খেলা তোমাকে মানায় না । গাড়ি বন্দুক ব্যাট বল যাই বলো বাপু সবেতেই ভীষণ ছেলে ছেলে গন্ধ লেগে আছে তার চেয়ে তুমি পুতুল খেলো বরং । ধুলো গুলে গুলে ভাত রান্না করো , বোতলের ঢাকনা চেপে চেপে গোল গোল করে পাতা কেটে লুচি ভাজো । আহা না হয় মিথ্যে মিথ্যেই চা বানিয়ে দাও খেলনা-কাপে , এগিয়ে দাও দাদাকে এগিয়ে দাও বাবাকে দ্যাখো কেমন আয়েশ করে ওরা চুমুক দেয়, আঃ বলে । খুব বেশি ইচ্ছা হ’লে দাদারা যখন ব্যাট দিয়ে খেলবে তুমি তখন বল কুড়িয়ে এনে দিও কেমন।
তুমি এক্স-এক্স , তুমি নিয়ন্ত্রক নও
তুমি চিৎকার করে কথা বলবে না , শব্দ করে হাসবে না , লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটবে না , পা ফাঁক করে দাঁড়াবে না , যখন তখন বায়না করবে না , খিদে পেলে বলবে না, রাগ হলে দেখাবে না, একা একা বাইরে যাবে না, সন্ধ্যার পর খোলা চুলে থাকবে না…আর এভাবেই তুমি ক্রমশ হয়ে উঠবে নারী, যার শুরুতেই লেগে আছে ‘না’
তুমি এক্স-এক্স , তুমি নিয়ন্ত্রক নও
কাজেই তুমি লিলিথ হতে চাইলে তোমার নির্বাসন অবশ্যম্ভাবী জেনো । এই দ্যাখো কেমন বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমার দেওয়ালে
“ কার্যেষু দাসী , করণেষু মন্ত্রী
ভোজেষু মাতা শয়নেষু রম্ভা
রূপেষু লক্ষ্মী ক্ষমায়েষু ধরিত্রী
সৎকর্মে নারি, কুলধর্মে পত্নী “
এই ২০২১ এ এসেও খুব কী বদলে গেছে চিত্র ? এখন হয়তো সো কলড্ কালচার্ড সমাজ মুখে উচ্চারণ করে না কিন্তু মনে মনে ? আসলে পিতৃতন্ত্র এমন শিকড় ছড়িয়েছে যে সমূলে উৎপাটন করলেই এই বুঝি ঝুরঝুর করে খুলে পড়ল সমা্জের মাটি পরিবারের মাটি ! এবং কী আশ্চর্য এই পিতৃতন্ত্রের শিকড়টা বেশি বেশি গভীর হয়ে প্রোথিত হয়েছে নারীদের মধ্যেই একথা অস্বীকার করার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে । একটা বাৎসরিক ৮ই মার্চ , কয়েকটা লাল গোলাপ কিংবা সেদিন সকালে চায়ের কাপ এগিয়ে দেওয়া বা সন্ধ্যায় টিভির স্ক্রিনে সেমিনার, আম- পরিবারে খুব একটা বদল আনে কী !
তাহলে কেন রাষ্ট্রকে এই ২০২১এ এসেও বলতে হয় ‘ বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও ‘ আসলে রাষ্ট্রও জানে বেটিরা বাঁচবে কিনা বা বাঁচলেও পড়বে কিনা সেটা মা বা বেটির উপর নির্ভর করেনা , নির্ভর করে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মাথা সেটা চায় কিনা !
সেই যে ১৯৫৭ সালে মার্কিন মুলুকের সুতো কলের মহিলা শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্য ,অমানুষিক পরিশ্রম , অমানবিক পরিবেশ , কাজের সঠিক নির্ঘণ্ট নিয়ে প্রথম প্রকাশ্য রাস্তায় নেমেছিলেন , সেই সংগ্রাম আজও চলছে । আর সেইজন্যই গার্হস্থ্য শ্রমকে ,শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার কথা আমরা আজও ভাবতে পারিনা উল্টে সেই শ্রমের গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে দিতে দ্বিধা করিনা যে এটা নাকি নারীরা সংসারকে ভালবেসে করে থাকেন । হায় ভালবাসা !তুমি তবে এতো অকরুণ ! আমার সমস্ত অন্যবিধ গুণাবলি বা অন্যতর ইচ্ছারা যে মড্যুলার কিচেনের শৌখিন বিভায় চাপা পড়ে গেল হায় বুঝি তার খবর পেলে না !
কী করে বোঝাই রান্নাটা আমি ভালো করলেও আসলে কিন্তু রান্না করতে আমি খুব মন্দবাসি ।বলতে নেই এসব কথা বলতে নেই মুখ ফুটে। মেয়ে মানে মেয়েছেলে বা সৌজন্য মিশ্রিত মেয়েমানুষ । মেয়ে তাই অনিন্দিতা হয়েও পুরষ্কার মঞ্চে বলে ওঠে সুউচ্চ স্বরে- আসলে রান্না করতে সে কত ভালবাসে, বলে গৃহ কাজেই জমা আছে সমস্ত সন্তুষ্টির আশ । আহা পিতৃতন্ত্র তখন গোঁফে তা দিয়ে – দ্যাখো কেমন রেখেছি বশ করে…
মেয়ে
ধুতরার বীজ বাটে শিলে
শয্যায় বিছায় কণ্টক
জলের কলসে ভরে
তীক্ষ্ণ দাবদাহ
যদিও সবটাই কল্প বিলাস
কারণ মহামান্য আদালত সদম্ভে বলেন –
১ – ধর্ষণ যখন করেই ফেলেছেন সেটা তো আর ফেরানো যাবে না তাহলে আপনি বরং মেয়েটিকে বিয়ে করে নিন । হয়ে গেল মুশকিল আসান নইলে কিন্তু জেলে যাওয়া অবধারিত ।
২ – স্তনটি কেমন অভিযুক্ত সেটা নেড়েচেড়ে টিপেটুপে দেখছেন ঠিকই কিন্তু যেহেতু সেখানে উদোম গা ছিল না তাই একে কিছুতেই শ্লীলতাহানি বলে দেগে দেওয়া ঠিক না
৩- পুরুষ স্বভাবতই নৃশংস প্রকৃতির হয়ে থাকে কিন্তু সেজন্য স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন এটা কোনও বিচার্য বিষয় হতে পারে না
এবং কবি লেখেন
“ আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি ।
আমাদের মা গরীব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এত তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা কোনোদিন মনেই হয়নি।
…………………
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো , তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু – দিনরাত টলমল করতো।
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি – সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো।
আমাদের মা ছিল ধানখেত- সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো ।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত – তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর- আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না
(হুমায়ুন আজাদ)
তোমার কোনোও ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না কারণ
তুমি এক্স-এক্স , তুমি নিয়ন্ত্রক নও
তাই তোমাকেই দিতে পারি আংটির উপেক্ষা , দিতে পারি বস্ত্রহরণ এপিসোড , দিতে পারি পাথর হওয়ার অভিশাপ , জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেবার ব্যবস্থা যদি বা কোনক্রমে পেড়িয়ে যাও তুমি, তোমাকে দিই অনন্ত বনবাস ।
খুব ভাল লেখা।
ধন্যবাদ
চুড়ান্ত বাস্তব। সেকালেও একালেও। এসব মনের কথা। তুমি লিখতে পেরেছ আমরা লিখে উঠতে পারিনি। কারন এই পিতৃতন্ত্রের মুচলেকা তে অনিচ্ছায় ও অলিখিত সই করেছি হয়তো আমরা। আর যে কথাটা আমার খুব মনে হয় সেটা হলো শারীরিক গঠনগত বৈষম্য আমাদেরকে বন্দি করে রেখেছে। অনেক কিছু ইচ্চা হলেও করতে পারিনি আমরা। যেটা খুব কষ্টের। ট্রেনের কামরায় জল নেই, দুর্গন্ধময়, শরীরে কষ্ট। সিগনাল না পেয়ে ফঁকা জায়গায় ট্রেন দাড়িয়ে আছে। পুঃ যাত্রী নামচে ছুটছে অথচ আমরা ঠাঁই বসে কষ্টের সঙ্গে সহবাস করছি। এইসব কষ্ট কি নারীদিবসের প্রাঙ্গনে সম্মাননা ও অভিনন্দন কে বড় করতে পারবে? আনন্দ দিতে পারবে? এমন বহু যন্ত্রণা কষ্ট নিয়ে আমরা সারাজীবন শুধু আপোষ করে যাব।
অসাধারণ একটি ভালো লেখা । সতেজ ও সাহসী । যৌক্তিক এবং মেদহীন গদ্য । ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ।
ধন্যবাদ
মানসী কবিরাজের গদ্যটির প্রেক্ষিতে আমার এই মন্তব্য ।
খুবই ভালো লাগলো। হে পৃথিবী তুমি যতবার ঘুরেছ একই থেকে গেছ — একটি প্রাচীন প্রবাদ।
খুবই ভালো লাগলো। হে পৃথিবী তুমি যতবার পাল্টেছ একই থেকে গেছ।