
ধারাবাহিক উপন্যাস স্রোত ষষ্ঠ পর্ব
যশোধরা রায়চৌধুরী
২০১৩-১৪। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়ে তৈরি করে একটা নতুন প্রবণতা। কয়েকটি মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করে তোলপাড় তুলে দেয়৷ এরা সব কেমন মেয়ে? কী চাইছে এরা? এই সব নিয়ে ও বাঙালি মধ্যবিত্তের ভুবনায়িত মূল্যবোধ নিয়েই "স্রোত"৷ গ্রন্থাকারে 'স্রোত' নাম দিয়ে একটি অতি সীমিত প্রকাশনা প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে প্রকাশক সব কপিশুদ্ধু গায়েব হয়ে যাওয়াতে, স্রোতকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে এবার আবহমানের পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে হাজির করার প্রচেষ্টা । "সম্পূর্ণ ভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এমন উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। নারীবাদী লেখকের লেখা উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু তাতে পুরুষের লোলুপতা কে কাঠগড়ায় দাঁড়করানো আর নারীকে শিকার প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় প্রায়শই অবজেকট্ভিটি থাকেনি। এই উপন্যাসের শিকড় গেছে নারী জীবন যাপনের নানা স্তরে । এর মধ্যে আছে যে ভাষায় পুরুষতন্ত্র জীবনের ন্যারেটিভ এমনকি সাহিত্য ও রচনা করে , তার ইন্টারপ্রিটেশন। এতে স্পষ্ট কথা আছে, অভিমান আছে, হাস্যরস এবং অসহায়তাও আছে । এবং সর্বোপরি পুরুষকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা।..এখনকার ছেলে মেয়ে দের হাতে ই তুলে দেওয়া কাহিনীর ব্যাটন, এদের স্পস্ট করে দেখা, বলতে পারা ও অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে পথ চলার সাহস কে কুর্ণিশ জানিয়েছেন যশোধরা। মুক্তি এরাই আনবে। যৌনতার রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করে তথ্যের নিরপেক্ষতার মধ্যে উত্তরণ।যশোধরার Clarity of perspective অতি তীক্ষ্ণ। সবমিলিয়ে উপন্যাস টি মনোভংগি ভাষা ও কাহিনী সর্ব অর্থে আধুনিক। একে বারে রিয়েল টাইমে দাঁড়িয়ে লেখা। দেশ কাল সময় ও ব্যক্তি সত্ত্বার বিশাল ব্যাপ্তিকে বিন্দুতে এনে কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা নির্মান করেছেন যশোধরা। নির্য্যাস হয়ে মনে রয়ে যায়, পুরুষকে বিযুক্ত করার অভিপ্রায় নয়, তার সংগে আবার প্রথম থেকে পড়া জীবনের পাঠ।" ( অনিতা অগ্নিহোত্রী)
৬
অলক্তিকার সাহিত্যচেতনা
বিবর পড়েছিস?
না।
যাও পাখি?
না।
ম্যারেজ অ্যান্ড মরালস?
না।
সুনীল গাঙ্গুলিও পড়িসনি নিশ্চয়ি? সেই সময় বা পূর্ব পশ্চিম?
না।
কী পড়েছিস তাহলে? খালি খালি কতগুলো ওই হ্যারি পটার পড়ে তুই হিউম্যানিটিজ –এ টুয়েল্ভ পাস করে যাবি? জানিস যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ইংরিজি অনার্স পড়তে গেলে অ্যাডমিশন টেস্টে বসতে হয়? কীরকম টাফ হয় সেটা কোন ধারণা আছে? জানিস ওরা লীলা মজুমদারের ওপর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর নোট লিখতে দেয়? কিছু বই তোকে পড়তেই হবে। তারাশংকরের গণদেবতা। বা সতীনাথের জাগরী । বা ঢোঁড়াই চরিত মানস। শিক্ষিত হ, বুঝলি , শিক্ষিত হ।
এই হচ্ছে তৃষা আন্টির দোষ। অলক্তিকার বাবার বন্ধু। ও যে বাড়িতে একরকম সব ঘোষণাই করে দিয়েছিল, মনে মনে ঠিকঠাক করেই ফেলেছিল, যে বি এ ক্লাসে ইংরেজি বা হিস্ট্রি পড়বে, সে আইডিয়াটা তৃষা আন্টিরই। তৃষা আন্টি ব্যাক করেছে। তাই বাবা মা-ও টুঁ শব্দ করল না। নইলে আত্মীয়দের মধ্যে ত নানান কথা হত। ফানি লোক সব। হায়ার সেকেন্ডারিতে আর্টস নিয়েছে মাধ্যমিকে অঙ্কে ৯৬ পেয়ে , তাইতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল মায়ের এক মাসি। আরেকজন ত এখনো বলে, ইঞ্জিনিয়ার হলি না! তবে তৃষা আন্টি এমনিতে ভীষণ বন্ধুর মত। কুল। তাও, ওর সঙ্গে কথাবার্তা এই রকমই। খালি জ্ঞান দেবে।
ইলেভেনে পড়তে পড়তেই ঐসব উপরি উক্ত ডায়ালগ ঝেড়েছিল আন্টি। একদা আন্টি ওকে হিউম্যানিটিজ নিয়ে দারুণ একটা লেকচার দেয়।
I am a teacher of the humanities. Humanities teachers are like personal trainers in the gym of the mind.
বলেছেন গায়ত্রী স্পিভাক।
এই আন্টিই সে অর্থে ওর সাহিত্য আর হিউম্যানিটিস পড়ার গোড়া। আন্টির কথা শুনে, পড়াগুলো প্রথমে শুরু করেছিল অলক্তিকা মায়ের কবিতার কালেকশন দিয়ে। তারপর বাংলা উপন্যাস পড়েছে। মতি নন্দী, রমাপদ চৌধুরী। পাশাপাশি ইংরিজি বইপত্তর। অনেকগুলো ফেমিনিস্ট বইও পড়িয়ে দিয়েছে আন্টি , সিমোন দ্য বভোয়া অথবা ফে ওয়েলডন, জার্মেন গ্রিয়ার শুধু নয়। যতদিনে অলক্তিকা যাদবপুরের ইংরিজি ফার্স্ট ইয়ার, অনেকটাই পড়া হয়ে গেছে।
অ্যাডমিশন টেস্টে প্রশ্ন এসেছিল অদ্ভুত। ইংরিজি অনার্স পড়তে সতীনাথ ভাদুড়ির ওপর শর্ট নোট লিখতে হবে। খাইসে। বন্ধুরা ঠোঁট কামড়াল। বাইরে বেরিয়ে অনেকেই বলল, যাঃব্বাব্বাঃ এসব কি , মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বস।
অলক্তিকা মুখ টিপে হেসেছিল। ওর মজা লেগেছিল। ভাগ্যিস তৃষা আন্টি ছিল। ওকে ঢোঁড়াই চরিত মানস পড়িয়েছিল। তাই এ যাত্রা উতরে গেল।
কিন্তু ঝামেলা তো তার পর শুরু। যত পড়ে তত মনে প্রশ্ন জাগে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, সব এক পেশে । সব কিছু ভীষণ নিজের কোলে ঝোল টানা টাইপ। আর ঝোল টানছে কে? হিরো। প্রোটাগনিস্ট। পুরুষ লেখকের পুরুষ প্রোটাগনিস্ট। সমরেশ বসুর বিবর দ্যাখো। অথবা সন্দীপনের বিজনের রক্তমাংস।
পরশু তৃষা আন্টি বলল তোকে একটা কুইজ দিচ্ছি। তোর বন্ধুদের। ফেসবুকে। পোস্ট করল। একটা কবিতা। এইভাবে।
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ
অমৃত সকলি তার – মিলন বিরহ !
বুঝি না আধ্যাত্মিকতা,
দেহ ছাড়া প্রেম-কথা,
কামুক লম্পট ভাই যা কহ তা কহ।
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ!
আমি ও নারীর রূপে
আমি ও মাংসের স্তূপে,
কামনার কমনীয় কেলী-কালীদহ –
ও কর্দমে – অই পঙ্কে,
অই ক্লেদে – ও কলঙ্কে,
কালীয় নাগের মত সুখী অহরহ!
আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ !
বলুন তো এ কবিতা কার লেখা? হিন্ট : কবির জন্ম ১৮৫৪।
হিন্ট থেকে পায়নি অলক্তিকা, পেয়েছে তৃষা আন্টির ইনবক্স থেকে।
যাই বল এই মেল ফ্যান্টাসি আমার জঘন্য লেগেছে। এসব পুরুষতান্ত্রিক কবিতা-গপ্পো উপন্যাস আমাকে আর শুনিয়ো না আন্টি। যত্তসব। কে কী লিখল তাতে আমার ভারি ছেঁড়া পড়ল।
ছিঃ কী সব ভাষা বলছিস । তৃষা আন্টি খ্যাঁক খ্যাঁক হাসির ইমোটিকন দিল ওকে। বলল, রবি ঠাকুরের কবিতা পড় তাহলে গিয়ে। উফ, এমন সাবলিমেশন করেছে বুড়ো, যে পরবর্তী এক্কেবারে ষাট থেকে আশি বছরের জন্য নাকাবন্দী করিয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতাকে। পঞ্চাশের দশকের আগে আর কেউ লিখতে পেরেছে সেক্স নিয়ে, শরীরী কামনা নিয়ে, নিজের লিবিডোকে প্রকাশ করতে পেরেছে নির্দ্বিধায় লেখার ভেতর? সব স্যানিটাইজড, ভদ্র, ভিক্টোরিয়ান ভ্যালুজ এর ডেটল জলে চোবানো। কেউ আর মেয়েদের বুকের নিচে নামতে পারেনি।
হুম, তাই তুমি বলতে চাইছ, রবি ঠাকুরের থেকে বয়সে কয়েক বছরের বড়, এই গোবিন্দ চন্দ্র দাস , এসবের তোয়াক্কা না করে তখনই লিখে গেছে কবিতাটা।
হ্যাঁ, তারপর ওই লম্বা গ্যাপটা পড়ল।
হ্যাঁ , সেই গ্যাপের পর উনিশশো পঞ্চাশের দশকে কৃত্তিবাসের “স্বীকারোক্তিমূলক” এসে গেল, আর লেখা হল কিছুটা অনবদমিত লেখা। সুনীল গাঙ্গুলির দিস্তে দিস্তে লেখায় চুমু আর সঙ্গমের বর্ণনা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু একশো বছর আগেও মেয়েদের যৌনতা একটা ট্যাবু জিনিশ ছিল, নিষিদ্ধ জিনিশ । একশো বছর পরেও রইল।
এভরিথিং ইজ সো মেল সেন্ট্রিক, আন্টি।
হ্যাঁ ।তুই হেনরি মিলার পড়, দ্য ট্রপিক অফ ক্যান্সার বা দ্য পিঙ্ক সেক্সটাস। দারুণ সাহিত্য কিন্তু পুরোটাই একটা পুরুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে রেখে লিখে যাওয়া। সেক্সুয়াল প্রাওয়েস দেখানো। কতটা সে বিছানায় ক্ষমতাবান, কতরকম ভাবে সঙ্গম করতে পারে, কত সহজে মেয়েদের পটাতে পারে, মেয়েদের তুলতে পারে। এই পৌরুষ কপচানোর সাহিত্যেরই কিন্তু এদেশি ভার্শন লিখেছেন বেলাল চৌধুরী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সুবিমল মিশ্ররা। অবশ্যই এদেশি ঘরানায়। এই শোন , তোকে এসব লিখছি আবার তোর বাবা মা জানতে পারলে কিন্তু যা তা ভাববে আমাকে।
আন্টির সঙ্গে নির্বিবাদে এইসব নিয়ে কথা হয়। কয়েকটা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও হয়। মানে যারা একটু আধটু সাহিত্য ভালবাসে, সত্যিই পড়ে, তাদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলে, অলক্তিকা। এই এত্ত এত্ত বছরের সাহিত্য মাহিত্য সব আসলে পুরুষদের লেখা। তা হোক না গিয়ে। পুরুষরা বড় সাহিত্য যা লিখেছে, নোবেল উইনারগুলো থেকে শুরু করে ক্লাসিক মাসিক সব, প্রত্যেকটা আত্মজীবনী টাইপ। অথচ মেয়েদের কোন লেখা নিয়ে কথা বলতে গেলেই ওরা বলে, এগুলোর মধ্যে সাহিত্য আবার কী আছে, এগুলো তো সব আত্মজীবনী। মেয়েরা নিজেদের গন্ডীর বাইরে আবার বেরোতে পারে নাকি? সেই অবজেক্টিভিটি কোথায়? সেই ম্যাক্রোস্কোপিক ভিশন কোথায়?
পর পর তিন চারটে নেভি ব্লু টি শার্ট পরা মূর্তি চলেছে। এক ছন্দে হাত দোলাতে দোলাতে। দূর থেকে দেখে চোখে ভ্রম হয়৷ যেন একটাই ফিগার যাচ্ছে সাপের মত এঁকে বেঁকে। বা আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতে পারলে মনে হয় ইউনিফর্ম পরা আর্মি। তবে ভালভাবে দেখলে দু রকম নীল আর একটা কালো টি শার্ট আছে। একটা মেয়ে লং স্কার্ট আর কালচে ফুটি ফুটি ব্লাউজেও আছে। কিন্তু চারজনের চলাফেরায় এমন একটা কিছু আছে, যে যে কেউ একটু থমকায়। কেউ বাহ বলে, কেউ মনে মনে সামান্য ঘাবড়ায়। বাব্বাহ! বলে… কিছু অননুমোদনের সুরে। যে মেয়েদের প্রেট্রনাইজ করা যায়না তারা আবার মেয়ে নাকি। এদের দেখলেই মনে হয় রং নিচ্ছে। যেন কয়েকটি পালোয়ান গুন্ডাগার্দি করতে বেরিয়েছে।
আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে বেরিয়ে ওরা এসি-র দিকে যাচ্ছিল। চারজন। অলক্তিকা, রাই, দিশা , অয়নী।
এরা মেয়ে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে। আর্টস। ইংরেজি হিস্ট্রি ইকো। অলক্তিকার লম্বা চুল এখন। সেটা টেনে হাত খোঁপা করে গার্টার দিয়ে মাথার ওপর উঁচু করে।বাঁধা। যেন শিং। অন্য দুজনের মধ্যে রাইয়ের চেহারা গাঁট্টাগোট্টা। চুল ক্রু কাট মানে একেবারে ছোট ছোট। তৃতীয়জন, অয়নী ফিনফিনে রোগা কিন্তু শরীর থেকে বিদ্যুৎ ঝরছে। এর চুল ছোট, একে বলে পিক্সি কাট। দিশা মাঝারি মাপের। চুলে পনিটেল।
দু হাজার পনের সালে বেবি নামে অক্ষয় কুমার এর অভিনয় করা সুপার হিট একটা হিন্দি ছবিতে তাপসি পান্নু উঁচু চুড়ো করে চু ল বেঁধে বদমাসদের উদুম ঠেঙাবে। সেই সময়ের পর থেকে উঁচু করে চুল বাঁধাটা প্রতীক হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, ছেলেরা নাকি মেয়েদের থেকে বেটার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট থিংকিং পারে। পড়িস্ নি, ছেলেদের ব্রেনের লেফট হেমিস্ফিয়ার বেশি কাজের আর মেয়েদের রাইট? ছেলেদের রিজনিং পাওয়ার , ডিসিশন মেকিং পাওয়ার বেশি। মেয়েদের ইনটুইটিভ পাওয়ার বেশি । রাই বলল।
তুই যেটা বললি , সেটা বেদবাক্য বলে মেনে এসেছে এতদিন ধরে সব পন্ডিত, কারণ ওটা বলেছে সমস্ত ওয়েস্টার্ন থিংকারদের দাদু, বিজ্ঞ অ্যারিস্টটল। সেই কবে ! তাও , ওটাই চলছে। বলে গেছে, মেয়েরা দেখতে নরম সরম কিন্তু আসলে বেশি বদমাইশ, তাদের সারল্য নেই, তাদের আবেগপ্রধান চরিত্র, শিশুদের লালন পালন করতে পারে, ওটাই তাদের একমাত্র গুণ। পুরুষেরা অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ। কান্ট এবং পরবর্তী মার্কিন অনেক সাইকলজিস্ট ও একই কথা বলে গেছে। অলক্তিকা জ্ঞান মারল।
-হ্যাঁ কিন্তু পরে বিহেভরিয়াল স্টাডি অনেক হয়েছে। ২০০১ এ বার্বার আর ওডিন এর স্টাডিতে বেরিয়েছিল নাকি, ছেলেরা একা থাকলে অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ে ভুলভাল ইনভেস্টমেন্ট করে শেয়ার বাজারে। বিবাহিত পুরুষরা বেশি ধীরস্থির ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। আর সিঙ্গল মহিলারা অনেক বেশি বুঝেশুনে টাকা শেয়ার বাজারে খাটান, বিবাহিত পুরুষদের থেকে কম সংখ্যায় হলেও, যারা করেন, তাঁদের ট্রেন্ড এটাই। এটা অয়নী যোগ করল।
-আরে ছাড়। আর বেশি সাইকোলজি মাড়াস না। এসব স্টাডি ওখানে রোজ তিন চারটে করে বেরোচ্ছে। ফলাফলও এত রকমের, যে ও থেকে কিছু প্রমাণ হয়না। রাই বলেছিল।
রাইয়ের বাবা মা দুজনেই সাইকোলজির ছাত্র। দুজনেই পড়ায়।
ক্যান্টিনে চা আর পকোড়া খেয়ে ভিড়টার দিকে তাকিয়ে অলক্তিকা বলল, ধুস এখানটা ভাল্লাগছে না। আমাদের ডিপার্টমেন্টে চল।
আমার বাড়ি চল না বাবা। এই ত দু পা। রাই বাড়িতে নিয়ে গেল ওদের। বেঙ্গল ল্যাম্পের গেট দিয়ে বেরিয়ে উল্টোদিকে খানিকটা হাঁটল ওরা। ফ্ল্যাটটা নিরিবিলি অংশে। ভেতরদিকে। একদম ফাঁকা বাড়ি। ওর কাছে চাবি থাকে। বাবা মা কাজে গেছে। কুট করে দরজা খুলে চারজন রাইয়ের ঘরে গুছিয়ে বসল।
দিশা ভুরু কুঁচকে ভাবছে। আবার একটু বেশিই লেখার ব্যাপারটা নিয়ে থাকতে চায়। ও বলে, ঐ আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারটা আমাকে এখনো ইনট্রিগ করছে। জানিস, আমার কীরকম মনে হয়, এই এত এত বছর ধরে নভেলে পুরুষরা পুরুষদের নিয়েই উপন্যাস লিখেছে কিন্তু ওপরে খোলশটা দিয়েছে অবজেক্টিভিটির।
হ্যাঁ , সেটা একটা দিক। অন্য দিকটা আমার আরো অবজেকশনেবল লাগে জানিস তো। এদের সব লেখায় বড্ড আমি আমি। পুরুষগুলো নিজেদের হাগু, হিশু, বীর্যপাত, প্রেম , যেগুলো আবার বেশির ভাগ সময়েই বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, তা নিয়ে লিখে যায় পাতার পর পাতা। যেন সেগুলোর থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট কোন ঘটনা আর নেই। মেয়েদের নিয়ে যে লেখাগুলো, মেয়েদের যেভাবে ওরা দেখায়, ডেপিক্ট করে, তার মধ্যে ত অ্যাঞ্জেল হোর ডিকটমি। হয় উর্বশী নয় সতীসাবিত্রী। হয় ভীষণ গুডি গুডি নায়িকা নয়ত ভ্যাম্প। ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। উর্বশীদের সঙ্গে দেহগত প্রেম করে তারপর পুরুষ নায়করা ফিরে যাচ্ছে বউয়ের আঁচলের তলায়। শেষ মেশ জয় হচ্ছে বউয়ের। কারণ না হলে সোশ্যাল ইনস্টিটিউশনটাকে জিতিয়ে দেওয়া হয়না। দাগিয়ে দিতে হবে বউয়ের সীতার মত আত্মত্যাগ করে সংসার টিঁকিয়ে রাখার গল্পটা। নইলে মেয়েরা সব বখে যাবে।
এই কথাটা বলল অয়নী। ও স্মোক করছিল। রাইয়ের বিছানার পাশে জানালার ধারের খোপ কাটা অংশটায় পা তুলে উঠে বসে আছে।
অলক্তিকা বলে, মুশকিল হল, এরা সবকিছু লিখেছে এদের নিজেদের রুলস সেট করে। যেখানে মেয়েদের ঢুকতে গেলে ওই ঐ রুলসগুলো মেনে লিখে দেখাতে হয়েছে। কোন অলটারনেটিভ ডিসকোর্স মানে বয়ান কিন্তু উঠে আসেনি।
কিন্তু জেন অস্টেন বা শার্লট ব্রন্টি তো নিজেরা সেই রুলের ভেতরে থেকেই অসম্ভব ঠিকঠাক সব জিনিশ লিখতে পেরেছে রে। ওদের প্রথম প্রকাশের সময় নাকি পাঠক ভেবেছিল, আসলে ওই পেন নেমের আড়ালে কোন পুরুষ আছে। এতটাই বাঁধুনি আর অবজেক্টিভিটি। আমাদের এখানে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা পড়েও তাই বলেছিল কেউ কেউ, এটা ছদ্মনামে কোন পুরুষ নয়ত?
আসলে লেখার স্ট্রেংথ বা লেখার জোর যাই বল, দেখলেই পুরুষ ভাবার একটা রেওয়াজ রয়েছে। মেয়েরা একই ভাষায় যদি নিজেদের সমস্যাগুলো লেখে… যেমন ধর পিরিওডস।
পিরিওডস কে সমস্যা বলতে আমি রাজি নয়। রাই আবার দ্বিমত হয়। আবার বেঁকে বসে। একটা ন্যাচারাল বায়োলজিকাল জিনিশ। সেটাকে সমস্যা কেন বলব। মাসের তিনদিন চারদিন একটু পেট ব্যথা হয় বলে ? সমাজ এই জিনিশটাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, সমাজ বলেছে তুমি ওই সময় অশুদ্ধ, অপবিত্র, তাই? সেটা যদি ইনিশিয়ালি হাইজিন থেকে এসেও থাকে, এখন স্যানিটারি প্যাড ইত্যাদি এসে গিয়ে তো আর সেই কন্সার্ন গুলোই থাকার কথা নয় , তাই না? এখন তাহলে কেন সমস্যা কথাটা বলা হবে। কেন একটা ন্যাচারাল প্রসেসকে ন্যাচারালি উচ্চারণ করতে পারা যাবে না। মাসিক না বলে পিরিওডস বলতে হবে?
অয়নী, দিশা, রাই আর অলক্তিকা এই নিয়ে ডিসকাস করতে করতেই একদিন এই কথাটা ভেবে ফেলে। “আচ্ছা, মেয়েরা যদি এইরকম ভাবে পিরিওডসের কথা লিখত? কেউ মেনে নিত? যেভাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মাস্টার্বেশনের কথা লেখে? বা হেনরি মিলার নিজের মেয়েবাজির গল্পগুলো?”
তারপর হঠাৎ ওদের ভেতরে সব রকমের মতভেদ উড়ে যায়। ওরা ভাবতে শুরু করে, নিজেদের মাত্রই কয়েক বছর আগেকার ঘটে যাওয়া এই জৈবিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে নীরবতার দিন গিয়েছে। এই নীরবতা ভাঙতে হবে।
অয়নী বলে, জানিস, আমার যে পিরিওডস নামক একটা বস্তু কখনো হতে পারে, এই যুগের মহিলা হয়ে, একটা মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করেও আমার মা কোনদিন সেটা আমাকে বলেনি? আমি বারো বছর বয়সে একদিন আবিষ্কার করলাম আমার প্যান্টিতে রক্ত। আমার ভয় হল। মা বাবা বাড়িতে থাকে না, সারাদিন। আমি কাউকে বললাম না। মায়ের ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলো নিয়ে নিয়ে রক্ত আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঘরের কোনায় গুম মেরে বসে থাকছি। ওরাও দিনের পর দিন কেউ জিগ্যেস করছে না আমার কী হয়েছে। কী ইনসেন্সিটিভ ছিল রে মা!
হঠাত জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিশে পেটে হাত চেপে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে অয়নী।
বাকিরা হাত বাড়ায় অয়নীর দিকে । ওকে আদর করে। মাত্রই আট থেকে ছ বছর আগে সবার শরীরে এই পিরিওডস নামক জিনিশ এসেছে। সাদা বাংলায় মাসিক। দিশা দেখেছে, পিরিওডসের রক্ত লাগা প্যান্টি বা ট্রাউজারস জিন্স, ফ্রক, বিছানার চাদর মা আলাদা করে ভিজিয়ে দিত। কাজের মাসি নাকি ওসব কাচে না। নাক শিঁটকে সরিয়ে দেয়। মা রেগে রেগে সাবানের বার আর ব্রাশ বুলোত লালচে ছোপ লাগা জায়গাগুলোতে। দাঁতে দাঁত চেপে।
স্কুল ফাইনালের পর থেকে দিশা নিজে কাচে সেসব কাপড়। দিশার বাবা কিন্তু ব্যাপারটা অন্যভাবে ডিল করত। বলত, দিশা, দাগ লেগে যাবার ভয়ে তুই অমন শিঁটিয়ে শুয়ে থাকিস কেন? দরকার হলে তোর ছোটবেলার অয়েল ক্লথ পেতে নিবি। ওরকম কষ্ট করে শুয়ে থাকবি না।
মা মুখ ব্যাঁকাত। হুঃ, বাবার আহ্লাদি মেয়ে । যা বুঝবে করো।
দিশা এখন হেভি ফ্লোর জন্য যেরকমটা বাজারে পাওয়া যায়, তেমনই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে।