ধারাবাহিক উপন্যাস মনে রবে কিনা রবে (৯-১০ পর্ব) মোনালিসা ঘোষ
নয়
নিয়মমাফিক ফোন আসে। কথা হয় গতানুগতিক। ইন্দ্রনাথের| তেমন কোন অপেক্ষা নেই ভুলোমনার। কবে থেকে কি এক আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় সব উচাটন শেষ হয়ে গেছে। মন কিরকম পাল্টি খায়! বহুরূপীর মতো রং বদলায় ! আশ্চর্য লাগে ভুলোমনার।
ইন্দ্রনাথ প্রশ্ন করে শরীর কেমন? কি করছো? কেমন আছো? এইসব। তারপর নিজের কি এক তাড়াহুড়োয় হড়বড় করে বলে ওঠে ইন্দ্রনাথ-ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। যেন ঠিক না হয়ে উপায় নেই ভুলোমনার। ভুলোমনা ঠিক হলে ইন্দ্রনাথ যেন বাঁচবে।
নিয়মমাফিক ফোন ধরতে ধরতে অনেক সময় ফোন ধরতে ভুলে যায় ভুলোমনা। ফোন ফেলে রেখে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় ও। মিসড কল দেখতে পেলে কল করে নেয়। গোটা ব্যাপারটাই হয় কেমন যেন পানসে পানসে ভাবে। একটা কবিতা টোকা আছে তার পুরনো ডায়েরিতে। সেই কবিতাটার মত লাগে ভুলোমনার নিজেকে। আই ফ্যান্সিড ইউ উড রিটার্ন দ্য ওয়ে ইউ সেইড। বাট আই গ্রো ওলড্ এ্যান্ড ফরগেট ইওর নেইম। আই মেইড্ ইউ আপ্ ইনসাইড মাই হেড। সত্যি ইন্দ্রনাথ কি আর কোনদিন ফিরবে, তার জীবনে সেই আগেকার মতো থ্রিল নিয়ে?
তা আর সম্ভব নয়। তারচেয়ে এটাই যেন বড় বেশী সত্যি হবে যে ভুলোমনা ক্রমশঃ বুড়ি হয়ে উঠবে আর ভুলে যাবে ইন্দ্রনাথের নামধাম। এক গাঢ় আ্যামনেশিয়ায় সে মুক্তি দেবে ইন্দ্রনাথকে। আর মিঠুয়া; মিঠুয়া বলে যে কেউ ছিল , যে ইন্দ্রনাথকে রচনা করেছিল তার মনের মধ্যে, সে লুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।
এখনও মিঠুয়া বেঁচেবর্তে আছে,সামন্তের তক্তাবধানে।ভুলোমনা দেখেছে,সামন্ত তাকে মিঠুয়া বলে ডাকে আর সবসময় তার কি দরকার তাই জিজ্ঞেস করে। তার একটা জীবনদর্শন দরকার,মনে হয় ভুলোমনার। সেই জীবনদর্শন অনুসারে সে দিনগুলোকে সাজিয়ে ফেলবে। এরকম ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে না দিবা-রাত্র। কিন্তু সে কথা সামন্তকে কখনও বলে না ভুলোমনা যে আমাকে একটা জীবন-দর্শন পাঠিয়ে দিও। এদিকে সামন্ত পইপই করে তাগাদা দিতে থাকে, তার যা যা দরকার সে যেন বলে। সামন্ত নিজে এসে দিয়ে যাবে। একদিন কি ভেবে সামন্ত তাকে বলে, তার কি ওই বালাপোষটা দরকার,যেটা ছাড়া সে ঘুমোতে পারত না! ভুলোমনা আকাশ-পাতাল ভাবে , কোন বালাপোষের কথা বলছে সে ? তার এইরকম কোন আদরের বালাপোষ ছিল বুঝি? এককালে? যদি থাকেও, ওমা, সেটা ছাড়া তো দিব্যি বেঁচে থাকা যাচ্ছে। তাহলে আবার সেটা বয়ে বয়ে নিয়ে আসার কি দরকার ? এদিকে সামন্ত আবার চায় সেটা দিতে। বলে, চাও ? দিয়ে যাব ? ঝামেলা! এ ম্যাগো, এরকম একটা অপদার্থ জিনিস, যার মধ্যে না জানি কি কি স্মৃতি মিশে আছে, সেটা নিয়ে সে কি করবে? হঠাৎ গা বমিবমি করে ওয়াক্ ওঠে ভূলোমনার। সে ওয়াক্ তুলছে শুনতে পেয়ে, তড়িঘড়ি সামন্ত বলে, আচ্ছা,থাক,থাক। দরকার যখন নেই ..
কিন্তু গা বমি বমি ভাবটা কমে না ভুলোমনার। ওয়াক্ তুলে তুলে সে নিজেকে শেষ করতে থাকে। মুখে কনকনে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা মারে। ঘরের বাইরে এসে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগায়। কতগুলো পুরনো জিনিসপত্র এমনি দমবন্ধকর হতে পারে , হতে পারে এত বিবমিষা উদ্রেককারী এ যে ভাবা যায় না ! ভুলোমনাকে মাথা হেলিয়ে একা ভরসন্ধ্যাবেলায় বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখে সন্দেহ হয় গুরুং-এর। হনহনিয়ে আসে গুরুং ভুলোমনার কাছে। -শরীর খারাপ?
রক্তচক্ষু খুলে ভুলোমনা তাকায় গুরুং-এর দিকে। গুরুং জিজ্ঞেস করে-কি কষ্ট হচ্ছে?
-গা বমি বমি।
-হজম হয়নি, কি ব্যাপার বলত? তুমি তো তেমন কিছু খাওনি?
-না, মানে ওই আর কি। আসলে, মনে হচ্ছে কিছু জিনিসপত্র যেন আমায় চেপে ধরছে। যত চেপে ধরছে, তত গা-টা গুলিয়ে উঠছে।
-জিনিসপত্র?
হতভম্ব হয়ে-যায় গুরুং। হাতটা ধরে ভুলোমনার পালস্ দেখে। তারপর বলে, ওঠো, এখানে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ভুলোমনা টলমল করে উঠে দাঁড়ায়। গুরুং বলে, চলো। আমি ধরছি। ভুলোমনা চলে।
গুরুং তাকে নিয়ে যায় রিমপোচের ঘরে। সেখানে সাত-আটজন লোক বসে রিমপোচের কথা শুনছিল।
রিমপোচে একটা গল্প বলছিলেন। ভুলোমনাকে দেখে ঈশারায় বসতে বললেন। ভুলোমনা একটা সোফার ওপর গুটিশুটি হয়ে বসল। রিমপোচে আবার তার গল্প শুরু করলেন। “যীশুখ্রিস্টের নাম আপনারা শুনেছেন? উপস্থিত সকলে মাথা নাড়লেন। একবার এক ধনী লোক যীশুখ্রিস্টকে অবতার ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন, শাশ্বত জীবন লাভের জন্য আমি কি করব? যীশু তাকে বললেন, “ফিরে যাও, যা কিছু আছে বিক্রি কর ও দরিদ্রকে দাও।তারপর এস, তোমার প্রাপ্য যন্ত্রণা ভোগ কর ও আমায় অনুসরণ কর।” এই শুনে ধনী লোকটি বিষাদাচ্ছন্ন হল । দুঃখিত হয়ে চলে গেল; কারণ তার বহু সম্পত্তি ছিল। সে ভাবল, যিশুর কাছে গিয়ে সম্পত্তি খুইয়ে লাভ কী?
উপস্থিত সকলে হেসে উঠল। ভুলোমনার মোটে হাসি পেল না সে তার পূর্ব দিনের সঞ্চিত মূল্যহীন,বহুমূল্য ও অমূল্য সব ধরণের জিনিসপত্রের নিলাম লাগিয়ে দিল মনে মনে। আর তখনই সে টের পেল তার গা-বমি ভাবটা চলে গিয়ে বদলে কি এক পরমশান্তি ঘুমের আকারে ধেয়ে আসছে তার দিকে। ঐ এল-ঐ এল।
চোখের সামনে সেই মহাঘুমের তরঙ্গকে ধেয়ে আসতে দেখল ভুলোমনা আর অচিরেই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করল ঘুমের হাতে। রিমপোচের ঘরে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোতে লাগল ভুলোমনা। জগৎ লয়প্রাপ্ত হল। সে আছে আর পরম শান্তি স্বরূপ এক অদৃশ্য অস্পর্শনীয়, ভাবনাহীন ঘুম আছে। যেন কতকাল নির্ঘুম একলা জেগে কাটিয়ে বহু তপস্যার ফলে এমন এক ঘুমের নাগাল পেয়েছে সে।
বেহুঁশ ঘুমে আক্রান্ত ভুলোমনাকে ফেলে সকলে একে একে চলে যেতে লাগল। রিমপোচে ঈশারায় একজনকে ডেকে তার গায়ে একটা গরম কম্বল চাপা দিয়ে দিতে বললেন।
পরদিন সকালটা ছিল পরম শান্তি দিয়ে মোড়া। মাথার ভেতরে কোলাহল যেন থেমে গেছে। পৃথিবী এমন এক অমোঘ নিয়মে তার কাজ করে চলেছে,কোথাও যেন কোন ছন্দপতন নেই ! দেবেন্দ্র কোথাও তার কাজে ব্যস্ত আছে। গুরুং ব্যস্ত। চাচীর ঢের কাজ বাকি । পিসির যেন মরবার সময় নেই। এতবড় একখানা সংসারের চাকা তার হাতেই ঘর্ঘর শব্দে ঘুরে চলেছে কিনা।
ফাঁকা মাথা, হাওয়া-হাওয়া মন নিয়ে ভুলোমনা হাঁটতে হাঁটতে গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। চিকুর অনেকদিন দেখাপত্তর নেই, কোথায় লা-পাতা হয়ে আছে। চুরি-ডাকাতি করছে বোধহয়। সবই পেটের দায়ে
করে ও। এবার চিকু ফিরলে মোড়ের দোকান থেকে চিকুকে ভুলোমনা কেক কিনে খাওয়াবে। চিকুর ব্যাপারে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভুলোমনার কুকুরছানাগুলোর কথা মনে পড়ল। ওগুলোর আলাদা আলাদা করে নাম
দিতে হবে। সবকটাকে মার্কিং করে নাম দিতে হবে। নয়তো এত একরকমের দেখতে,গুলিয়ে যাবে। ভুলোমনা এক প্যাকেট দুধ কিনল ছানাগুলোর জন্য। দুধ কিনে হাঁটতে লাগল সেই মাঠটার দিকে। কিন্তু যাওয়ার পথে এক গ্রামবাসী সাইকেল নিয়ে যেতে যেতে ভুলোমনাকে এক অজীবসা খবর দিল। বো এক তো মরগয়্যা। দেখা নহী? কে আবার মরে গেল। এই পৃথিবীতে দুমদাম করে কেউ না কেউ মরে কেন?
-কে?
-আরে, বো কুত্তা, গাড়ি কা নীচে আ গয়্যা থা।-হোয়্যাট ! ভুলোমনা দৌড়তে শুরু করল। তীরবেগে। সে শর্টকাট মারল। বড় রাস্তা না ধরে আদাড়-পাদাড় পেরিয়ে সে বেড়ার ওপাশ দিয়ে ঢুকল। বাগানের ধার ঘেঁষে বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে, ভুলোমনা উঁকি মেরে দেখল,গাড়ীটার তলায় সবকটা একসঙ্গে জড়ো হয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ভুলোমনা দেখতে পেল দশ গজ দূরে মেঠো পথের ওপর ছানাটা মরে পড়ে আছে। সবচেয়ে তাগড়াটা। ওটা খেত বেশি আর ভয়ডরও কম ছিল একটু। সেই মোপেড চড়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটাও যেতে যেতে বলে গেল, সবচেয়ে তাগড়া ছিল যেটা সেটাই গেল। লোকটা দুঃখিত ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু সে তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল। আর দুঃখ-টুঃখ দেখিয়ে বেড়ানো লোকটার অভ্যেসও ছিল না। লোকটা চলে যাবার পর চুপিসাড়ে ভুলোমনা মরা কুকুরছানাটার গায়ে হাত রাখল। মুখটা ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে আছে। শক্ত হয়ে যাচ্ছে বলে বন্ধ করা সম্ভব নয়। দাঁত চেপে চেপে হাওয়ায় বলল সে, যা যা ভাগ। এখানে ঘুর ঘুর করিস না। গিয়ে আবার জন্মাগে যা। গাড়ীর তলা থেকে বাকী ছানাগুলো দেখছিল ওদের। কেউ ভুলোমনার কাছে দৌড়ে এল না। নেচে নেচে বেড়ালো না চারপাশে । ওরাও প্রথম মৃত্যু দেখেছে। ওরা ভাবতেই পারছে না, ওদের সঙ্গে খেলা করতে করতে ওদের একজন হঠাৎ এইভাবে মরে যেতে পারে। বেশ ঘাবড়ে আছে ওরা। মা কুকুরটা আজ পাড়া বেড়াচ্ছে না। কাছেই বসে আছে। আচ্ছা,ওর কি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা
হচ্ছে? নাকি ও অন্যগুলোকে প্রোটেকশন দিচ্ছে? দেখে মনে হচ্ছে ওর সম্ভান হারানোর যন্ত্রণা হচ্ছে। ও একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছে। এরকম মানুষরাও করে। যাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, রাগ হচ্ছে ইত্যাদি সে জীবিতই হোক বা মৃত-তাকে একটু দেখেই মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ।
ভুলোমনা গামলায় দুধ ঢালল। গামলাটা গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, আয়। নড়তে চাইল না কেউ। তবুও ডেকে চলল ভুলোমনা। টুকটুক করে আসতে থাকল ছানারা। তারপর শুধু চুক চুক চুক চুক। পেটে দুধ পড়তেই ভয়টা কেমন কমে কমে যেতে লাগল, বুঝতেও পারল না ওরা। তখন আপনা আপনিই লেজগুলো নড়তে লাগল।
ছানাগুলোকে নিরাপদে গাড়ির তলার শেল্টারে পাচার করে ভুলোমনার মনে পড়ল আরও দুটো লিকপিকে ছানার কথা। মনুষ্যছানা। এই মনুষ্যছানাগুলোর পেছু পেছু তার মনে পড়ল দেবারুণের কথা। এমন একটা সুন্দর সকালে এমন বিচ্ছিরি স্মৃতি মনে আসছে কেন? নিজের মনেই ভাবল সে। যাক গে, যা মনে পড়ছে, পড়ছে। ভেতরে আটকে থাকার চেয়ে মনে পড়ে বেরিয়ে মুক্ত হয়ে যাক তারা। যত্তসব।
ছানাদের কথায় ভুলোমনা ভাবল, একবার যখন সে মিঠুয়া ছিল তখন, পাশের বাড়ির দুই যমজ মানুষছানার একজন যারপরনাই রোদন করেছিল। পুরো একদিন লাগাতার তার কান্না শোনার পর মিঠুয়া অস্থির হয়ে তাদের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে এবং তাকে কাঁধে ফেলে পিঠে ম্যাসাজ করতে থাকে। বাচ্চাটা বেশ কটা ঢেকুর তোলে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। এই ঘটনায় আপ্লুত হয়ে মিঠুয়া ফোন করে ফেলে দেবারুণকে। দেবারুণ তখন তার শ্বশুরবাড়িতে ছিল, যেখানে তার শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছিল। এতটা ভাবার পর ভুলোমনা সেই বাড়িটা যেখানে সে থাকত, সেটা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু একটা নির্জন সিঁড়ির চাতাল ছাড়া বাড়িটার আর কিছুই মনে পড়ল না ভুলোমনার। অথচ দেবারুণের সঙ্গে কথপোকথনটা যে অতক্ষণ চালাবার মতো কিছুই ছিল না সেটা বেশ মনে পড়ছে। মাঝখানে দেবারুণ একবার ফোন ছেড়ে আবার ফোন করে আরও বেশীক্ষণ কথা বলেছিল, এটাও মনে পড়ছে। কথপোকথনের মূল বিষয়বস্তু ছিল বাচ্চাটার ঢেকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়া এবং এটা পৃথিবীর কত সুন্দর ঘটনাদের অন্যতম হতে পারে এবং আরও নানাবিধ সুন্দর ঘটনার সঙ্গে এটাকে কিভাবে জোড়া দেওয়া যেতে পারে এবং কোন কোন চেনাশুনা মানুষের জীবনে এমন ঘটনা, ঘটনা হয়ে এসেছে এবং কাদের ক্ষেত্রে আসেনি এবং এই কথোপকথনের থেকে দেবারুণের সঙ্গে তার শ্বশুরের মরার সম্পর্ক কি তা কি করে বোঝা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মিঠুয়া দেখল, যে বাড়িতে একজন মারা গেছে এবং লোকজন আসা-যাওয়া করছে, সেখানে বসে কোনো কিছুতে মাথা না ঘামিয়ে কেবল আপনমনে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে চলেছে দেবারুণ।
দেবারুণের সঙ্গে আলাপটা কিভাবে হয়েছিল, এটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। প্রমিতের দৌলতে, এটা মনে পড়ছে। প্রমিত চেয়েছিল যে, মিঠুয়া দেবারুণের সঙ্গে আলাপ করুক। দেবারুণের সঙ্গে আলাপটা এবার মনে পড়ছে। প্রমিত যখন ফোন নম্বর দিয়েছিল সেটা মিঠুয়া লিখে রেখেছিল খবরের কাগজের ওপরে। তার দুদিন বাদে সে ফোন করে, মনের চিন্তাভাবনা কিভাবে শারিরীক ব্যাধি ডেকে আনে এই বিষয়ে জানতে। কারণ, দেবারুণ ছিল ডাক্তার ।
ফোনের পর কিছু টুকটাক কথা হয়। তারপর আবার কথা হবে বলে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আলাপের প্রথম কিছুদিন মনস্তত্ব এবং শারিরীক আদি ব্যাধির সঙ্গে মনের সম্পর্ক ছাড়াও দেবারুণ যে বিষয়টির বারবার উত্থাপন করেছিল, তা হল মিঠুয়াকে এটা বোঝানোর যে প্রমিত কত ভাল ছেলে, মোটেই খারাপ নয়।
প্রমিত খারাপ নয়, তো মিঠুয়া কি করবে? ব্যাপারটা বিরক্তিকর। প্রায়ই প্রমিত ড্রিঙ্ক করে ফোন করে ভুলভাল বকে কান্নাকাটি করত। এটা প্রমিতের স্বভাব। বিশ্বশুদ্ধ লোক জানত একথা যে ফোন করে প্রমিত ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে
কাঁদে । কাঁদতে কাঁদতে কি যে বলত কিচ্ছু বোঝা যেত না। বেশীরভাগটাই ইন্দ্রনাথের বদমাইশির কারণে, ও কত
অপমানিত হয়েছে, তার গানা গাইতে চেষ্টা করত। ওই সিমপ্যাথি আদায়ের ব্যাপার আর কি। মোদ্দা ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে, তার আদ্যোপ্রান্ত কিছু বোঝা যেত না। প্রমিতের ধারণা,ধারণা নয় গভীর বিশ্বাস যে ইন্দ্রনাথের মতো আপাদমস্তক ধান্দাবাজ আর একটাও হয় না। মিঠুয়ারও তাই বিশ্বাস ছিল। তবে তফাৎটা এই যে মিঠুয়া চাইত এই বিশ্বাসটা একদিন বদলে যাবে। আর তার এই চাওয়াটাকে মিঠুয়া বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।
প্রমিত কি চায় ও নিজেই জানত না। ও বেশ হড়হড় করে সব কথা বলে যেত। নিজেকে স্বচ্ছ দেখানোর চেস্টা করত । তাইতে কখনসখনও ধারণা হত লোকটা হিপোক্রিট নয়। এ হেন প্রমিতের তখন শখ হয়েছিল, মিঠুয়ার চোখে হেব্বি ভাল হবে। তাই কত ভাল ভাল লোক তাকে পাত্তা-টাত্তা দেয় এটা দেখানোর জন্য সে মিঠুয়ার সঙ্গে দেবারুণের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
দেবারুণের হয়ত মনে হয়েছিল…কে জানে কি গুষ্টির পিণ্ডি মনে হয়েছিল ! সে একদিন আমতা আমতা করে মিঠুয়াকে বলে ফেলল,-প্রমিত ততটা খারাপ নয়, মদ-টদ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য যতটা দেখতে লাগে।
মিঠুয়া বলল, ও আচ্ছা।
দেবারুণ তখন আবার বলল, প্রমিতের মনটা ভাল। মানে, বেশ ভাল। যথেষ্ট আন্তরিক ও। লোকে ওকে ভুল বোঝে।
মিঠুয়া বলল, কি আর করা যাবে। কপাল !
দেবারণ আবারও আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু আর একজন আছে,সে একদম ভাল নয়। বড়ই ধান্দাবাজ !
মিঠুয়া বলল, কে?
-সে আছে একজন। আর তার যে ফিঁয়াসে সে তাকে এতই ভালবাসে, তবুও সে সেই ফিঁয়াসেকে নিজের সুবিধের জন্য ব্যবহার করে।
-কে বলুন তো?
-সে আছে, নামটা বলা যাবে না। তাছাড়া আরও অনেক মেয়ের সঙ্গেও সে নানাধরণের যোগাযোগ রাখে।
মিঠুয়ার কেমন কেমন লাগল। সে হঠাৎ বলে ফেলল,
-ইন্দ্রনাথ? ইন্দ্রনাথের কথা বলছেন তো?
-না মানে হ্যাঁ। ওই আর কি? চেনো নাকি?
-চিনি।
এমনি কিছুদিন চলল। দেবারুণ প্রমিতের গুণগান গাইত আর মিঠুয়াকে প্রমিতের প্রতি সদয় হলে অসুবিধে কিছু নেই, এরকম কিছু বোঝানোর চেষ্টা করত। মিঠুয়া একদিন বলল, ও তো আমার বন্ধু। মানে, আমি তো ওকে বন্ধুই ভাবি।যদিও ও একটা ঘোরতর মাতাল। প্রচুর বাওয়াল বাজ। মেয়েঘটিত গন্ডগোল পাকিয়ে তাই নিয়ে নিজের মুখেই বলে বেড়ায়। আর ওর জীবনের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা,লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, ভোগান্তি, সংগ্রাম সবকিছুই যদিও বারোয়ারী, কিন্তু যখন যাকে বলে, তার মনে হয় বোধহয় শুধু আমাকেই বলছে। চ্যাংড়ার চূড়ান্ত । কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান। ও যদিও মাঝে মাঝে খুবই অসহ্য তবুও বন্ধু ভাবি বলে, তাও সহ্য করি। এছাড়া আর কিভাবে সদয় হওয়া যায় বলুন তো?
-না, বলছিলাম আর কি। ঠিক আছে।
মিঠুয়া সে যাত্রা চুপ করে গেছিল। কি ঠিক আছে আর কি যে ঠিক নেই, সে যদিও কিছুই সেদিন বুঝে উঠতে পারেনি। তখন তার একটাই কাজ ছিল, দেবারুণ বা প্রমিত ইন্দ্রনাথের সম্পর্কে কি বলে, তাই শোনা আর শুনতে শুনতে মিলিয়ে নেওয়া যে ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার যা যা মনে হয়, তাদের সঙ্গে ওদের বলা কথাগুলো কতটা মেলে। ইন্দ্রনাথ কতবড় মেয়েছেলেবাজ আর সে কত ধান্দাবাজি করে আর লিপিকে সে কত ব্যবহার করে এসব সাতকাহন তার শোনা শুরু হল। লিপির ব্যাপারে দেবারুণ আর প্রমিতের বক্তব্য অল্প এদিক-ওদিক ছিল। প্রমিতের বক্তব্য ছিল, ওরা দুজনেই দুজনকে ব্যবহার করে,নিজেকে প্রমোট করার জন্য আর দেবারুণের বন্তব্য ছিল লিপি নিঃস্বার্থ ভালবাসায় ইন্দ্রনাথের জন্য যথাসর্বস্ব করতে পারে। তবে, ইন্দ্রনাথের দিক থেকে যে
ব্যাপারটা প্রেম নয়, আসলে রিলেশন ফর কনভেনিয়েন্স এ ব্যাপারটায় সুনিশ্চিত ওরা দুজনেই।
প্রমিতের হয়ে অল্পসল্প দালালি করা ছাড়া তখন দেবারুণ আর যে কাজটা করত সেটা হল, ইন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নানাবিধ কথা বলা। ক্রমশঃ দুটোই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু দেবারুণ সুন্দর যুক্তি দিতে পারত। সব
কথা খোলসা করে বলার অভ্যেস ছিল। যুক্তিগুলো পরতে পরতে এমনভাবে সাজাত, মনে হত ঠিকই বলছে বোধহয় এবং তারপর সে যুক্তিগুলোকে ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণও করে দিত। এর থেকে মনে হত স্কুল লেভেলে
দেবারুণ নিশ্চয় ভাবসম্প্রসারণে ভাল ছিল। কিন্তু যেদিন মিঠুয়া জানতে পারল যে, দেবারুণ ভাবসম্প্রসারণে কোনোদিন ভাল নম্বর পায়নি, কারণ সে লেখা শেষ করতে পারত না, তখন খুব তাজ্জব হয়েছিল সে। লেখা শেষ করতে না পারার সঙ্গে জড়িত ছিল, কোথায় থামতে হবে না জানা থাকা।এই কথাটা চট করে বুঝে নিয়ে তখন মিঠুয়ার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে মিঠুয়ার মনে হয়েছিল, ইন্দ্রনাথ এরকম যুক্তি-বিচার বিশ্লেষণের সঙ্গে কথা বললে কত ভাল হত।
ইন্দ্রনাথের রকম ছিল এর থেকে অনেক অন্যরকম। কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে বলত, আচ্ছা, এটা নিয়ে পরে ভালো করে আলোচনা করব। সেই ‘পরে’টা কখনও আসত না। কোনোদিনও না। নেহাত বেকায়দায় পড়লে, ইন্দ্রনাথ উত্তর দিত, তুমি কিছু বোঝো না। কিচ্ছু জানো না তুমি। আরেকটা পদ্ধতি
ছিল ইন্দ্রনাথের। কোণঠাসা হয়ে গেলে সে চুপ করে যেত। তখন আর তাকে কথা বলানো যেত না। আর তখন তাকে দেখতে লাগত, একটা পাথরের দেওয়ালের মত।
মিঠুয়া দেবারুণের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলত। দেবারুণের মধ্যে একটা আপাত বিচক্ষণতা ছিল। এতখানি ভাবার পর ভুলোমনার একটা বড়সড় হাই উঠল। হাই তুলতে তুলতে সে ভাবল, ইন্দ্রনাথ আর ইন্দ্রনাথ। এই ইন্দ্রনাথের সঙ্গে যদি দেখা না-ই হত, তাহলে কি হত? মোক্ষম কিছু অভিজ্ঞতা হত না। আর ভাল হোক বা মন্দ হোক, অভিজ্ঞতা জীবনে সবসময় কাজের। তবে দেবারুণের সঙ্গে দূরাভাষে কথপোকথনের এই সময়টায় মিঠুয়ার একবার মনে হয়েছিল বটে, ইন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ না হলেই বোধহয় ভাল হত। আবেগগত কারণে আর স্বভাবের ধরণের জন্য ইন্দ্রনাথের সঙ্গে মিশতে গেলে প্রচুর স্ট্রেস তৈরি হয়।
আর দেবারুণ সবসময় সবকিছু পরিষ্কার করে বলে। বলার পর আবার তার ব্যাখ্যাও করে। এইরকম যখন ভাবনাচিন্তা চলছে, তখন একদিন দেবারুণ আমতা আমতা করে মিঠুয়াকে বলল, এদিকে আসার পরিকল্পনা কি একবছর বাদে আছে? মিঠুয়া মোটেই বুঝে উঠতে পারল না, দেবারুণ কি বলছে? সে বলল, এদিকে মানে কোথায়?
-এই এদিকে। যেদিকে আমি রোজ সন্ধ্যেয় আসি।
-ও আচ্ছা। মানে আপনার চেম্বারে?
-হ্যাঁ।
-না ওদিকে তো. আমার কোনো কাজ নেই। ভিড়-ভারাক্কার জায়গা।
-তাহলে এমনি এলেই তো হয়।
-ও.কে.। এমনিই আসব না হয়।
একটা দিন ঠিক হল। দিন ঠিক হওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল নাকি অবাঞ্ছনীয় ছিল , সে সম্পর্কে আজ আর কিছু মনে হল না। ওই সবকিছুকেই মনে হল একটা নিয়তি নির্ধারিত অভিজ্ঞতার অংশ যেন। সেই দিনটা মনে পড়ছে। খুব
ভালোভাবেই। দেবারুণের সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ সাক্ষাৎকার। মিঠুয়া চেম্বারে পৌঁছে গেছিল। যদি মিঠুয়া খুঁজে না পায় তাই দেবারুণ বাইরে দাঁড়িয়েছিল। দুজনের দেখা হয়নি। ফলে, চেম্বারে পৌঁছে দেবারুণকে না পেয়ে মিঠুয়া দেবারুণকে ফোন করে জানল সে বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে মিঠুয়া বাইরে এল এবং দেখল একজন হেঁটে আসছে। তাকে মিঠুয়ার কিছুতেই দেবারুণ বলে মেনে নিতে ইচ্ছে হয়নি। ফলে সে তাকিয়েছিল। ওরা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। আর কাকতালীয়ভাবে দুজনেই একই রঙের জামা প্যান্ট পড়েছিল। কালো শার্ট এবং অফহোয়াইট প্যান্ট।
দোবারুণের চোখে একটা শূন্যতা ছিল নাকি আসলে তার চোখে ছিল তার ভেতরে জমে থাকা হতাশাজনিত আর্তনাদগুলো ? কিছু একটা ছিল দেবারুণের চোখেমুখে। যা মোটেই ভাল লাগছিল না। তারপর ওরা দুজন চেম্বারে এসে বসল। একজন ডাক্তারের চেম্বার কি সুন্দর গল্প করার জায়গা হয়ে উঠল।
প্রথমেই দেবারুণ মিঠুয়াকে দুটো বার্থডে কার্ড দেখালো। দুটোই দেবারুণের জন্মদিনে তাকে দেওয়া দুটো মেয়ের উপহার। তারপর প্রথম প্রশ্ন হল, দেবারুণের মিঠুয়ার প্রতি,
-এদের মধ্যে কে আমার বেশী কাছের?
উত্তরটা এমন হতেই পারত, তা আমি কি করে জানব? কিন্তু তা না করে মিঠুয়া বেশ মনোযোগের সঙ্গে দেখে একটা রায় দিল। এ মনে হয় কাছের আর এ হয়ত একটু দূরের। দেবারুণ বলল,একদম ঠিক।
দেবারুণ তখন যে কাছের সে কেন কাছের আর যে দূরের সে কতটা দূরের তার বৃত্তান্ত বলতে আরম্ভ করে। যে কাছের ছিল তার যেন কি একটা নাম ছিল? কি একটা নাম? নাতাশা। আর যে দূরের ছিল তার নাম ছিল ধূর নামে কি গুষ্টির পিণ্ডি এসে যায়? তার নাম ছিল আর্তি দত্ত। সেও ছিল, লেখালেখির জগতের লোক। আর নাতাশা চাইত সিনেমার হিরোইন হতে। সমস্যা হল চাইলেই তো আর সিনেমার হিরোইন হওয়া যায় না। যেমন চাইলেই লেখক হওয়া যায় না, কবি হওয়া যায় না।
ইন্দ্রনাথ আর দেবারুণ দুজনেই যেমন ছিল কবি। ঢপের কবি নয়। ভাল কবি। তবে ওদের দুজনের কবিতার জন্ম দেওয়ার স্টাইল ছিল আলাদা আলাদা।
ইন্দ্রনাথকে কবিতার জন্ম দেবার জন্য পরিশ্রম করতে হত। আর দেবারুণ কবিতা লিখত অসাড়ে। হঠাৎ নিজের অজান্তেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কবিতা এসে ধরা দিত দেবারুণের কাছে। ভয়ঙ্কর একটা নির্মোহ ভঙ্গিতে দেবারুণ সেটাকে ধরে ফেলতে পারত। সেই অর্থে দেবারুণ ছিল জাত কবি। আর ইন্দ্রনাথ ছিল খেটে তৈরি হওয়া কবি।
মিঠুয়া দেখেছিল লেখক এবং কবিদের জগত ভীষণ সংগ্রাম পূর্ণ । শুধু জীবন দেখা এবং সেখান থেকে শিখতে শিখতে, ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে, নিজের ভেতর একটা লেখার জন্ম দেওয়ার পদ্ধতিটাই শুধু এরকম ছিল
না। তার পরবর্তী ধাপ ছিল, লেখা বা কবিতাগুলোকে পাত্রস্থ করা অর্থাৎ ছাপানোর জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়া। ওইরকম একটা ভয়াবহ কুরুচিকর পদ্ধতি বোধহয় গোটা পৃথিবীতেই বহাল আছে। প্রায় নিরুপায় হয়েই এরা সকলে সেই সিস্টেমের মধ্যে মাথা গলিয়ে ফেলেছিল। তাতে একেকজনের দশা হয়েছিল একেকরকম। যেমন, ইন্দ্রনাথ এই সিস্টেমে অবস্থান করত সরবে, সগর্বে, ঘোষণা করে। সেক্ষেত্রে মিঠুয়ার এই সিস্টেমে অবস্থানের ধরণটা অনেকটা ছিল, গিলোটিনে মাথা দিতে দিতে এপাশ-ওপাশটা দেখে নিয়ে কিভাবে বেঁচে পালানো যায়, তার ভাবনা ভাবা। দেবারুণ তিতিবিরক্ত হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। সে অপেক্ষা করত একজন মসীহার জন্য,যে কবিকুল এবং লেখককুলের একজন সর্বেসর্বা ব্যক্তি হবেন। হঠাৎ করে উদয় হয়ে যিনি ভাল কবি ও ভাল লেখক খুঁজে পেতে বার করে তাদের ঘাড় ধরে লিখিয়ে
নেবেন। লেখক এবং কবিদের নানা ভ্যানতারা,মুড, মেজাজ মর্জি, উল্টোপাল্টা ইগো এসব থাকে। সেসব ধর্তব্যের মধ্যে না ধরে বরং তাদের যাবতীয় বায়নাক্কা সম্পূর্ণ রকম সহ্য করে তিনি তাদের কাছ থেকে কাজটি
আদায় করে নেবেন। তারপর ছাপানোর এবং প্রপাগাণ্ডার যাবতীয় দায়িত্বভারও তিনিই নেবেন। দেবারুণের মত কবিরা খালি যখন তখন তাদের নানাবিধ মর্জি নিয়ে বিভিন্ন ধর্মী গোয়ার্তুমি করে যাবে আর সেইসব মর্জি-জাত অনুভব থেকে কবিতা উৎপাদন করেই খালাস হবে, এই ধরণের একটা আদর্শ ইউটোপিয়া এবং এক দেবদূতের স্বপ্ন দেখত দেবারুণ। যথারীতি বাজারে এমন একটি মনুষ্যের যারপরনাই অভাব থাকার জন্য দেবারুণের দারুণ হতাশাবোধ ছিল। হতাশাবোধ জনিত একধরণের ঘ্যানঘ্যান করাও তার স্বভাব ছিল। সেই ঘ্যানঘ্যান শোনানোর জন্য দেবারুণের কিছু বন্ধুকুলের প্রয়োজন ছিল। যাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান এবং ঘ্যানঘ্যানানির পেছনের কারণের বিশ্লেষণ যুক্তি তর্ক সহযোগে ব্যাখ্যা ও আলোচনা করে দেবারুণ তার অবসর সময় যাপন করত। সেইসব বন্ধুকুল কবি বা অকবি, লেখক বা অলেখক যাইহোক না কেন,দেবারুণের কাছে চিকিৎসা করিয়ে পয়সা দিত না।
সেদিন যেদিন দেবারুণ আর মিঠুয়ার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে দুজনেই একরঙের জামা প্যান্ট পরে থাকে, সেদিন দেবারুণ মিঠুয়াকে নাতাশা এবং আর্তি দত্তের গল্প বলতে শুরু করেছিল। আর্তি দত্ত একসময় দেবারুণের প্রেমিকা ছিল। কেন সে আর প্রেমিকা থাকেনি তার গল্প। আর যখন আর্তি দত্ত আর প্রেমিকা থাকল না, তখন ঝাড়া দু’বছর দেবারুণ ভয়ঙ্কর একা হয়ে পড়েছিল। কারণ, আর্তি দত্তের কারণে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব এনে ফেলেছিল। এইরকম শূন্যতায় ভরা একাকিত্বের দিনে নাতাশা লাফাতে লাফাতে তার জীবনে আসে। বয়সে সে ছিল দেবারুণের থেকে অনেক ছোট। ওরা দুজনে মাঠে, ঘাটে, ক্ষেতে আল ধরে ধরে হেঁটে বেড়াতে থাকে, একগাদা সময় নষ্ট করে। ইদানিং নাতাশার সঙ্গে কি যেন এক দুর্বোধ্য ঠাণ্ডা লড়াইতে ব্যস্ত আছে দেবারুণ।
বিরাট কাহিনী, প্রচুর গলিঘুঁজি, অজস্র জটিলতা। মিঠুয়া খানিক শুনল, খানিক বুঝল, কি যে মাথামুণ্ডু হচ্ছে ভাবল, তারপর নিজের আঙুলের আংটিটা এপাশ-ওপাশ ঘোরাতে ঘোরাতে চিন্তা করল, আংটিটা না পরলেই ভাল হত। হাতটা দেখতে দেখতে মনে করল, তার হাতটা আজকে যেন তার হাতের মতো দেখতে লাগছে না, ওই আংটিটার কারণে। মিঠুয়া দেবারুণকে জিজ্ঞেস করল, প্রথম দিনই আমাকে এত কিছু বলছেন কিভাবে? দেবারুণ বলল, আমি ইনস্টিঙ্কট থেকে কথা বলি। যাকে মনে হয় বলা যায় , তাকে ইন্সটিঙ্কটিভলি বলে ফেলি।মিঠুয়ার আজব আজব লাগল।
ইন্সটিঙ্কটিভলি কথা বলার মানে কি? যাইহোক, কিছু একটা হবে বোধহয়। মিঠুয়ার শুধু এটাই ভাল লাগল, যে দেবারুণ বিশ্বাস করে সব কিছু বলল। অথচ ইন্দ্রনাথ এতদিনেও তা পারল না। এখনও ইন্দ্রনাথ লিপির কথা বলে উঠতে পারেনি। অবিশ্বাস, জড়তা, ভয়, আড়ষ্টতা,কোনটা এর কারণ?
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মিঠুয়া একটা কথাই মন থেকে দেবারুণকে বলেছিল প্রেম, সম্পর্ক এসবের থেকে অনেক বড় হল বন্ধুত্ব এমন আমার ধারণা। কিছু তো থাকে না। বন্ধুত্ব থাকে। আমি একটা সহজ, সুন্দর বন্ধুত্ব চাই। দেবারুণ শুধু শুনেছিল। সম্ভবত মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের কোনমতেই আর যাইহোক বন্ধুত্ব হয়না, এরকম একটা মান্ধাতার আমলের ধারণা দেবারুণের ছিল। সেটা তখন বোঝা যায়নি। কার যে পেটে পেটে কি থাকে..
এইসময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভুলোমনা। সব অলীক। ছবি ছবি লাগে। ভেসে ভেসে আসে। এসে ভেসে চলে যায়।
নবম পর্ব সমাপ্ত
দশ
ভুলোমনা ভাবছিল জীবনটা সে কেন কাটাচ্ছে। এই যে এই মুহুর্তে সে তার বিছানায় একটা ধবধবে সাদা চাদর পেতেছে এবং সেখানে সকাল থেকে শুয়েই আছে, উঠছে না,কিছু করছে না, কিছু করবে বলে ভাবছে না। তার মনে হচ্ছে তার কিছুই করার নেই। কিছু করার কোন অর্থও নেই। জগতে একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ চলে। এই গুরুংদের বাড়িতে একটা ভীষণ ব্যাপার রোজই নিয়মমাফিক চলতে থাকে; সেটা গুরুংদের কাছে খুবই
গুরুত্বূর্ণ। সেরকম গুরত্বপূর্ণ কিছু ভুলোমনার নেই । এটা কি খুবই আশ্চর্যের নয়? বাইরে একটা বিরাট জঙ্গল-পাহাড় কাচের জানলা দিয়ে তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে অনেকক্ষণ ধরে। আর সে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না দিনগুলো সে কেন কাটাচ্ছে। দিনগুলো কি শুধু শুধু কাটানো যায় না? সবসময় কি তার কোন অর্থ থাকতেই হয়? আর অর্থ না পেলে বেঁচে থাকাটা কেন…কেন…কেন…এই প্রশ্ন কুরে কুরে খায়?‘এ জীবন লইয়া কি করিব’-এই একটা মহান প্রশ্ন সারাক্ষণ চাবকাতে থাকে?
‘এ জীবন লইয়া কি করিব’-এইরকম একটা প্রশ্ন ভুলোমনারই শুধু নয়, যখন ভুলোমনা মিঠুয়া ছিল এবং মিঠুয়া বেশ ছোট ছিল তখন থেকেই তার ছিল। তার সবসময় মনে হত আমি কে? আমি অন্য কোথাও
জন্মালেও তো পারতাম। তখন আমার পরিচয়টা অন্যরকম হত। যেখানে সে জন্মেছিল সেখানে যে সে খুব অসুখী ছিল, তা একেবারেই নয়। কিন্তু পরিচয়ের ব্যাপারটা জন্মানোর সঙ্গে জড়িয়েছিল বলেই তার এরকম মনে
হত।‘সে অন্য কোথাও জন্মালেও তো পারত’-কথাটা এমন ছিল যেন জন্মানোর আগেও সে ছিল এবং জন্মানোর ব্যাপারে তার নিজস্ব কোন চিন্তাভাবনা ছিল কি ছিল না, এ ব্যাপারে সে তেমন নিশ্চিত নয়। হতে
পারে হয়ত, নানারকম অপশনের একটা ব্যবস্থা তখন থাকলেও থাকতে পারে এবং তাকে পছন্দ করতে বলা হয়েছিল কোন জন্মটা সে বাছবে। তবে, মোটেই ব্যাপারটা এরকম নয়, কারণ তাহলে কেউই আর ভিখিরি অথবা গরিব বাবা-মায়ের কাছে জন্মানো পছন্দ করবে না আর তাহলে ভিখিরি বাবা মায়েদের পরিবার-পরিকল্পনা ছাড়াই বাচ্চা হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তবে, এই অপশনের ব্যাপারটা জন্মের আগে না-ই থাকতে পারে কিন্ত জন্মের পরে,অন্তত বোধবুদ্ধি হবার পরে থাকাই উচিত, এমন একটা কথা মিঠুয়ার মনে হত বলে মনে পড়ল ভুলোমনার।
কারণ, মিঠুয়ার বারবার মনে হয়েছিল, মিঠুয়াকে যখন অল্পবিস্তর ভাল লাগতে থাকে ইন্দ্রনাথের এবং মিঠুয়ার সঙ্গে প্রেমঘটিত কোন একধরণের আবেগের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা যায় তখন ইন্দ্রনাথের উচিত ছিল লিপির ব্যাপারটা মিঠুয়াকে জানিয়ে দেওয়া। এমন একটা বোধ মিঠুয়ার সবসময়ই ছিল যে, তাকে আসলে ঠকানো হয়েছে। ঠকানোর কারণ, হয়ত ইন্দ্রনাথের সৎ সাহসের অভাব। এই সৎসাহসের অভাব যাদের থাকে, তাদের মিঠুয়া পছন্দ করত না। কিন্তু ঠকবাজদের ভুলোমনা কিভাবে দেখে , ভুলোমনা ভাবতে চেস্টা করল । সাতপাঁচ ভেবে ভেবে ভুলোমনা দেখতে পেল, সবকিছু সম্পর্কেই তার বোধগুলো যেমন ভোঁতা,ফ্যাকাসে-ফ্যাকাসে ধরণের, এ সম্পর্কেও তেমনি। ভালমন্দ, খারাপ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি কিছুই তেমন পরিষ্কারভাবে বোধে আসে না তার।
সব ব্যাপারেই ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এইরকম একটা বোধ নিয়ে ভুলোমনা সেই মিঠুয়ার দিকে তাকাল, যখন মিঠুয়া তাকে অন্যায়ভাবে ঠকানো হয়েছে এইরকম একটা বোধে আক্রান্ত ছিল। যখন মিঠুয়া বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ক্রমাগত লিপি ও ইন্দ্রনাথের সম্পর্কের সম্পর্কে আকথা-কুকথা শুনত,তখন মিঠুয়া খুব হয়রানির মধ্যে ছিল। কিন্ত মিঠুয়ার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য ছিল এটাই যে, সে যে নিতান্তই অকারণে হয়রান হচ্ছে এটা সে বুঝতে পারত না। মিঠুয়া, লিপি এবং ইন্দ্রনাথের সম্পর্কটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে করতে নিদারুণ অবাক হত এবং কোনরকম সিদ্ধান্তে আসতে পারত না। তার কেবলই মনে হত,কোথাও একটা বড়সড় গোলমাল পাকিয়ে আছে যেটা তার জানা নেই,কিন্তু একদিন হয়ত সেটা তার কাছে উন্মোচিত হবে।
উন্মোচিত হলেই বা কি আর না হলেই বা কি ভেবে ভুলোমনা চিত হয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তার মনে হল, মিঠুয়া একটা সোজাসাপটা মানুষ ছিল, যার কাছে প্রেমটা ছিল প্রেম, বিয়েটা ছিল বিয়ে আর বন্ধুত্বটা ছিল বন্ধুত্ব। তার মাঝখানে এইসব কবি লেখক জাতীয় লোকেদের পাল্লায় পড়ে সে আরেকটা শব্দ
শিখেছিল ‘সম্পর্ক’। সেটা যে কি বস্তু, সেটা মিঠুয়ার সাদা-মাটা মাথায় ঢোকেনি। আর ভুলোমনার কাছে তার জীবনের মতোই সম্পর্ক ব্যাপারটারও কোনো অর্থ নেই। অবশ্য অনেকের কাছে হয়ত ভুলোমনার জীবনটার
একটা অর্থ আছে। তার সবকিছু মনে পড়ে যাবে, এবং সে সেরে উঠবে এই দীর্ঘ বিস্মৃতির কবল থেকে এটা তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকেই চায়। কিন্তু সবকিছু মনে পরে যাবার পর সে ঠিক কি করবে এটা ভুলোমনা কিছুতেই ভেবে পেল না।
মিঠুয়া তখন আসলে জীবন নিয়ে এক ধরণের এক্সপেরিমেন্টে জড়িয়ে পড়েছিল।আবার সে সময় তার হাতে কেন যে একটা নোয়া পরা ছিল , সেটাও যেন কেমন গোলমেলে । তখন যেসব ঘটনা ঘটত,তা থেকে সে অদ্ভুত অদ্ভূত গল্প লিখতে পারত। আর সেই গল্পগুলো তার সহ্যশক্তিকে, ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলত। ডারউইনের থিওরির সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট-এর মতো মিঠুয়ারও মনে হত, ফিটেস্ট হতে গেলে সবচেয়ে আগে দরকার সহ্যশক্তির। সহ্য করতে না পারলে, সে টিকেই থাকবে না। অতএব মিঠুয়া ফিটেস্ট হবার থেকে বেশী চেষ্টা করত সহ্যশক্তি বাড়ানোর। আর তাকে সহ্যশক্তি বাড়ানোতে সাহায্য করত তার লেখা গল্পগুলো।সহাশক্তি এবং গল্পগুলো হাত ধরাধরি করে অবস্থান করত তার দিনগুলোয়। কারণ, মিঠুয়ার মনে ততদিনে বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, তাকে ঠকানো হয়েছে। তাকে ইন্দ্রনাথ আগেই যদি বলত লিপির সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা, তাহলে হয়ত সে চিন্তাভাবনা করতে পারত ইন্দ্রনাথকে সে ভালবাসবে কি বাসবে না।ভালবাসতে বাসতে একটুখানি বেসেই সে পাততাড়ি গুটোতে পারত। কিন্তু তাকে কখনও ইন্দ্রনাথ কিছু জানায়নি এবং পরের মুখের ঝাল খেয়ে যখন সে জানতে পারে, তখন সে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এটা অন্যায়। মিঠুয়ার মনে হয়েছিল এখানে তার একটা চয়েস থাকার কথা ছিল। তাকে অপশন দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে সে ভেবে দেখত সে কি চায়। ভালবাসতে চায় নাকি সরে যেতে চায়।
তখন মিঠুয়ার সমস্যাটা অনেকটা এরকম ছিল, সে ভাবছিল, ভালবাসবার আগেভাগে পরিস্থিতি জেনে যাওয়া ভাল। তখন নিজের ইচ্ছে অনুসারে যাহোক কিছু করা যায়। কিন্তু একবার ভালবেসে ফেললে তারপর ঠকানো হয়েছে জেনে তখন কি, থাক, তাহলে আর ভালবাসার দরকার নেই বলে, ফিরে আসা যায়? ইচ্ছেমত কোথাও মন ফেলা এবং ইচ্ছেমত মনকে উঠিয়ে নেওয়া এটা মিঠুয়ার জানা ছিল না। বোধহয় মনের ওপর এতখানি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চয় শেখার ব্যাপার। ব্যাপারটা তার শেখা ছিল না। ফলে মন মনের মত চলত আর মিঠুয়া মিঠুয়ার মত।
ভুলোমনাও ভাবছিল, সে-ও কি তার মত করেই চলছে না? সে কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছে না। কোন কিছুই তার তেমন অর্থবহ মনে হচ্ছে না এবং সে শুধু দুনিয়ার এই নড়া-চড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করছে না। এমনকি যা যা সে ভুলে গেছে সেসব যে সে খুব উঠে পড়ে ভেবে মনে পড়ানোর চেষ্টা করছে তাও নয়। মনে আপনিই কিছু আসছে। যা আসছে তাকে সে মন থেকে বার করে উড়িয়ে দিচ্ছে।
স্মৃতিগুলো যেন পাখি পোষার মত। মন থেকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিলেই হল । মুক্ত হয়ে উড়ে যাবে। আর ফিরে আসবে না। সে খালি হয়ে যাবে। বস্তুত, ভুলোমনা খালি হয়ে যাবার অপেক্ষায় আছে। খালি হয়ে যাওয়া ছাড়া ভুলোমনার জীবনের আর হয়ত কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু একদিন যখন সে মিঠুয়া ছিল, তখন তার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্যটা ঠিক কেমন ছিল…কে জানে কেমন ছিল? কি একটা খুঁজছিল মিঠুয়া। খোঁজার জন্যই যা কিছু করছিল সে, যা কিছু ঘটছিল। ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটছিল, যেন পরপর সাজানো আছে। আগে থেকে সেগুলো লেখা হয়ে গেছিল আর শুধু একটার পর একটা ঘটে সেটা যে ঘটারই ছিল,এই জানকারি দেওয়া ছাড়া ঘটনাগুলোর আর কিছু করার ছিল না। সেই ঘটনাগুলোই একদিন কিভাবে মিঠুয়াকে সব
ভুলিয়ে দিয়ে ভুলোমনা বানিয়ে দিল। এখন ভুলোমনার কাজ হচ্ছে সেই খননকার্যটা করে যাওয়া, যা চাপা পড়ে যাওয়া ঘটনাগুলোকে খুঁড়ে মুক্ত করে দেবে।
সেই খননকার্যটা করতে গিয়ে আপনা থেকেই যে ঘটনাটা খসে পড়ল বিস্মৃতির খণ্ডহরের গা থেকে, সেটা হল পরিযায়ী নামে একটা নামকরা ম্যাগাজিনে তার একটা গল্প বেরোনোর পর ম্যাগাজিনটার উদ্বোধন নিয়ে।
বস্তত এই লেখালেখির জগতটা ছিল আজবরকমের খামখেয়ালিপনা আর খেয়ালিপনার খোলসের পেছনে লুকিয়ে থাকা হিংস্রতা, ঈর্ষা এবং অবাধ যৌনতার কাণ্ডকারখানায় ভরা এক অদ্ভুত জায়গা। সেখানে থাকতে গেলে ডুব সাঁতারে পটু হওয়ার দরকার ছিল। নাকে দুর্গন্ধ এলে হাসিমুখে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে কাজ চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। সেখানে হাঁসের পালক গায়ে লাগিয়ে জলে ডুবতে হত, যাতে জল থেকে
উঠেই পালক ঝেড়ে ফেললে যেমনকার তেমন শুকনো ও সাদা দেখায়।
ভুলোমনার মনে হচ্ছিল ও একটা সাদা মেঘের ওপর আরাম করে বসে আছে। সেই মেঘটা একটু একটু করে মাটির দিকে নামতে লাগল। ক্রমে মিঠুয়ার জীবনের এক জায়গায় এসে সেটা থেমে গেল। ভুলোমনা আকাশে মেঘটার ওপর বসে রইল। মেঘটা সেই ঘরটার ওপর এসে থামল। যেখানে পরিযায়ী নামে ম্যাগাজনিটার উদ্বোধন পর্ব চলছিল! ঘরটাকে নাট্যমঞ্চের স্টেজের মত দেখতে লাগছিল। সেখানে পরিষায়ীর
সম্পাদক লেখক ও কবিদের একটা একটা করে ফ্রি কপি বিতরণ করছিল। সকলেই সেখানে ভান করছিল যে সে একটা কেউকেটা। একটু আগেই সেই ঘরে ভাষণ-টাষণ দেওয়া হয়েছে। সাহিত্য মানুষের জীবনে কতটা জরুরী
এবং জরুরী মানসিক খাদ্য পরিবেশনে পরিযায়ীর সম্পাদক মহাশয় কতটা গুরু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ইত্যাদি। তারপর দীর্ঘ পুস্তক বিতরণ। মিঠুয়া পেছনে বসেছিল। তালিকায় মিঠুয়ার নাম ছিল না। পুস্তক বিতরণ
শেষ হলে মিঠুয়া উঠে দাঁড়াল এবং সবিনয় নিবেদন করল যে তার একটা বই প্রাপ্য ছিল। এইসব দেখতে দেখতে মেঘের ওপর থেকে ভুলোমনা একটা হাই তুলল। সম্পাদক অবাক হয়ে তাকালেন এবং নিমেষেই স্বীকার করলেন তার একটা ভুল হয়ে গেছে মিঠুয়ার নামটা খেয়াল করা হয়নি। মিঠুয়ার হাতে একটা বই দেওয়া হল। সেই ঘরে দেবারুণ ছিল। প্রমিত ছিল। এরপর কিছু বাছাই করা লোকের যাওয়ার কথা অনুষ্ঠানের পরবর্তী
ভেনুতে অর্থাৎ মদের আসরে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছিলেন, স্বনামধন্য লেখক ও সাহিত্যিক শশাঙ্ক সেনশর্মা। যথেষ্ট বয়স হয়েছে ওনার। সঙ্গে ওনার সমসাময়িক প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত যতীন রায়। এরা মোটামুটি হেভিওয়েট। এরপর পরই হেভিওয়েটের তালিকায় রয়েছে পরিষায়ীর সম্পাদক মানস ভৌমিক। এরা এখন
যেখানে যাচ্ছে,সেটা ছিল একটা আড্ডা সভা ।
ভুলোমনা আবার একটা হাই তুলল। মদের আসরে গিয়ে কি হবে,তার মোটামুটি মনে পড়ে গিয়েছে।আবার পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করতে তার ভাল লাগছে না। ওখানে সবাই ভীষণভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় ছিল। হেভিওয়েটরা তাদের মতো করে, জমায়েতের মধ্যমণি হয়ে এবং চুনোপুটিরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জমায়েত বেশ ভাল জমে উঠেছিল। মিঠুয়াকে প্রচুর ফুর্তিতে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। সে সমানেই প্রমিতের পেছনে লাগছিল। ভরা হাটের মাঝখানে মিঠুয়া প্রমিতের পেছনে লাগার কারণে প্রমিত খুব গর্বিত বোধ করছিল। মিঠুয়াকে চোখে চোখে রাখছিল শশাঙ্ক সেনশর্মা। প্রেমিক হিসেবে ওনার সুখ্যাতি কুখ্যাতি দুই-ই ছিল বাজারে। ওনার প্রেমের গল্প পল্লবিত হয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াত। সেসব শুনে মানুষের মনে ধারণা
জন্মেছিল শশাঙ্ক সেনশর্মা বোধহয় প্রেমের খাতিরে জীবনটাকে দানছত্র করে দিয়েছেন। কিন্ত দুঃখের বিষয় এটাই ছিল লেখক-সাহিত্যিক ও কবিরা কেউ কেউ প্রেমের ব্যাপারে শশাঙ্ক সেনশর্মা হবার স্বপ্ন দেখত,চেষ্টাও চালাত। তবে, ওই যে বলা আছে,ট্যাঁশ গরু, গরু নয়,আসলে তে পাখী সে সেরকমই যারা শশাঙ্কদা শশাঙ্কদা করে তাকে মাথায় তুলে তার পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করত, তারা কোনমতেই অরিজিনাল হয়ে উঠতে পারত না। গুচ্ছের কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে তাদের কপি ক্যাটের জীবনযাপন করতে হত। এই ব্যাপারে মিঠুয়া লক্ষ্য করেছিল, সেই যে কৌশিক বলে ছেলেটি একদিন তার যে উপকার করেছিল,সে যা বলেছিল,তা ছিল মোক্ষম। সে এদের হাঙ্গর আর কুমীর বলেছিল।
সেই মদের আসর যখন ভালই উত্তাল, তখন ইন্দ্রনাথ ফোন করে এবং সে যখন জানতে পারে, মিঠুয়া অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্যায়েতেও উপস্থিত তখন সে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়ে। সে সমানেই মিঠুয়াকে মেসেজ পাঠাতে থাকে। বিভিন্ন ধরণের মানসিক চাপ বৃদ্ধিকারী কথা বলতে থাকে। যেমন সে লিখে পাঠায়,আমার যারা ক্ষতি করতে চায়,তুমি তাদের সঙ্গে থাকবে কেন? ইত্যাদি! বক্তব্য হল, প্রমিত এবং মানস ভৌমিক এরা নাকি ইন্দ্রনাথের ক্ষতি চায়। তার নামে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কথা বলে, তাকে হেয় করে,লোকের কান ভাঙায়। এসব নাকি ক্ষতি করা। মিঠুয়া বিরক্ত হয়ে ইন্দ্রনাথকে লিখে ফেলে, রাজ্যের লোক খামোখা কেন আপনার ক্ষতি করতে চায় সারাক্ষণ? ইন্দ্রনাথ পাল্টা বিভিন্ন ইমোশনাল কথা বলে, যা সবটাই মিঠুয়া যুক্তিহীন বলে নস্যাৎ করে দেয়। সে ইন্দ্রনাথকে সাফ সাফ জানিয়ে দেয় যে বেশ করেছি এসেছি। একশোবার আসব। আপনি তো অনেক জায়গায় যান। আমাকে তো নিয়ে যাননি কোনোদিন। (সঙ্গে করে লিপিকে নিয়ে যান-এই কথাটা উহ্য রাখে মিঠুয়া)। তবে আবার এত বকবক করছেন কেন? এরপর ইন্দ্রনাথ চুপ হয়ে যায়।
এই সমস্তের পরে মিঠুয়া যে কিভাবে বাড়ি ফিরবে সেটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শশাঙ্ক সেনশর্মা খোলাখুলি প্রস্তাব দেয় যে, তুমি আমার গাড়িতে যেতে পারো। খুবই বিপজ্জনক প্রস্তাব ছিল সেটা। কিন্তু তখন না বলার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। শশাঙ্ক সেনশর্মাকে লোকের সামনে প্রত্যাখান করা মূর্খামি হত। সে অবশ্যই বদলা নিত এবং মিঠুয়াকে সাবাড় করতে তার কয়েক সেকেন্ড লাগত। অতএব মিঠুয়া রাজি হয়ে যায়।
দেবারুণ দারুণ খুশী হয় এতে। তার এমন একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে, যাকে শশাঙ্কদার মতো ব্যক্তিত্বের মনে ধরেছে ! প্রমিত অবশ্য চুপি চুপি দেবারুণকে বলে ফেলে, মিঠুয়াকে বাঘের গুহায় ছেড়ে দেওয়া হল নাকি? এইসময় মেঘের ওপর বসে ভুলোমনা বেশ মজা পায়। তার মেঘটা শশাঙ্ক সেনশর্মার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে থাকে। গাড়িতে উঠেই শশাঙ্ক সেনশর্মা মিঠুয়াকে প্রশ্ন করে, তুমি জানো যে,আমি কেমন লোক। তা সত্বেও তুমি আমার সঙ্গে চলে এলে কেন?
মিঠুয়া উত্তর দেয়, তার কারণ, আমি জানি যে, অনিচ্ছুক কাউকে আপনি জোর করে বাধ্য করবেন না। কথাটা ডাঁহা মিথ্যে কথা ছিল। শশাঙ্ক সেনশর্মার মাথায় ভূত চাপলে যথেষ্টই জোরজার করত। নিজের প্রতিপত্তিও খাটাত।
ফলে শশাঙ্ক সেনশর্মা যারপরনাই অবাক হয়ে বললেন, মানে? -মানে, এই আমি আপনার উপন্যাস কবির আত্মা পড়েছি। লোকে বলে, আপনি আপনার প্রেমিকাকে নিয়ে লিখেছিলেন।সেখানে আপনার প্রেমিকা এমন
ছিল সে পছন্দ করত না, তার সম্মতি ছাড়া কেউ তাকে ছোঁয়।
-হ্যাঁ, তবে আমি তো তাকে ছুঁতে পারতাম।
-হ্যাঁ,কিন্ত যে কেউ তাকে ছুঁতে পারত না। যে মেয়ে এইরকম, তাকে নিশ্চয় আপনি সন্মান করেন।
শশাঙ্ক সান্যাল একটু প্যাঁচে পড়ে যান। এই মেয়েটাকে তার অনেকক্ষণ ধরে ভাল লাগছে। ভাল লাগলেই তার আবার যাকে ভাল লাগছে তার শরীর স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। কিন্ত এই মেয়ে আবার ‘গাড়িতে উঠে কিসব ফ্যাকড়া বের করে নিশ্চিন্তে বসে আছে !
আমতা আমতা করে মাঝ থেকে উনি বলে ফেলেন, না,না,আমি অনিচ্ছুককে জোরজবরদস্তি করি না।
কিন্তু সমস্যা হল দামী হুইস্কির পর তার যথেষ্ট জোরজবরদস্তি করার ইচ্ছে করছিল। মোটেই ভালমানুষি দেখাতে ইচ্ছে করছিলনা। ওনার মনে হল মিঠুয়া সেটা বুঝতে পারছে । আর খামোখা জেদ ধরে বসে আছে।
এত জেদ কিসের সেই এই মেয়ের? আদেশের গলায় শশাঙ্ক সেনশর্মা বললেন, তোমার ব্যাগটা সরাও। আমি তোমার থাই-এর ওপর হাত রাখব।
মিঠুয়া দেখল, ড্রাইভার সব কথা শুনতে পাচ্ছে। তবে সে কিনা এমন অনেক দেখেছে, তাই সে মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তার পেটে বোমা মারলেও পরে তার পেট থেকে একটাও কথা বেরোবে না, এমনি তার আনুগত্য। মিঠুয়া ড্রাইভারের পদ্ধতি অবলম্বন করল। শুনতে পেয়েও সে মন দিয়ে জানলা দিয়ে রাস্তা দেখতে লাগল। বিরক্ত হয়ে শশাঙ্ক সেনশর্মা নিজেই ব্যাগটা সরাতে গেলেন। মিঠুয়ার হাত ব্যাগটাকে চেপে ধরে ছিল
বলে পারলেন না। আরও বেশী বলপ্রয়োগের ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে লাগল। তিনি মিঠুয়ার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে ধরে টেনে নিলেন। না, এটা মিঠুয়া সামলাতে পারল না। সে কিছুটা গায়ের ওপর পড়ে যেতে বাধ্য হল।শশাঙ্ক সেনশর্মা মিঠুয়ার হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিলেন। মিঠুয়া ভাবল,যাক হাতের ওপর দিয়ে যাক,যা করার। ভাবতে না ভাবতেই মিঠুয়া টের পেল এই বয়সেও শশাঙ্ক সেনশর্মার কি অপ্রতিহত প্যাশন। প্যাশনের সঙ্গে মিশ্রিত কাম এবং কামের সঙ্গে মিশ্রিত শিল্পবোধ। এই তিনটে যার মধ্যে একসঙ্গে সঠিক পরিমাণে মিশ্রিত থাকে,সে অপ্রতিহত প্রেমিক হয়। শশাঙ্ক সেনশর্মা সম্পর্কে যা শোনা যায় তা তাহলে মিথ্যে নয়, সত্যি তো বটেই, কালেদিনে তা কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়াবে। নাঃ, এইলোক বয়সে কম হলে একে বেশিক্ষণ ঠেকানো কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব হত না। হাত ধরা এবং হাতে চাপ দেওয়ার ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ লোক নারীচরিত্রে দক্ষ,যা সচরাচর পুরষেরা হয় না। বেশীরভাগ পুরুষই নারীচরিত্র নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকে। আর ওই ইন্দ্রনাথ হতচ্ছাড়াটা নারীচরিত্রকে শুধুমাত্র নিজের কাজে লাগাতে জানে আর নিজেকে মিঠুয়ার হতভাগী-মনে হল ইন্দ্রনাথের ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে পারলেও সেই ভালবাসার জায়গাটা থেকে সরে আসতে পারছে না বলে । এক ধরণের আহাম্মকি আর কি !
আপাততঃ হাতে হাত রেখে শশাঙ্কদা সুন্দর গল্প করছেন। লেখালেখি,সাহিত্য,জীবন বিষয়ক। আর মধ্যবয়সী ছেলেছোকরাগুলো যে প্রেমের নামে বিচ্ছিরি মোচ্ছব করছে, সে সম্পর্কে মিঠুয়া কিভাবে গা বাঁচিয়ে থাকবে, তাই নিয়ে কিছু সদুপদেশ দিচ্ছেন। শুনতে শুনতে মিঠুয়ার কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। মনে হচ্ছে,আহা ওনার মত একটা বিশাল পুরুষের কাছে যদি নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া যেত। তাহলে যে কি হত ! কি
যে হত ভেবে মেঘের ওপর থেকে ভুলোমনার পেটের মধ্যে হাসি ঘুরপাক খেল-ছাতার মাথা হত, গুষ্টির পিণ্ডি হত আর…আর…ওনার জন্য তেলছাড়া রান্না করে আর ওনার চোখে ওষুধ লাগিয়ে, লেখার টেবিল গুছিয়ে রেখে..জামা-কাপড় ধোপার বাড়ি দিয়ে দিন কাটাতে হত। এনারা আবার,পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা যারা হয় তাদের মাঝে মাঝে কড়া ধমক দেন। সেরকম পিলে চমকানো ধমক খেতে হত মিঠুয়াকে। এই ধরণের বিগ শটদের বউ-এরা এদের সঙ্গে পাদপ্রদীপের আলোয় থাকার স্ট্যাটাস ভোগ করে,তার বদলে অন্যত্র তাদের অনেক মাশুল গুনতে হয়। নানান বিরক্তিকর অপ্রিয় পরিস্থিতির পরও হাসি হাসি মুখে কথা বলতে হয়,আর জোরজবরদস্তি জনসমক্ষে নিজেকে উদারতার প্রতিমূর্তি বানাতে হয় আর এত কিছু করতে না পারলে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতে হয়,নয়তো মানসিক রুগী হয়ে যেতে হয়। যাক বাবা,মিঠুয়াকে এত কিছু করতে হয়নি।
মেঘের ওপর থেকে একরকম হাঁফ ছাড়ল ভুলোমনা। কিন্তু তাও যে মিঠুয়া একদিন খাপছাড়াভাবে সব ভুলে মনোরুগীই হয়ে গেল…তবে?
হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা, সেদিন কিছুক্ষণের মধ্যে দুই অসমবয়সী প্রাচীন ও নবীন লেখক আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাসের ধরণ নিয়ে এমন এক আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল,তাতে শুধু জীবনবোধের কথা ছিল, একটা জীবন কতভাবে নিংড়োলে তবে,জীবনকে ওভাবে দেখা সম্ভব হয়। শশাঙ্কদা মিঠুয়াকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে মিঠুয়ার বড় কোনো লেখায় হাত দেওয়া উচিত। উপন্যাসে। সে উপন্যাসের মানুষ,এটা তার বাক্যবিন্যাস দেখলে বোঝা যায়। এবং বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে উপন্যাস লেখার ঝুঁকি নেওয়া দরকার,সে ঝুঁকি যৌনতা সংক্রান্তই হোক অথবা বিষয়সংক্রান্ত। শশাঙ্কদা আরও বলেছিল,সে যেন লেখার জন্য কোনোদিন কোথাও কমপ্রোমাইজ না করে। এই কথার নানাবিধ অর্থ হতে পারে। মিঠুয়া সঠিক অর্থটা বুঝে নিয়েছিল এবং মনে মনে শশাঙ্ক সেনশর্মাকে হৃদয় থেকে একটা ধন্যবাদ দিয়েছিল। তখন তার এমনও মনে হয়েছিল,যে চুমুটার জন্য উনি মিঠুয়ার ঠোঁট দুটো দু-আঙুলে টিপে ধরে বলেছিলেন, এত সুন্দর কেন তুই?-তাকে সেই বাকী থাকা চুমুটা দিয়ে দেওয়া যায়। তবে
তখনই মিঠুয়ার মনে হয়েছিল তাহলে বোধহয় কমপ্রোমাইজ করা হয়ে যাবে।
এমনি একটা ঘটনাবহুল দিনের পর মিঠুয়া হাঁড়ির ভেতর রাখা কই মাছের মতো খলবল খলবল করেছিল।
ইন্দ্রনাথ গোঁসা করেছিল। সে অপমানিতও বোধ করেছিল। আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যাপারে ইন্দ্রনাথের পছন্দের পদ্ধতি ছিল চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকা,কিছুই হয়নি ভাব দেখানো,বেশী বেশী ড্রিঙ্ক করা। আর লিপির সঙ্গে নানাবিধ কাজে জড়িয়ে পড়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আর জোর করে ভাবতে চেষ্টা করা এই পৃথিবীতে আমি কত অপরিহার্য । এসব ছাড়াও কোথায় তাকে কে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে,সেটা নিয়ে বেশী উৎফুল্ল হওয়া ইত্যাদি।
মিঠুয়া এই সবই জানত। তবুও সে বারবার একই ভুল করত। একই ভুল। সে এই সাময়িক বিচ্ছেদে কাতর হয়ে পড়ত। ফলে কয়েকদিন বাদে সে একদিন ফোন করল। কিসব হাবিজাবি কথার ওপর জরুরী কথার মুখোশ চাপিয়ে বলল। ইন্দ্রনাথ বলল, তুমি আমাকে অপমান করেছো।
মিঠুয়া বলল,না,আমি যা সত্যি তাই বলেছি।
-কিন্তু তুমি বিলো দ্য বেল্ট হিট করেছো।
-তা হতে পারে।
ব্যস,সব মিটে গেল।
দশম পর্ব সমাপ্ত
এই পর্বদুটি অন্যরকম। নতুন কিছু চরিত্র। ধুলোজমা অন্ধকার কিছু কোণা।
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
সেনশর্মা সান্যাল হয়ে গেছেন একটি লাইনে । এডিট করে দিতে হবে।