জর্জ স্টাইনার-এর ১৫টি কবিতা
অনুবাদ ও ভূমিকা- হিন্দোল ভট্টাচার্য
আধুনিক জার্মান সাহিত্যের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব জর্জ স্টাইনার। মূলত ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। কবিতা সংখ্যায় কম লিখলেও, তাঁর কবিতা আধুনিক জার্মান কবিতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে, যত দিন যাচ্ছে জর্জ স্টাইনারের কবিতা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের মধ্যে উৎসাহ তত বাড়ছে। ১৯৩০ সালে সুইৎজরল্যন্ডে জন্ম। ঘুরেছেন সারা বিশ্ব। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ডার স্কোয়ার্জে কাস্টেন প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন সিরিজ, ফিল্মের স্ক্রিপ্ট, নাটক লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, গ্রেঞ্জেন গাব। তাঁর কবিতা কাঠামোয়, বক্তব্যে এবং ভাষায় এক স্বতন্ত্র ঘরানার।
বৃষ্টির ভিতর
রাস্তায় লোকজন খুব তাড়ায় আছে,
রাস্তায় এখন ঝাপসা বৃষ্টি
লোকজন খুব তাড়ায় থাকে, যখন এমন বৃষ্টি নামে
ঘরের ভিতরে যারা থাকে, তাদের হাতে সময় থাকে
ঘরের ভিতর থাকে উষ্ণতা
মানুষের সময় থাকে হাতে, যখন তারা ঘরের ভিতর থাকে
ঘরের ভিতরের মানুষেরা
রাস্তার লোকজন দেখে।
ধীরে। যখন বৃষ্টি নামল…
জীবনপঞ্জি
মানুষ চায় একটা সুন্দর জীবন কাটাতে
টিভি দেখে আর গাড়ি চালিয়ে
একটা বাড়ি আর কিছুটা সবুজ বাগানে
মানুষ সাহায্য করতে চায় একে অপরকে
চায় অন্ধকে রাস্তা পার করে দিতে, যখন
এক অন্ধ মানুষ রাস্তা পার হতে চায়
মানুষ চায় অন্যরা তাদের নিয়ে কথা বলুক
প্রশংসা করুক
যন্ত্রণাবিহীন একটা জীবন কাটাতে চায় দীর্ঘদিন ধরে
আর মৃত্যুর আগে
একটু অমরতাও প্রার্থনা করে।
হিরোশিমা
স্কুলে বাচ্চারা একটা গল্প শুনল
তারা শুনল হিরোশিমার গল্প
হিরোশিমা মানে ইংল্যন্ডের একটা গ্রাম।
কেল্টদের তৈরি করা একটা গ্রাম হিরোশিমা
সেখানে কোনওকিছুই ভাল না
হিরোশিমার চাষিরা খুব একটা সুখে থাকে না।
হিরোশিমার শিল্প চাই,
বাচ্চারা সকলে গলা মিলিয়ে পড়ে
শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে একটিমাত্র শব্দ লেখে তখন।
তারা আগামীকাল নিয়ে পাড়ি দেবে
তারা সূর্যের জন্য পাড়ি দিচ্ছে না
পাড়ি দিচ্ছে চাঁদের জন্য
তারা কেন চাঁদের জন্য পাড়ি দিচ্ছে ?
কারণ সূর্যের নীচে আর নতুন কিছু নেই।
তারা যদি চাঁদের জন্য পাড়ি দেয়
তারা সূর্যের জন্য পাড়ি দেবে না
তারা যদি চাঁদ থেকে আর কোনও দিন
ফিরে না আসে
তাহলেই সূর্যের নীচে নতুন কিছু হবে আবার
তারা আগামীকাল নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে
আবেগ
জল যত বরফই হোক, সে আসলে প্রবাহ চায়
প্রবাহ যত দিক বদলাক, সে আসলে জল চায়
তৃষ্ণা সকলের পায়, এমনকি জলেরও
এমনকি বরফও তৃষ্ণায় নিজেকে গলিয়ে ফেলে বারবার
মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি বলতে পারব না
আমি বাঁচতে চাইনি
আত্মহত্যা
সে বাঁচতে চেয়েছিল বলেই উড়িয়ে দিয়েছিল সব পাতা
সে আগুন হতে চেয়েছিল বলেই উড়িয়ে দিয়েছিল দুঃখ
মানুষের খিদে কমল না এতে
মানুষের রাগ কমল না এতে
তোমার মৃত্যুর জন্য পৃথিবী থেকে যুদ্ধ মুছে যাবে না
এ কথা ভাবতে ভাবতেই সে
বাঁচতে চেয়েছিল বলেই বেছে নিল সীসার বুলেট
রাত্রির নরক
কারা যেন শহর দাপিয়ে চলে যায়
হিংসার ঝড় ওঠে
হিংসা দাপিয়ে চলে যায় শহরের এ মাথা
ও মাথা
মাথায় যেন ভেঙে পড়ে হিরোশিমার আকাশ
যেন গ্যাসচেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে সমস্ত মৃতদেহ
কারা যেন বলে, সব লেখা হয়ে চলেছে ঈশ্বর
একদিন শয়তান জবাব চাইবে
প্রেমের কবিতা
তোমাকে ভালবাসব বলে জন্ম নিয়েছিলাম
তোমাকে ভালবাসব বলে মরে যাচ্ছি
কবর
আমার উপন্যাসের সব চরিত্র মৃত
তারা আমাকে নিয়ে মজা করবে বলে
গাছ হয়ে গেছে
আর শীতকালে
আমি তাদের কাছে প্রার্থনা করছি
পাতা হও, ফুল হও, ভাষা হও আবার
শান্তি
নীরবতার সামনে বসে আছেন রাইনার মারিয়া রিলকে
আমি তাঁর জন্য একটি ডায়েরির পাতা বাড়িয়ে রেখেছি
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছেন স্বয়ং গ্যয়টে
আমি তাঁর জন্য মহাকাব্য পেতে বসে আছি
ফাঁকা শূন্য খাতার পাতাগুলি যে কোনও দিন
আমার গলা টিপে ধরতে পারে
এ কথা বলতেই, মনে ঘুম নেমে এল
চোখদুটো জেগে রইল
যেমন জেগে থাকে অভিশাপগ্রস্ত মৃতদেহ
আকাশ দেখবে বলে
গোধূলি
যে ধোঁয়া উড়ছে, তাকে বিকেল ভেব না
মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে
মানুষ ঘর খুঁজে পাচ্ছে না
খাবার নেই, ভালবাসা নেই, যৌনতা নেই
যে ধোঁয়া উড়ছে তাকে কাহিনি ভেব না
এভাবে উপন্যাস হয় না
গল্প হয় না
তোমার বাড়ির সোফাসেট হতে পারে
আমি আর গান গাইতে পারি না বন্ধু
মানুষের দুঃখ নিয়ে
কান্না নিয়ে
আমার দুচোখ
পাথর হয়ে গেছে
এপিটাফ
ঘন ঘন মরে গেলেই তুমি বেঁচে উঠতে পারবে না
বরং বেঁচে থাক
কুয়াশা সরিয়ে
যতক্ষণ না মৃত্যুর সামনে
তুমি বলতে পার,- হে মৃত্যু, তুমি মৃত,-
জীবনের মানেই বোঝনি!
শীত
যে পাতা ঝরে যায়
তার নাম শীত
যে পাতা ঝরিয়ে দেয়
তার নাম যুদ্ধ
তুমি হিটলার বলেও সম্বোধন করতে পার
প্রস্তাবনা
বরং, আমাদের নিয়ে কবিতা লিখুক অন্যেরা
যারা কবিতা লেখেনি কখনও
খিদে আর ঠান্ডায় যাদের ফুসফুস ঝরে গেছে
আমরা বরং ওদের জন্য কাঠকুটো জড়ো করি
পুরনো কোট, বর্ষাতি আর মাফলার নিয়ে আসি
সোয়েটার বুনি
নিজেদের শরীরের মাংস কেটে খাওয়াই ওদের
বরং আমাদের নিয়ে কবিতা লিখুক অন্যেরা
যতদিন কবিতা লেখা যায়