চতুরঙ্গ’ ও রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা
রাহুল দাশগুপ্ত
"শ্রীবিলাসের কথা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই শুধুমাত্র চরিত্র নয়, প্রকৃতপক্ষে একেকটা ‘আইডিয়া। ‘চোখের বালি’তে বিহারী ছিল সেই নায়ক, প্রেমের অবিরাম ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যাত্রা করে যে প্রেমের সত্যের কাছে পৌছতে চেয়েছিল। গোরা' উপন্যাসে গোরা দেশের অবিরাম মিথ্যার মধ্য দিয়ে যাত্রা করে শেষ পর্যন্ত দেশের সত্যকে উপলব্ধি করেছিল। ঘরে বাইরে' উপন্যাসে নিখিলেশ যেন সেই মিলনবিন্দু, যেখানে বিহারী এবং গোরার পরিণতি ও তাৎপর্যের চূড়ান্ত অবস্থাটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। গোরা সত্য ভারতবর্ষের খোঁজ পেয়েছিল, নিখিলেশ সেই সত্য ভারতবর্ষ কীভাবে গড়ে উঠবে, তারই যেন পথ খোঁজে। আর এই খোঁজকে সার্থকতা দেয় তার হৃদয়ে খাঁটি প্রেমের উপস্থিতি, যেখানে কোনওরকম বিভ্রান্তি ও মোহকে প্রশ্রয় দিতে সে নারাজ।" রবিপক্ষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুরঙ্গ উপন্যাস নিয়ে লিখলেন রাহুল দাশগুপ্ত।
রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য প্যারাবল ‘চতুরঙ্গ’ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। ওই একই বছর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের আরও একটি অতুলনীয় কীর্তি ‘ঘরে বাইরে। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজ পত্র পত্রিকায় যথাক্রমে ১৯১৪ ও ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এই দু’টি উপন্যাস। এই ঘটনা উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, ‘চোখের বালি’ থেকে প্রকৃতপক্ষে যে মহৎ টেট্রালজির সূত্রপাত, ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ হয়ে “চতুরঙ্গ’-কে তার সার্থক উপসংহার বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের এই চারটি উপন্যাসকে টেট্রালজি হিসাবে একসূত্রে গাঁথায় অনেকেই অবাক হতে পারেন। বিশেষ করে, বিষয়গত দিক থেকে এই চারটির মধ্যে যখন কোনও বাহ্যিক সাদৃশ্য নেই। কিন্তু সত্যিই কী নেই? আর ভাবগত দিক দিয়ে? রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের যাবতীয় চিন্তাভাবনা মুলত যে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত ছিল, তা হলো, প্রেম, দেশ এবং ঈশ্বর। চোখের বালি’-তে প্রেমই মূল বিষয়। গোরা’ উপন্যাসে মুখ্য হয়ে উঠেছে দেশ। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে প্রেম ও দেশ একাকার হয়ে গেছে। আর ঈশ্বর-চিন্তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটেছে ‘চতুরঙ্গ’য়। ‘চোখের বালি’ থেকে ‘চতুরঙ্গ’-এক আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দর্শনভাবনার এক মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্সকে এক অপরূপ স্থাপত্যের মতোই তৈরি করে রেখে যেতে চেয়েছেন।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে শচীশ। যদিও উপন্যাসটি চারটি অংশে বিভক্ত, তবু এই চারটি অংশেরই কেন্দ্রে রয়েছে শচীশ। এই চারটি অংশ এইরকম, ‘জ্যাঠামশাই’, ‘শচীশ’, ‘দামিনী’ ও ‘শ্রীবিলাস’। এইভাবে চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে শচীশকেই বুঝতে চাওয়া হয়েছে। শচীশ নিছক কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়। দস্তয়েভস্কি বা কাফকার উপন্যাসের নায়কদের মতোই শচীশ আসলে একটি রূপক। একটি যাত্রার রূপক। এই যাত্রা কোনও ব্যক্তির নয়, বরং বলা যায় একটি আত্মার। এই আত্মাটি খুঁজে চলে ঈশ্বরকে। ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝতে চায়। আর দান্তের নায়কের মতোই একের পর এক স্তর অতিক্রম করে ক্রমে ক্রমে সে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে থাকে। শ্রীবিলাসের কথা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই শুধুমাত্র চরিত্র নয়, প্রকৃতপক্ষে একেকটা ‘আইডিয়া। ‘চোখের বালি’তে বিহারী ছিল সেই নায়ক, প্রেমের অবিরাম ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যাত্রা করে যে প্রেমের সত্যের কাছে পৌছতে চেয়েছিল। গোরা’ উপন্যাসে গোরা দেশের অবিরাম মিথ্যার মধ্য দিয়ে যাত্রা করে শেষ পর্যন্ত দেশের সত্যকে উপলব্ধি করেছিল। ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ যেন সেই মিলনবিন্দু, যেখানে বিহারী এবং গোরার পরিণতি ও তাৎপর্যের চূড়ান্ত অবস্থাটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। গোরা সত্য ভারতবর্ষের খোঁজ পেয়েছিল, নিখিলেশ সেই সত্য ভারতবর্ষ কীভাবে গড়ে উঠবে, তারই যেন পথ খোঁজে। আর এই খোঁজকে সার্থকতা দেয় তার হৃদয়ে খাঁটি প্রেমের উপস্থিতি, যেখানে কোনওরকম বিভ্রান্তি ও মোহকে প্রশ্রয় দিতে সে নারাজ।
বিহারী, গোরা এবং নিখিলেশের মতোই শচীশও রবীন্দ্রনাথের আরও এক প্রতীক-নায়ক, একই ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত ফসল, এক অবিরাম দার্শনিক খোঁজের অন্তিম উন্মােচন। চোখের বালি’তে ছিল মূলত ব্যক্তিগত সঙ্কট, ‘গোরা’য় ছিল সমষ্টির সঙ্কট, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে ব্যক্তি ও সমষ্টির সঙ্কট মিলেমিশে গেছে। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে
রবীন্দ্রনাথ আবার ফিরে এসেছেন ব্যক্তিগত সঙ্কটে। যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে চেয়েছেন তিনি। প্রেম থেকে শুরু করে দেশকে স্পর্শ করে তিনি ঈশ্বরে পৌঁছতে চেয়েছেন। একের পর এক প্রতীক-নায়ক সৃষ্টি করে একটু একটু করে তিনি এগোতে চেয়েছেন, অভিযাত্রার মানচিত্রটিকে স্পষ্টতা দিতে চেয়েছেন।
শচীশের যেমন একটা নিজস্ব যাত্রা আছে, তেমনই বিহারী থেকে যে যাত্রার সূত্রপাত, তার সেই যাত্রা যেন হয়ে উঠেছে সে-ই যাত্রারও উপসংহার। আবার শচীশ তার পূর্বসূরি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য প্রতীক-নায়কদের মতোই, তার দেশ ও সময়ের প্রেক্ষাপটে বড় বেশি নিঃসঙ্গ। তাদের মতোই তার উদ্যম ও কর্মতৎপরতা বড় বেশি দুর্বোধ্য। নিষ্ঠা ও সততা যেন বড় বেশি অসঙ্গত। আর এই কারণেই তার নিঃসঙ্গতা ও দুর্বোধ্যতা এত বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ বিহারী থেকে শচীশ-সবারই প্রতীক হয়ে ওঠার মধ্যে, সাংকেতিকতার মধ্যে সার্বজনীন যে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক রূপকটি লুকিয়ে আছে, তাদের সহজে শনাক্ত করা যায় না! ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে শচীশের চলার পথে একইসঙ্গে বন্ধন ও বাঁধা জুটতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য প্রতীক। নায়কদের মতোই প্রথম থেকেই সে আলাদা। শ্রীবিলাসের ভাষায়, “যাহারা দশের মতো, বিনা কারণে দশের সঙ্গে তাহাদের বিরোধ বাধে না। কিন্তু মানুষের ভিতরকার দীপ্যমান সত্যপুরুষটি স্থূলতা ভেদ করিয়া যখন দেখা দেয় তখন অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে পূজা করে, আবার অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে অপমান করিয়া থাকে। শচীশ কিন্তু কোনও নিন্দাকেই পাত্তা দেয় না। সে জানে, যারা নিন্দা করে তারা নিন্দা ভালোবাসে বলেই করে, সত্যকে ভালোবাসে বলে নয়। জীবনের প্রথম পর্বে শচীশের ওপর জ্যাঠামশাই জগমোহনের প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। তখন সে ঘোরতর নাস্তিক। এই জ্যাঠামশাই ঈশ্বরে অবিশ্বাস করতেন বললে কম বলা হয়, ইনি নাঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। শুধু ঈশ্বরই নয়, কোনও ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকেই তিনি মানতেন না। কারও কাছে বশ্যতা স্বীকার করা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। এই দিক থেকে দেখলে, তিনি ছিলেন ভাই হরিমোহনের সম্পূর্ণ বিপরীত। হরিমোহনের মধ্য দিয়ে সুযোগসন্ধানী, মতলববাজ, ভীরু, মেরুদণ্ডহীন মধ্যবিত্ত বাঙালি জাতির চরিত্র-বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে।
জগমোহন শচীশকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতেন এবং শচীশও হয়ে উঠেছিল তার মন্ত্রশিষ্য। শচীশকে তিনি শিখিয়েছিলেন, গুরুজনকে ভক্তি করাটা একটা বঁটা সংস্কার। এই ব্যাপারটা মানুষের মনকে গোলামিতে পাকা করে দেয়। শচীশের সঙ্গে তিনি সমবয়সীর মতো মিশতেন এবং তার সঙ্গে সবরকম আলোচনা করতেন। অনেক রকম নিজস্ব ও মৌলিক ধ্যানধারণা ছিল তাঁর। তিনি মনে করতেন, বোলতার বাসা ভাঙলে তবেই যেমন বোলতা তাড়ানো যায়, তেমনই মানুষের মনের লজ্জার বাসাটাকে ভাঙলে তবেই লজ্জার কারণটাকে খেদানো যায়। অথবা, কলেজে বাঙালি ছেলেকে সাহিত্য পড়ানো মানে শিক্ষকতার কুলিমজুরি করা।।
জগমোহনের নাস্তিকধর্মের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল লোকের ভালো করা। আর তিনি তা এটা জেনেই করতেন যে, এতে কোনও পুরস্কার জোটার সম্ভাবনা নেই, নিজের লোকসান ছাড়া এতে আর কিছুই নেই! মোপাসাঁর একটি চরিত্র যেমন বলে, “তুমি যদি নিজের কাজ করো তাহলে নিশ্চয়ই তাতে আনন্দ আছে, তার একটা অর্থ আছে। কিন্তু যদি পরের জন্য কাজ করো তাহলে তার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। শুধু সময় নষ্ট, আর তাতে পাবে শুধু অকৃতজ্ঞতা। পরোপকারের এই স্বভাবের জন্যই জগমোহন শচীশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। শচীশের না আছে। অর্থ, না আছে একটা পোক্ত ঠাই, কিন্তু জগমোহনের রয়েছে লাইব্রেরি। সন্তান-সম্ভাবনা, বিধবা ননিবালাকে নিজের
লাইব্রেরিতে সে ঠাই দেয়। জানা যায়, সেই লাইব্রেরির বেশিরভাগ বই ততোদিনে অর্থের অভাবে একটু একটু করে বিক্রি করে দিয়েছেন জগমোহন।।
জগমোহনের স্বভাবের নানা দিক ততোদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোনও গোঁড়ামি নেই তাঁর মনে। তার মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে ‘দেশ’। তার জীবনের ব্রত, যেভাবেই হোক সমাজের ডাকাতিকে প্রাণ দিয়ে ঠেকাতে হবে। সবরকম গোলামির জাল কেটে দেশের মানুষের মনটাকে মুক্ত করতে হবে। এইজন্যই মুসলমানদের নিয়ে তিনি ভোজের আয়োজন করেন। পুলিসের অন্যায়-অত্যাচার ঠেকাতে প্রয়োজনে জেলে যেতেও ভয় পান না। ননিবালার লজ্জাকে তিনি নিজের লজ্জা বলেই ঘোষণা করেন। যে সমাজ একটি মেয়েকে এইভাবে বিপন্ন ও অসহায় করে তোলে, সেই সমাজের একজন হিসাবে নিজের দায়িত্বকে তিনি অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করে নেন। মেয়ে নয়, ‘বিধবা মেয়ে হিসাবেও নয়, ননিবালাও এই প্রথম নিজেকে মানুষ হিসাবে দেখতে শুরু করে। ক্রমে জানা যায়, ননিবালার এই দুর্ভাগ্যের পিছনে যে পুরুষটি রয়েছে সে আর কেউ নয়, শচীশেরই দাদা পুরন্দর। পুরন্দরের উৎপাত বেড়েই চলে এবং জগমোহনের উৎসাহেই শচীশ পরিত্রাতা হয়ে উঠতে চায়, সমাজের চোখে ‘পতিতা’ ননিবালাকে বিয়ে করে তাকে উপযুক্ত সম্মান দেখাতে চায়। তারা বুঝতে পারে, এই সমাজে মেয়েটির সর্বনাশ করতে অনেক পুরুষই প্রস্তুত, কিন্তু রক্ষা করার বেলায় কেউ নেই। কিন্তু ননিবালা এই অনুগ্রহ অস্বীকার করে, সে আত্মহত্যা করেই শেষপর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করে। এভাবেই জগমোহন ও শচীশের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় একটি মেয়ের জীবনের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি।
পরোপকার করতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত জগমোহনের মৃত্যু হয়। প্লেগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালগুলির ভয়াবহ অবস্থা দেখে জগমোহন নিজের বাড়িতেই প্রাইভেট হাসপাতাল বসান। শেষপর্যন্ত একজন মুসলমান রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজেও আক্রান্ত হন এবং মারা যান। এই মৃত্যু শচীশকে তার জীবনের প্রথম বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে যায়। শচীশ তার জ্যাঠামশাইয়ের মতো নাস্তিক হতে চেয়েছিল। নাস্তিকতাই ছিল তার জীবনের প্রথম পর্ব। এবার শুরু হয়, তার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। জগমোহন বলতেন, সংসার মানুষকে বাজিয়ে দেখে, শোক, ক্ষতি, মুক্তির লোভ, নানা আঘাতে জর্জরিত করে দেখে। যারা মেকি টাকার মতো, আবর্জনা, জীবনের কারবারে অচল, গাছের শরীর থেকে শুকনো পাতার মতোই তারা ঝরে যায়। টিকে থাকে তারাই, যারা খাঁটি, শোকদুঃখ-ক্ষতি-লোভ, কোনওকিছুই যাদের বিচলিত করতে পারে না। জগমোহনের মৃত্যু শচীশের জীবনের প্রথম পরীক্ষা হয়ে এলো। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে শচীশ হয়ে উঠল ঘোর আস্তিক, লীলানন্দস্বামীর প্রধান চ্যালা। শ্রীবিলাসের মনে প্রশ্ন জাগলো, শচীশ কী তবে জীবনের প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করে গেল? জীবনের কারবারে অচল, মেকি টাকা হিসাবে প্রতিপন্ন হলো?
গোরা যেভাবে বারবার আত্ম-প্রতারণার শিকার হয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে, তার সঙ্গে শচীশের এই একের পর এক বিভ্রান্তির তুলনা করা যায়। সেই দিক থেকে বিহারী ও নিখিলেশ আবার একরকম, তারা সবসময়ই খাঁটি ও স্থিতপ্রজ্ঞ, কোনও বিভ্রান্তিই তাদের টলাতে পারে না। দ্বিতীয় পর্বে শচীশকে দেখে, বিশেষ করে তার লীলানন্দস্বামীর পা টেপার ও তার জন্য তামাক সাজিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখে এই সংশয় হতেই পারে, গোরার মতোই শচীশ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আত্ম-প্রতারণা করে চলেছে। কিন্তু যে মানুষ অবিরাম খুঁজে চলে, আত্মানুসন্ধান করে চলে, তাকে বারবার ভুলের ফাঁদে পা দিতেই হয়। ভুল করতে করতেই সে ঠিকটাকে চিনতে শেখে। জ্যাঠামশাই শচীশকে কোথাও পৌঁছে দিতে পারেন না। সুখস্মৃতি ও নাস্তিকতার বন্ধন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেন না।
শচীশ এবার তাই ঠিক উল্টোদিক থেকে সন্ধান শুরু করে। এতদিন সে ঈশ্বরকে নির্বিচারে অস্বীকার করে এসেছে। এখন সে অন্ধের মতোই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সন্ধানের এই বিপরীত অভিমুখ দেখে শ্রীবিলাসের মতো যে কেউ বিভ্রান্ত ও প্রশ্নাকুল হতেই পারে। গোরাকে যেমন বহু সময় পর্যন্ত ভ্রান্ত, গোড়া, সংস্কারাচ্ছন্ন ও আবেগসর্বস্ব বলে মনে হয়, যদিও তাঁর খাঁটি আত্মা ও ঋজু, আপোশহীন, সহৃদয় ব্যক্তিত্বটিকে অনায়াসে চেনা যায়, শচীশকেও ঠিক তেমনই মনে হয়। সে খাটি ও ঋজু, কিন্তু তার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয়, আচ্ছন্ন, মরিয়া হয়ে যেন সে খুঁজে চলেছে, ঠিক গোরার মতোই।
শ্রীবিলাস তাই শচীশকে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘এ কী বন্ধনে নিজেকে জড়াইলে? এই লীলানন্দস্বামীর সূত্রেই শচীশ ও শ্রীবিলাসের সঙ্গে আলাপ হলো দামিনীর। যৌবন ও যৌনতায় পরিপূর্ণ এক নারী, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের নারী-চরিত্রেরা হয়। লেখকের বর্ণনায়, ‘বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে। বিনোদিনী, সুচরিতা, বিমলা-প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বোধহয় এই কথাগুলি প্রযোজ্য। এই দামিনী এক হতভাগ্য নারী। তাঁর স্বামী তার ওপর ভক্তির দস্যুবৃত্তি চালিয়ে গেছে। যখন দামিনীর বাপ এবং ছোটো ছোটো ভাইরা উপবাসে মরতে বসেছে, সেই সময় দামিনীর স্বামী শিবতোষ নিজের সমস্ত অর্থ ও সম্পত্তি বিলিয়ে গেছে লীলানন্দস্বামীর পায়ে। যতো সে দামিনীকে ভক্তিহীনতার দণ্ড দিয়েছে, ততো দামিনীর ক্ষোভ ও ঘৃণা বেড়ে গেছে ওই সন্ন্যাসীর প্রতি। | খুব স্বাভাবিকভাবেই দামিনী আকৃষ্ট হয় শচীশের প্রতি। কিন্তু লীলানন্দস্বামীর প্রতি শচীশের এই ভক্তিকে সন্দেহ করে সে। যেন সে অনুভব করে, এই ভক্তির মধ্যে কোনও একটা ভুলবোঝাবুঝি আছে। তাই লীলানন্দস্বামীর ধ্যানমূর্তির যে ফোটোগ্রাফটি শচীশের ঘরে ছিল, সেটা অনায়াসে ভেঙে দিয়ে যায় সে। কখনও কখনও তার সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়। এরকমই এক মুহূর্তে দামিনীকে আবিষ্কার করে শচীশ, যখন সে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলতে থাকে, ‘ওগো পাথর, ওগো পাথর, দয়া করো, দয়া করো, আমাকে মারিয়া ফেলো। গুহার ভেতর দামিনী নিদ্রাচ্ছন্ন শচীশের কাছে যায়, যৌনতা অমোঘ হয়ে ওঠে, দেহমিলনের তীব্র কামনায় তাড়িত হয়ে সে যায়। কিন্তু ফিরে আসে অচেতন শচীশের পদাঘাত আর চাপা কান্নাকে বহন করে। এক অসামান্য নারী হয়েও দামিনী তার শরীর ও মনের প্রাপ্য স্বীকৃতি পায় না, ঠিক বিনোদিনীর মতোই!
দামিনীই ছিল শচীশের কাছে তৃতীয় বন্ধন। শচীশের জীবনের প্রথম বন্ধনটি ছিল, জ্যাঠামশাই। দ্বিতীয় বন্ধনটি, লীলানন্দস্বামী। আর তৃতীয় বন্ধন, দামিনী। জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে শচীশ পেয়েছিল, নাস্তিকতা। লীলানন্দস্বামীর কাছ থেকে সে পেল, আস্তিকতা। এবং দামিনীর কাছে সে পেল, প্রেম। আর কী অসামান্যই না ছিল সেই প্রেম! এ প্রসঙ্গে শ্রীবিলাসের ভাষ্য এইরকমঃ ‘যেখানে মেয়েরা দুঃখ পাইবে সেইখানেই তারা হৃদয় দিতে প্রস্তুত। তাই তারা বরণমালা গাঁথে একজন পশুর জন্য। অথবা এমন কোনও পুরুষের জন্য যে ভাবে বিভোর, যার তাদের দিকে কোনও লক্ষই নেই। শচীশ কিন্তু দামিনীকে মনে মনে ভয় পেতে শুরু করেছিল। আর এটা ঘটেছিল দুটো কারণে। দামিনী ইচ্ছা করেই শ্রীবিলাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলছিল। আর বাইরে ঔদাসিন্য দেখালেও শচীশ ভেতরে ভেতরে ঈর্ষা বোধ করছিল। আর এই ঈর্ষাই যেন তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দামিনীর প্রেমকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। এই ঘনিষ্ঠতা প্রকৃতপক্ষে তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। শচীশ তাই দামিনীকে তাদের মধ্য থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এলে, শ্রীবিলাস মোটেই সম্মত হয়নি। সে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়, “আমাদের সমস্যা এ নয় যে, স্রোতটাকে কী করিয়া বাদ দিব। সমস্যা এই যে, তরী কী
হইলে ডুবিবে না, চলিবে। সেইজন্যই হালের দরকার। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় শচীশ। জ্যাঠামশাইয়ের কাছে সে নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করেছিল। একই ব্যাপার ঘটে লীলানন্দস্বামীর ক্ষেত্রেও। সমর্পণ করাই শচীশের স্বভাব। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জলের গভীরতাকে মেপে নেওয়াই তার প্রকৃতি। কিন্তু অবিশ্বাস ও ভক্তির কাছে সমর্পণ করা যত সহজ, প্রেমের কাছে, নারীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ততো সহজ নয়। নিজেকে সমর্পণ করতে না পেরেই শচীশ প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু শ্রীবিলাস সেই প্রত্যাখ্যানের পথটিকেও বন্ধ করে দিল।
অতএব শচীশকে আবারও উল্টোদিক দিকে ভাবতে হল। দামিনীকে সে দামিনীর দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করার চেষ্টা শুরু করল। এবং সরাসরি তার কাছে জানতে চাইল, ভক্তি নেই, তবু কেন সে ভক্তদের মধ্যে পড়ে আছে? দামিনী যখন জবাবে বলল, ভক্তিহীনা হয়েও তাকে ভক্তির গারদে পায়ে বেড়ি দিয়ে রাখা হয়েছে এবং তারপর দৃঢ়চিত্তে জানিয়ে দিল, এই বেড়িই সে বহন করে চলবে এবং এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাবে না, তখনই শচীশ যেন সেই প্রথম এক নারীহৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিক্ষুব্ধ আত্মার স্পর্শ পেল। তাকে তাড়িত করতে শুরু করল এই প্রশ্ন, দামিনী যাকে বিশ্বাস করে না, ভক্তি করে না, মনে-প্রাণে যাকে ঘৃণা করে, যার বিরুদ্ধে তার সমস্ত অস্তিত্বের বিদ্রোহ, তাকে কেন সে বহন করে চলতে চায়, সেই বন্দিত্বকে, সেই বেড়িকে? | এইভাবেই এই আখ্যানে, ত্রিকোণ প্রেমের রূপরেখাটি ক্রমেই স্পষ্টতা পেতে শুরু করল। শচীশ বুঝতে পারল, দামিনী এই বেড়িকে বহন করে চলতে চায় শুধু তারই জন্য। শচীশের প্রতি প্রেমই দামিনীর জীবনে আসল বেড়ি, মূল বন্ধন, বাকি সব তুচ্ছ, গৌণ। কিন্তু শ্রীবিলাস তার বন্ধু এবং দামিনীর প্রতি আসক্ত। শ্রীবিলাসের প্রতি ঈর্ষা বোধ করে শচীশ, অথচ দামিনীর কাছে নিজের প্রেমকে প্রকাশ করতে পারে না। এক গভীর আত্মিক টানাপোড়েন শুরু হয় তার মধ্যে। শ্রীবিলাসের ভাষ্য থেকে জানা যায়, শচীশ বোধ করি বুঝিল না যে, দামিনী ও আমার মাঝখানে যে আড়ালটা নাই বলিয়া সে আমাকে ঈর্ষা করিতেছে সেই আড়ালটা আছে বলিয়াই আমি তাকে ঈর্ষা করি। এই কারণেই শচীশ কিছুদিনের জন্য একলা সমুদ্রের ধারে চলে গেলে দামিনীরও আর শ্রীবিলাসকে ডাকার উত্সাহ রইল।
শ্রীবিলাস বুঝতে পারল, সে নিছক উপলক্ষ মাত্র, আসল লক্ষ শচীশই! সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়ে শচীশ নিজের প্রকৃত অবস্থাটা টের পেল। আত্মানুসন্ধান করাই তার প্রকৃতি। নিজেকে সে নির্জনতায়, একাকি আয়নার সামনে দাঁড় করাল। আর তারই ফলশ্রুতিতে ফিরে এলো সম্পূর্ণ রূপান্তরিত এক মানুষ হয়ে। সমর্পণ করাই তার স্বভাব। কিন্তু এবার সে সমৰ্পণ চাইল অন্যভাবে। সে সমৰ্পণ চাইল দামিনীর। যেন সে বলতে চাইল, যদি আমাকে ভালোই বেসে থাক, তবে অসাধ্যসাধন করে দেখাও দেখি! যাকে তুমি ঘৃণা করো, তাকেই ভালোবেসে দেখাও দেখি! আর এভাবেই দামিনীর প্রেমের গভীরতাকে সে যাচাই করে নিতে চাইল। জ্যাঠামশাই ও লীলানন্দস্বামীকে সে যাচাই করেছিল যথাক্রমে কাজ ও ভক্তির মধ্য দিয়ে। দামিনীকে সে যাচাই করতে চাইল প্রেমের মধ্য দিয়ে। ভক্তির বৃত্তে দামিনীকে টেনে এনে দামিনীর সঙ্গে সে একাত্ম হতে চাইল। আর এইভাবেই পরোক্ষভাবে চাইল দামিনীর প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে!
শচীশের এই অনুরোধ দামিনীর কাছে নির্দেশ হয়ে এলো। সে বুঝতে পারল, শচীশ যা চাইছে তা ঠিক বা ভুল যাই হোক, একমাত্র তাকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সে শচীশকে পাবে। প্রেমের কাছে ঠিক-ভুলের বিচার চলে না। প্রেম শুধু চায়, নিঃশর্ত সমর্পণ। যা কিছুর প্রতি দামিনীর মনে পুঞ্জিভূত হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহ, তাকে চাপা দিয়ে নিজের সমস্ত হৃদয়কে সে উৎসর্গ করে দিল গুরুজির সেবায়। নিজেকে তার এই উৎসর্গ অন্য কাউকে নয়, এই উৎসর্গ আসলে সে করতে চাইল শচীশকে, তার প্রেমকে। কিন্তু প্রশ্নহীনভাবে নয়। একদিন তাই শচীশের কাছে সে
জানতে চাইল, “আমাকে বুঝাইয়া দাও, তোমরা দিনরাত যা লইয়া আছ, তাহাতে পৃথিবীর কী প্রয়োজন? তোমরা কাকে বাঁচাইতে পারিলে?’ পরোক্ষে দামিনী যেন একথাও বোঝাতে চাইল, এই উৎসর্গ একটু একটু করে তার আত্মাকে, হৃদয়কে, জীবনের সমস্ত স্ফুর্তি ও প্রেরণাকে মেরে ফেলছে। সে বাঁচতে চায় এবং একমাত্র শচীশই তাকে বাঁচাতে পারে।
দামিনীর আর্তি শচীশের মর্মে গিয়ে বিধল। দামিনী বলেছিল, “আমি তোমার গুরুর কাছ হইতে কিছুই পাই নাই।…আমাকে বাঁচাও। যদি কেউ আমাকে বাঁচাইতে পারে তো সে তুমি। শচীশ লীলানন্দস্বামীকে ত্যাগ করল। কিন্তু সেই সঙ্গে সে ত্যাগ করল দামিনীকেও। এ ছাড়া দামিনীকে বাঁচানোর আর কোনও রাস্তাই তার সামনে খোলা ছিল না। দামিনীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল শ্রীবিলাসের। এ প্রসঙ্গে, বারবার মনে পড়তে পারে অঁদ্রে জিদের স্ট্রেইট ইজ দ্য গেট’ উপন্যাসটির কথা। ওই উপন্যাসেও ঠিক একইভাবে জেরোমকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেও বিবাহের মাধ্যমে জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল আলিসা। জেরোমের বিয়ের প্রস্তাবে বলেছিল, “তুমি কি একা হাঁটতে ভয় পাও? আমাদের যে একা একাই ঈশ্বরকে খুঁজে নিতে হবে।
শচীশ বুঝতে পেরেছিল, একটার পর একটা বন্ধন সে পেরিয়ে এসেছে। জ্যাঠামশাইয়ের কাছে থেকে সে বুদ্ধির চর্চা করেছে। লীলানন্দস্বামীর কাছে থেকে করেছে রসের চর্চা। বুদ্ধি ও রস, দুটি পথই তার কাছে মনে হয়েছে অসম্পূর্ণ। তারপর এল দামিনী। কিন্তু সে-ও তো বন্ধনের আরেকটি রূপ। কিন্তু বন্ধন কী মানুষকে ঈশ্বরকে কাছে পৌঁছে দিতে পারে? ঈশ্বরকে যে একা একাই খুঁজে নিতে হয়! শচীশ শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করে, যে মুখে তিনি আমার দিকে আসিতেছেন আমি যদি সেই মুখেই চলিতে থাকি তবে তার কাছ থেকে কেবল সরিতে থাকিব, আমি ঠিক উলটা মুখে চলিলে তবেই তো মিলন হইবে।…তিনি রূপ ভালোবাসেন, তাই কেবলই রূপের দিকে নামিয়া আসিতেছেন। আমরা তো শুধু রূপ লইয়া বাঁচি না, আমাদের তাই অরূপের দিকে ছুটিতে হয়। তিনি মুক্ত, তাই তাঁর লীলা বন্ধনে; আমরা বদ্ধ, সেইজন্য আমাদের আনন্দ মুক্তিতে। এ কথাটা বুঝি না বলিয়াই আমাদের যত দুঃখ।
দামিনী বুঝতে পারল, শচীশ বন্ধন চায় না। কারণ বন্ধন মানুষকে ক্রমেই ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। এই পৃথিবী, এই মহাবিশ্ব, এই সম্পর্ক, এইসবই তো বন্ধন। এই বন্ধনের মধ্যে যে প্রবল প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে, তাই তো ঈশ্বর। ঈশ্বর আসেন মুক্তি থেকে বন্ধনে। যে মানুষ বন্ধনের মধ্যে থাকে, সে কখনই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারবে না। তার চলার পথ হয়ে উঠবে ঈশ্বরের চলার পথের সঙ্গে সমান্তরাল। যেহেতু ঈশ্বর আসছেন মুক্তি থেকে বন্ধনের দিকে, মানুষকে তাই যেতে হবে বন্ধন থেকে মুক্তির দিকে। তবেই তো ঈশ্বর ও মানুষের মুখোমুখি দেখা হবে। শচীশ বন্ধন চায় না, চায় ঈশ্বরকে। আর তাই তার চলার অভিমুখ মুক্তির দিকে।
শচীশ ব্যাখ্যা করে আরও বলে, “তিনি বাঁধিতে বাঁধিতে শোনান, আমরা খুলিতে খুলিতে শুনি।…এতদিন আমি তাকে আপনার মতো করিয়া বানাইতে গিয়া কেবল ঠকিলাম।…বন্ধন আমার নয় বলিয়াই কোনো বন্ধনকে ধরিয়া রাখিতে পারি না, আর বন্ধন তোমারই বলিয়াই অনন্ত কালে তুমি সৃষ্টির বাঁধন ছাড়াইতে পারিলে না। থাকো, আমার রূপ লইয়া তুমি থাকো, আমি তোমার অরূপের মধ্যে ডুব মারিলাম।” গোরা ও শচীশের এখানেই যেন মিল। গোরার মতোই শচীশও অবিরাম ঠকতে থাকে, আত্ম-প্রতারণা করে যায়। অবিরাম তার যাত্রাপথ, আর সেই আধ্যাত্মিক অভিযাত্রায় একের পর এক ভুল করতে করতেই, ঠোক্কর খেতে খেতেই একসময় সে সঠিক পথটি দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে, একের পর এক বন্ধনে জড়িয়ে সে শুধু নিজেকেই ঠকিয়ে এসেছে। কিন্তু যে ঈশ্বরকে সে খুঁজে চলেছে, তিনি তো কোনও বন্ধনে নেই। তিনি আছেন মুক্তিতে।
শচীশ তাই মুক্তিকেই বেছে নেয়। সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি চায় সে। দামিনীর সঙ্গে বন্ধনে জড়ালে আসলে সে কী দামিনীকেই ঠকাবে না? সারাজীবন ঠকে এসেছে দামিনী। এখন দামিনীকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় তাকে ত্যাগ করা। আর দামিনীও বুঝতে পারে এ কথা। জীবনে সে শুধু শচীশকেই ভালোবেসে এসেছে। সেই ভালোবাসার জন্য যে কোনও আত্মত্যাগ করতে সে প্রস্তুত। শচীশ চায় মুক্তি। কিন্তু দামিনী বোঝে, শচীশের জীবনে সে-ই প্রধান বন্ধন। এই বন্ধন থাকলে শচীশ মুক্তি পাবে কী করে? অতএব শচীশের জীবন থেকে তাকে সরে যেতেই হবে। ভালোবাসার জন্য এই আত্মত্যাগ তাকে করতেই হবে। সে সরে গেলেই শচীশ মুক্তি পাবে। অতএব দামিনী সরে যায়। সামাজিকভাবে সে শচীশের ওপর থেকে নিজের অধিকারকে পুরোপুরি ত্যাগ করে। বিয়ে করে শ্রীবিলাসকে। প্রেমের জন্য এইটুকু তাকে করতেই হতো। এইটুকু না করতে পারলে, তার ভালোবাসা হয়ে যেত নিছক স্বার্থপরতা। কিন্তু দামিনী যে শুধু শচীশকে ভালোবাসতেই চেয়েছে।
আর শচীশও এ কথাই দামিনীকে স্পষ্ট ভাষায় জানায়। সে বলে, “যাকে আমি খুঁজিতেছি তাঁকে আমার বড়ো দরকার-আর কিছুতেই আমার দরকার নাই। দামিনী, তুমি আমাকে দয়া করো, তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাও। দামিনী সত্যিই শচীশকে ত্যাগ করে যায়। কিন্তু তারও যে একটা অবলম্বন বড়ো প্রয়োজন ছিল। সেই অবলম্বন সে খুঁজে পায় শ্রীবিলাসের মধ্যে। প্রেম নয়, নিছক অবলম্বন। শ্রীবিলাসকে তাই দামিনী বলে, “তিনি আমাকে কী বাঁচান বাঁচাইয়াছেন তুমি তার কী জান? তুমি কেবল আমারই দুঃখের দিকে তাকাও, আমাকে বাঁচাইতে গিয়া তিনি যে দুঃখটা পাইয়াছেন সে দিকে বুঝি তোমার দৃষ্টি নাই?’ এই মন্তব্যের মধ্যেই আবার শ্রীবিলাসের জীবনের ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে। সে শুধু দামিনীর দুঃখকেই দেখতে পায়, কারণ দামিনীকে সে ভালোবাসে। আর দামিনী দেখতে পায় শচীশের দুঃখকে, নিজের দুঃখের চেয়েও তার কাছে বড়ো হয়ে ওঠে শচীশের দুঃখ, কারণ সে ভালোবাসে শচীশকে।
আর শচীশ ভালোবাসে ঈশ্বরকে। নারীর প্রেমও শেষ পর্যন্ত তার জীবনে কোনও বন্ধন হয়ে উঠতে পারে না। সে তখন চায় শুধু ঈশ্বরকে। মুক্তিকে। বুদ্ধ বা শ্রীচৈতন্যের মতো নারীর প্রেমকে উপেক্ষা করে সে সম্পূর্ণ একা হতে চায়। আর এগিয়ে যেতে চায় মুক্তির দিকে, ঈশ্বরের মুখোমুখি হবে বলে। শচীশকে হারিয়ে দামিনী একা হয়ে যায় অন্যভাবে। আর সেই একাকীত্বের মুহূর্তেই জীবনে সে শ্রীবিলাসের গুরুত্বকে প্রথম বুঝতে পারে। লেখকের ভাষায়, ‘এবারে তার সমস্ত জগৎ সংকীর্ণ হইয়া সেইটুকুতে আসিয়া ঠেকিল যেখানে আমিই কেবল একলা। কাজেই আমাকে সম্পূর্ণ চোখ মেলিয়া দেখা ছাড়া আর উপায় ছিল না। দামিনীর প্রতি শ্রীবিলাসের প্রেম ও ত্যাগের গভীরতা ও ধারাবাহিকতাকে এই একটিমাত্র মন্তব্যেই স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। শ্রীবিলাস আগাগোড়া জানতো, দামিনীর কাছে তার উপস্থিতি কতটা তাৎপর্যহীন, তুচ্ছ ও উপলক্ষমাত্র। তবু নিজের সর্বস্ব দিয়ে দামিনীকে সে ভালোবেসে গেছে বিনিময়ে কিছু পাবে না জেনেও। এবং দামিনীর সত্যিকারের প্রয়োজনে প্রকৃত বন্ধুর মতোই সে তার পাশে থেকেছে। আর এখানেই দামিনীর প্রতি শ্রীবিলাসের প্রেমের আসল মহত্ব।
একজন সত্যিকারের বন্ধুকে পাশে পেয়ে দামিনীও সুখী হয়। সে মন্তব্য করে, “আমি একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম, কেবল এই একটা ধাক্কার অপেক্ষা ছিল। দামিনী যেন জীবনের বাস্তবতায় জেগে ওঠে। একজন বাস্তব মানুষের সংস্পর্শে আসে। এমন এক মানুষ, যে শুধু হৃদয়বানই নয়, যার একটা শরীর আছে এবং একজন নারীর মন ও শরীরের চাহিদাগুলিকে মেটানোর যোগ্যতা আছে। মৃত্যুর সময় দামিনী তাই পরবর্তী জীবনে শচীশকে নয়, শ্রীবিলাসকেই আকাঙ্খা করে। সে বলে, “জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই’। শচীশ ছিল দামিনীর জীবনে একটা স্বপ্ন। শ্রীবিলাস ঘোর বাস্তব, তার প্রেমিক ও স্বামী।
দামিনীকে দাহ করে ফেরার পথে শ্রীবিলাস নীলকুঠি আছে, এমন এক জায়গায় কিছুদিন কাটিয়ে যায়। তার সেই প্রচণ্ড সাহেবটার কথা মনে হয়, যে এখানে বসে একদিন হাজার হাজার গরিব চাষার রক্তকে নীল করে তুলেছিল। শ্রীবিলাসের জীবনে এভাবেই দেশের বেদনা, ঔপনিবেশিকতার সত্য প্রবল হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ একাকীত্বের মধ্যে দিয়ে গোরা ও নিখিলেশকে যেন অনুসরণ করে সে। শচীশ হয়ে ওঠে যুগপৎ এক স্বপ্ন ও আইডিয়া, ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য যে একা হয়ে মুক্তিকে খুঁজে নেওয়ার ভবিতব্যকে বেছে নেয়। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে এই মুক্তির রাজনৈতিক তাৎপর্যকেও অবশ্য অস্বীকার করা যায় না! ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’ গল্পে নিজের অনিচ্ছায় ভেতরের সত্যকে প্রকাশ করে ফেলেছিল গ্রেগর সামসা। পোকা হয়ে গিয়ে সে দেখিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাব্যবস্থা কীভাবে একজন ব্যক্তিমানুষের আত্মাকে পোকায় পরিণত করে! সত্যকে প্রকাশ করে ফেলার মূল্য গ্রেগরকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে গ্রেগরের মতোই শচীশও নিজের জীবনকে বাজি রাখে সত্যের জন্য। এবং শেষপর্যন্ত সে সেই সত্যকে খুঁজে পায়, যা তাকে খোঁজ দেয় ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর সম্ভাব্য পথের।
আবহমান অসাধারণ ওয়েবপত্র।
প্রবন্ধ আর্কাইভে থাকছে সার্ধশতবর্ষের দুস্পাপ্য ও দুর্লভ প্রবন্ধ,গল্প,কবিতার বিপুল সংগ্রহ। এ জ্ঞান রাজ্যে ভ্রমণের জন্য হার্দিক আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
https://www.prabandhaarchive.com