
গৌতম বসুর কবিতার ভাষা
সৌভিক গুহসরকার
গৌতম বসুর কবিতার ভেতর যেটি তীব্রভাবে সঞ্চারিত হয়েছে, তা হল তাঁর ইতিহাসচেতনা ও পুরাণচেতনা। তিনি শুধু বাংলা কবিতার পাঠক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতীয় এবং পৃথিবীর নানা মহাকাব্যের একজন তীব্র অনুরাগী পাঠক। তাঁর কবিতার ভাষায় তাই বারংবার উঠে এসেছে মহাকাব্যিক বিস্তার। গৌতম বসুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। লিখলেন সৌভিক গুহসরকার।
যে কোনও ভাষার সাহিত্যে অসংখ্য কবিতা লেখক থাকেন, যাঁরা বিভিন্নভাবে সেই সাহিত্যকে বাঙ্ময় করে তোলেন। তাকে সম্পদশালী করে তোলেন বিবিধ সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সকলে প্রণয়ন করতে পারেন না। কিছু শব্দের পুনঃপুন প্রয়োগ, বা কিছু বাকপ্রতিমার বারংবার ব্যবহারে যে কাব্যভাষা তৈরি হয় তা কৃত্রিম মুদ্রা। প্রকৃত কাব্যভাষা বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে― কবির ব্যক্তিসত্তা থেকে। একজন কবি কী বলতে চাইছেন, তার ওপর নির্ভর করবে তাঁর ভঙ্গিমা। অথচ এই ভঙ্গিমাও একেবারে আনকোরা কিছু নয়। অন্য কবিদের প্রভাব আত্মসাৎ করে তাঁকে জন্ম দিতে হবে নিজস্ব ভাষার। যে ভাষা তাঁর কাছে হবে প্রাকৃতিক। স্বাভাবিক। অথচ তা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে বিস্তর নারকীয় ভাংচুরের পর। এ আমরা দেখেছি এলিয়টে, এ আমরা দেখেছি জীবনানন্দে। একজন কবিতালেখক নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করার জন্য বিদেশি কবির লেখা কবিতার ভঙ্গিমা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন, এও আমরা দেখেছি। বাংলায় স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃজন করেছেন বেশ কয়েকজন কবি। তাঁদের মধ্যে একজন কবি গৌতম বসু।
গৌতম বসুর কবিতার ভেতর যেটি তীব্রভাবে সঞ্চারিত হয়েছে, তা হল তাঁর ইতিহাসচেতনা ও পুরাণচেতনা। তিনি শুধু বাংলা কবিতার পাঠক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতীয় এবং পৃথিবীর নানা মহাকাব্যের একজন তীব্র অনুরাগী পাঠক। তাঁর কবিতার ভাষায় তাই বারংবার উঠে এসেছে মহাকাব্যিক বিস্তার। সাম্প্রতিক ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে তাঁর চেতনা এই জগৎ, এই বাস্তবকে বুঝে নিতে চাইছে মহাকাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। পর পর কিছু উদাহরণ সাজিয়ে দেওয়া যাক―
এসো অগ্নি, প্রেতলোকের হাওয়া, ব্যাধীদের অধীশ্বর এসো/ তোমাদের পাব বলে করোজোড়ে ফিরিয়ে দিয়েছি প্রক্ষালন (শ্লোক, নয়নপথগামী)
একমাত্র খড়/ ধান থেকে জেগে, হলুদ বিকল, পড়ে আছে/ কংসাবতী, প্রাণদায়িনী, অবিকল শকুনের ঘাড়/ মৃত্যুর অনেক অসভ্যতা যেখানে, সেই স্থান/ গাভীর পাদপদ্ম, স্বর্গ, নিসর্গ, অকলঙ্কিত ধরিত্রী।
(অন্নপূর্ণা ও শুভকাল)
আমি বললাম, হে স্বর্ণগরুড়চূড়া, হে জগৎসংসারবন্ধন,/ এ কেমন ঘন্টাধ্বনি শুনি/ শরীরখানা কী-এক পাগল রঙে রাঙালে/ দেখতে-পাওয়ার অভিশাপে আমার সর্বশরীর জ্বলছে
(স্বর্ণগরুড়চূড়া)
অথবা
সুদূরে, মিথিলানগরীর সর্বশরীর জ্বলছে―/ ভস্মবৎ মৃত পিতৃকুল/ . . . প্রহরগণনাকারী, তুমি কেহ নও/ তোমার লেখনী পথের হাওয়ায় লাঞ্ছিত/ ওই দেখা যায় প্রজ্জ্বলন, চিরদগ্ধ মিথিলানগরী
(মিথিলানগরী)
রূপকথার পৃষ্ঠা থেকে উড়ে এসেছে এই বনপথ,/ রোদ ফুরিয়ে আসছে, রাক্ষসদের সদাজাগ্ৰত চোখ/ কৃষ্ণপালকের মতো হাওয়ায় ভাসছে, এ-দেহখানা/ কতদূর পরিশ্রান্ত, ভার নামিয়ে বুঝতে পারলাম;
(ছায়া)
দীর্ঘদেহী এক বৃদ্ধ, রথ থেকে নেমে এলেন দ্রুত, সহযাত্রীকে প্রণাম করে বললেন, ‘প্রহরীদের অজ্ঞাতে, সুরক্ষিত এই শত্রুপক্ষের শিবিরে আমরা অনায়াস প্রবেশ করলাম, এ কী করে সম্ভব? আমি নিশ্চিত, আপনি কোনও দেবতা! আশীর্বাদ করুন, আমি যেন কৃতকার্য হই!’
(মোচন)
এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গৌতম বসুর কাব্যভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, (১) প্রভূত তৎসম শব্দের ব্যবহার (২) পুরনো বাংলা শব্দের ব্যবহার যেমন ‘কেহ’, ‘নাই’, ‘তারে’ ‘বহে’ ‘লহো’। এই দুই ধরনের শব্দ ব্যবহারের একটি বিশেষ কারণ আছে এবং তা হল তীব্রতা ও ঘনত্বের আয়োজন। গৌতম বসু যে কাব্যপৃথিবী নির্মাণ করতে চেয়েছেন, তা গহন, তা পৌরাণিক এবং তাই লোকোত্তীর্ণ। এইকারণেই তাঁর শব্দসম্ভারে এত গভীর ধ্বনিময় শব্দের অস্তিত্ব। তাঁর বাকপ্রতিমার মধ্যে বারংবার ফুটে উঠেছে প্রাচীন কাব্যের ধ্বনি।
‘চঞ্চলমতিসম্পন্ন বনলতাদের খেলা দেখেছিলাম নিভৃতে/ . . . বনলতারা আমার দক্ষিণবাহু লয়ে তোমরা ফিরে এসেছ কী?’
(হেলেন গার্ডনারের সঙ্গে একটি আলোচনা)
‘অরণ্যকে মনে-মনে ডাকলাম/ দেখলাম সে-ও সংকটাপন্ন চক্ষুদ্বয়ে অষ্টপ্রহর/জ্বলন, ক্ষণে ক্ষণে ধারাবর্ষণ, মুখ কালো হয়ে গেছে।’ বা ‘ভ্রূযুগল, চেয়ে আছি পুষ্পবৎ।’
(অরণ্যকে বলা কথা)
দর্শনের প্রতি গৌতম বসুর ছিল গভীর আকর্ষণ, তাই উপনিষদীয় ভাষার ছায়া পড়েছে তাঁর কাব্যভাষায়। ‘কুৎস ও অশ্বসেন’ বা ‘ক্ষিতিগর্ভ ও ক্ষান্তিবাদী’ সংলাপের ভেতর আমরা যে ভাষার সম্মুখীন হই, তা গম্ভীর ও প্রাচীনতালগ্ন।
ক্ষিতিগর্ভ! কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। ওটা কী? কল্পবৃক্ষের ছায়া? ওঁর সমস্ত শরীর কী অদ্ভুত; কখনও হরিদ্বর্ণ, কখনও বা পীত!
(ক্ষিতিগর্ভ ও ক্ষান্তিবাদী)
গৌতম বসুর কাব্যভাষার শরীরে এই চিহ্নগুলো তীব্রভাবে বর্তমান। অথচ এই কারণেই তাঁর লেখা সাধারণ পাঠকের কাছে তেমনভাবে পৌঁছল না, কারণ পাঠক চায় এমন ভাষার পরিসর, যা সে চারপাশে শুনতে পাচ্ছে। রোজকার মুখের ভাষা খোঁজে সে। কিন্তু গৌতম বসুর অন্তর দিয়ে যা-কিছুকে সত্য ও ধ্রুব বলে মেনেছেন, তিনি সেই পথেই হেঁটেছেন। তাঁর কাব্যভাষা হয়ে উঠেছে তাঁর মতোই গভীর ক্ল্যাসিকাল। তাঁর কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছে একজন চিন্তকের ভাষা। যাঁরা ইতিহাস, পৌরাণিক ও দর্শনের বলয়ে অবস্থান করেন গৌতম বসুর কাব্যভাষা তাঁদের কাছে দূরের কোনও বস্তু নয়। তা অতি নিকটের জিনিস। তীব্র আধুনিকতা, ভাষার লম্ফঝম্প ও ভাংচুরের যে উচ্ছ্বাস, তা তাঁর ভাষায় নেই। তাঁর কাব্য ভাষা শান্ত সুপ্রাচীনা জাহ্নবীর মতো যার পাশে গভীর অন্ধকারে ধুনি জ্বেলে বসে থাকে আমাদের সমাহিত জনপদ।
এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা উল্লেখ করি। মিথিলানগরী কবিতাটি পড়ার সময় একটি অংশ পাই যেখানে লেখা―
ঋষি রয়োকানের অন্তিমকাল উপস্থিত―/ পথে, শরতের ঝরাপাতা দেখে তাঁর উদাস মন কহে,/ ওরা আমার প্রতি বিমুখ/ পিছন ফিরে রয়েছে ওরা/ বিরূপ বিশ্বে, ওরা যেন আমায় ফেলে রেখে যেতে চায়!
আমি রয়োকানের নাম আগে শুনিনি। কোথাও পড়িওনি। তাই কবিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলুম রয়োকানের কথা। তিনি মুখে মুখে বেশ খানিকটা বললেন এবং তারপর তিনি আমায় Zen Master রয়োকানের ওপর একটি লেখা পাঠালেন। এ থেকে তাঁর দর্শনচেতনার একটি গভীর দিক আমার কাছে উন্মোচিত হল এবং আমার কাছে এটা আরও স্পষ্ট হল যে, যে কাব্যভাষার জন্ম তিনি দিয়েছেন তা তিনি বহন করেছেন চেতনায়। তা আরোপিত কৃত্রিম মুদ্রা নয়।
গৌতম বসুর কাব্যভাষা নিয়ে বিস্তৃত কাজ হওয়া প্রয়োজন। তবে আজকের এই লেখা শেষ করব গৌতম বসুর ওপর কালীকৃষ্ণ গুহর লেখা একটি অসামান্য এলিজির কিছু পংক্তি দিয়ে:
তুমি একদিন ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে গৌতম।
অনেক সন্তাপ আর নীরবতা পার হয়ে, ঝড়বৃষ্টি পার হয়ে
ভাষা খুঁজে পেয়েছিলে তুমি। খুঁজে পেয়েছিলে
ধুলোয় ঢাকা মানুষের জন্মজন্মান্তরের সংসার। . . .
এইসব গৌতম-পাঠ এক জায়গায় রেখে দেবো।।। অনেকদিন পরপর একবার করে পড়ব।।। ❤️❤️❤️