কবি সমীরণ ঘোষ-এর ‘কবিতাসংগ্রহ’ – পাঠশেষের কথা <br /> সৌরভ মজুমদার

কবি সমীরণ ঘোষ-এর ‘কবিতাসংগ্রহ’ – পাঠশেষের কথা
সৌরভ মজুমদার

“… শব্দের ফরফর শব্দের ধ্বনির সাবেক
শূন্যের থালায় যে অন্নের পৃথিবী মোচড়ায়
তারই অন্তর্ধানের ছায়াপথ
ভূগোলকে ছায়ার ঝাঁঝরি ফেলে যায়।” —-

ছায়া-ঝাঁঝরিতে তলানি যা কিছু, তাই ছেনে ছবি আঁকেন কবি, বহুধাবিস্তৃত কোলাহলহীন মগ্ন আত্মধ্বনি; অমৃতহলাহল জারানো, সাবেক বা হালের ভাষার ফরফরে। কবি একজন, সমীরণ ঘোষ অন্তত, অনন্ত আঁকেন। দশকের সত্তর থেকে সাম্প্রতিক দ্বিতীয়র চেতন-অবচেতন-অধিচেতনার ধারা, অনিঃশেষ। আড়ালপ্রিয় এই কবির উচ্চারণে সন্ধ্যাভাষার কলধ্বনি– “…হালে পানি আমিও বোলাচ্ছি জলপায়রার থুপি/ আত্মহননের স্নায়ু সন্ধেকে ব্লেড মেরে দেয়…”। সমীরণ ঘোষ-এর কবিতাসংগ্রহ ১ ও ২ এর কবিতার ভিতরঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করার ধৈর্যে, দৃশ্যমান অনুভব — বিভিন্ন কালখণ্ডে, সারাজীবন ধরেই যেনবা মহাকবিতার প্রয়োজনে নিজেকে নিঃশর্ত সমর্পণ করে চলেছেন তিনি, দশক থেকে দশকে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে। বোধিপ্লাবিত শব্দসৌকর্যে যে ধ্বনিসম্মেলনের সৃষ্টি, যে সঙ্কেত-সংবহন মিশে আছে তাঁর কাব্যভাষার সদাবহমানতায়, তার অনুরণন পাঠকের বোধকে এফোঁড়–ওফোঁড় করে, পুষ্ট করে। তিরিশের মহাকবির চিরকালীন ধারাভাষ্য – “পুরনো প্রদীপে যে অদৃশ্য-হাত নতুন সংস্থানের ভিতর দিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে; তার এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্য শুধু – সকলের জন্য নয় – অনেকের জন্য নয়” — মনে রেখেও বলা যায়, কবি সমীরণ ঘোষের স্বর-স্বাতন্ত্র্য আগ্রহী পাঠকের নির্জর প্রাপ্তির আনন্দ।
১৯৮০ সালে নিজের পঁচিশ বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কবিতাবই ‘হে বদ্ধ কাপালিক’ থেকে পর্যায়ক্রমে বাঁক ও বাক্ বদলের অরগ্যানিক প্রক্রিয়ায় পাল্টাতে পাল্টাতে, বারবার ভাঙতে ভাঙতে, তিনি ক্রমশঃ নিজেকে গড়ে চলেছেন বয়সের ঊনসত্তরেও — ২০২৩-এ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত ‘সান্ধ্যবৈঠক’, এবং ‘কবিতাসংগ্রহ’-তে জায়গা করে নেওয়া অপ্রকাশিত ‘স্ক্র্যাপবুক’-এর শেষ পাতা অবধি। আর এই ভাঙা-গড়ার নেপথ্যে, পাললিক মানব-সংবেদনসমূহ, সুখদুঃখকান্নাহাসিরাগঅভিমানক্রোধক্রান্তি অধিক এক অপর কবিমন এবং ‘এমন-যদি-হতো’ মননের যাত্রাপথে প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধারে নিজেকে এবং তাঁর পাঠকবর্গকে।
প্রথম বইয়ে যেমন মায়া-নৈবেদ্য সাজানো — “ফুলে এত মায়া ! মায়া অর্থে তোমার দু-চোখ/ কুচিশুভ্রবেদনার আভা/ তোমার চোখের শাদাকালো ডিম/ একাংশে কুমকুম আর স্পর্শকাতরতা” (স্কেচ ১) — তেমনই, একই কবিতায় দুই পংক্তি দূরে এক অত্যুজ্জ্বল প্রজ্ঞপ্তি, “বেদনার কোনো গাছ নেই পৃথিবীতে, বেদনা জলজ নয়”। আবার অন্য এক আবিস্কারে, অনিত্য আবহের ভাব-সংকেত “দুঃখ আমার জমে গাছ হয়ে আছে/ আমি তার নীচে পাষাণ-পুরুতের মতো বসে” (পাষাণ-পুরুত), ক্রমবিকাশের ধারাপ্রবাহে ‘ছিন্নবিছিন্নতা’য় এসে স্থানিক সংকেতসংবহন, “ফাঁকাঘর, বাতাস এসে দাঁড়িয়ে তোমার সামনে/ টেবিল থেকে মুখ তুলে নতুন ক্যালেন্ডার/ আর ছবিটার দিকে। তুমি/ আদৌ জানোনা, কবে অসুখের শুরু, কোথায়-বা শেষ”……
নিচু-স্বরে শুরু হওয়া তাঁর প্রথম পর্বের কবিতা, সংগ্রহের অন্তিমে দৃশ্যকল্পর ‘মেটামরফোসিস’ – কল্পদৃশ্যের জাদু-আয়না-ক্যানভাসে আঁকা আত্ম এবং সমাজবীক্ষণের স্বতন্ত্র উদ্ভাস — ‘ম্যাজিক-মিরর ইমেজ’; যার গ্রন্থিত সূচনা ২০১৪ সালে ঊনষাটের সমীরণ ঘোষের সপ্তম কবিতাবই ‘সাঁই আমাকে ওরাও’ পর্ব থেকে। অবশ্য, এর ঠিক একযুগ আগে ২০০২-এ প্রকাশিত ষষ্ঠ বই, ‘পর্যটকের ডানা’য় ইতিমধ্যে পাখা মেলেছে ভিন্নস্বাদের কিছু বহু-রৈখিক পর্যটন – সেই আলোচনা অন্যত্র।

তাঁর কবিতাযাপনের আদিতে যে সংহত তীব্র শ্লেষে প্রথম বইয়ের সমাপ্তি — “মুহুর্মুহ জ্বর নিয়ে কলকাতা ছুটে আসে দেহাতি মানুষ/ কলকাতা হাঁ করে/ কলকাতার জিভে এত আঠা/ তবু ‘পুনর্বাসন চাই’ বারবার একথাই লিখি। হে বদ্ধ কাপালিক তুমি কি বুঝেছো এই শব্দের/ রূঢ় ব্যবহার !” – তারই বিস্তারগাথা ধারণ করে আছে ১৯৮৪-র দ্বিতীয়বই, ‘কাঞ্চনবেড় থেকে কলকাতা’ — “ওরা বলছেঃ সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হোক।/ অথচ ধর্মের কাঁধে হাত রেখে বিছিন্নতাকে উসকে দিচ্ছে।” …… “এইসব লাল কিংবা তেরং/একে অপরের সাথে স্টেজ-লড়াই শেষে/ মালা হাতে দাঁড়িয়ে গ্রিনরুমে…” (তোমাদের সাথে কিছু কথা)। সিস্টেমগত, সমষ্টিগত, ব্যক্তিগত এবং স্বগত – চারপাশের প্রত্যেকটি শক্তিবলয়ে আঘাত লিখে যান কবি সমীরণ ঘোষ । অনবরত । বদলে যায় লেখার অভিমুখ শুভমানসের দায় তথা সময়ের দাবীকে সতত স্বীকার করে ।
• “এই উত্তর-পঁচিশের যুবা/ তার সমস্ত কবিতাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেখেছে/ সির্ফ্ ফাঁকা, শুনশান, বেবাক বানানো/…সেই ফাঁকিগুলোই/ রং-এ ঢেলে উপহার দিয়েছি তোমাকে” (কাঞ্চনবেড় থেকে কলকাতা – ১২)
• “আজ ২২ জানুয়ারি তোমার পাঠানো/ এম.ও. যথারীতি ফেরত পাঠালাম।/ আসলে বাংলাদেশের এই দীপ্তপ্রাণ দরিদ্র ছেলেদের/ শুধু ভিখিরি ভেবেছ…” (সে তো করুণা)
• “সেই ধর্ষণের বেলা কখন কোথায় এবং কীভাবে…/ উৎকর্ণ মানুষ/ সেই গল্পের শূন্যে ভেসে/ একজন নারীর সাথে কয়েকটি পশুর/ উত্তেজনাময় যৌন লড়াই।/ মাননীয় শ্রোতৃমণ্ডলী, এইমাত্র শুরু হচ্ছে/ একঘর মানুষের ভেতর/ একজন নারীর প্রকাশ্য ও দ্বিতীয় ধর্ষণ” (স্বীকারোক্তি)
• “আসতে চাই/ শুধু এক সংঘর্ষ থেকে যুদ্ধের শিয়রে/ ও সময়, জ্বলুক আগুন/ জ্বলুক ঘর-বার দিন/ জ্বলে উঠুক প্রেম/ ভালো থাকা চুপে থাকা/ বসে থাকা সংঘহীন নিরক্ত বাসর/ তলোয়ার পোহাচ্ছে রোদ/ অলস উঠোনে একা একা” (তলোয়ার পোহাচ্ছে রোদ একা একা)
• “জীবনের সুস্থ প্রতিষ্ঠার জন্যে পথে পথে/ নেমে আসবে মানুষ। যুদ্ধকে ঘৃণার জন্য/ আর এক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হবে অচিরেই” (পা রাখার আগে)
সমীরণ ঘোষের এক কবিতা থেকে আরেক কবিতায় যেতে যেতে মনে পড়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়, শঙ্খ ঘোষ একসময় লিখেছিলেন, “সময়কে যখন সময়ের মধ্যে বাঁধা যায়না, অর্থাৎ চিরসময়কে যখন খণ্ডসময় দিয়ে বাঁধা যায়না, তখন তা হয়ে ওঠে নিঃসময়। খণ্ডসময় সরিয়ে সরিয়ে তারই মধ্যে নিঃসময় জাগিয়ে তোলা যায় যদি, তখন একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। ইংরেজিতে কখনো কখনো হয়তো time আর Time লিখে প্রভেদটাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। এই Time বস্তুত timeless।” আরো একধাপ এগিয়ে একথা বললে হয়তো অত্যুক্তি হয়না, সৃষ্টির ভিতরে এই ‘নিঃসময়’ জাগিয়ে, timelessness কে আপন শৈলীতে মূর্ত করে তোলাই শিল্পীর দক্ষতার অন্যতম প্রধান নির্ণায়ক। সমকালের সাহিত্য-কোলাহল থেকে সন্তর্পণে নিজেকে বহুদূরে সরিয়ে রেখে, কবি সমীরণ ঘোষ তাঁর কবিতায় এই timelessness বুনেছেন, “দৃষ্টিপথে এত ঘোড়া। ঝাঁকে ঝাঁকে। এতটুকু ফাঁক নেই/ ফুরসতহীন মেঘ কাঁটাঝোপে নেমে আসছে বারবার/ কেমন ধোঁয়াটে ভূমি, দুটি ছেলেমেয়ে ধ্বংসের ভেতর ঘুরে ঘুরে নাচছে” (নূহের জাহাজ); “চার পাশে গাঢ় হয়ে সন্ধে/ যার ফেরা নেই, সে তো বাটালির আরোহ-অবরোহে/ সন্ধ্যাকে মূর্ত করে তোলে” (কয়েক টুকরো – মিয়া কী মল্লার)

ব্রিটিশ কবি T.S. Eliot ট্র্যাডিশন, ট্যালেন্ট ও সমালোচনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পাঠককূলের সুবিধার্থে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “Tradition is a matter of much wider significance. It cannot be inherited, and if you want it you must obtain it by great labour…..
….. we might remind ourselves that criticism is as inevitable as breathing, and that we should be none the worse for articulating what passes in our minds when we read a book and feel an emotion about it, for criticizing our own minds….. We dwell with satisfaction upon the poet’s difference from his predecessors, especially his immediate predecessors; we endeavour to find something that can be isolated in order to be enjoyed.
…..No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists.”

সমীরণ ঘোষ-এর কবিতা এই প্রেক্ষিতের বাইরের বিষয় না হয়েও, আরও বেশি করে, Eliot-এর বলা পরের কয়েকটি কথার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে – “What happens is a continual surrender of himself as he is at the moment to something which is more valuable. The progress of an artist is a continual self-sacrifice, a continual extinction of personality. … It is in this depersonalization that art may be said to approach the condition of science.”

এই ইলিয়টিও শৈল্পিক প্রগতি যে উচ্চতায় আদপে হয়ে ওঠে বিজ্ঞ্যান, সেই প্রক্রিয়া সমীরণ ঘোষের কবিতাজীবনের অর্জন ও আশ্রয় — একথা বললে অনৃতভাষণ হয়না। তাঁর কবিতাসংগ্রহের সম্পাদক পার্থজিৎ চন্দ-র পর্যালোচনার সঙ্গেও সহমত না হওয়ার অবকাশ রাখেননি এই শিল্পীকবি — “অকল্পনীয় ধারণ ক্ষমতা নিয়ে স্থির হয়ে আছেন সমীরণ” । দৃশ্যত স্থির, বস্তুত একক প্রয়াসে ঠেলে ঠেলে আধুনিক বাংলা কবিতার যাত্রাপথের ‘মোড়-ঘুরিয়ে-দেওয়া’, সাধনালীন কবির ক্যানভাস থেকে যে শাব্দিক বিকিরণ হয়ে চলেছে অনবরত, তাতে ইলিয়টিও শিল্পভাবনার সঙ্গে প্রছন্ন রয়েছে জীবনানন্দিয় শ্রেষ্ঠ কবিতার সন্দর্ভ — “শ্রেষ্ঠ কবিতার ভিতর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে মানুষের তথাকথিত সমাজকে বা সভ্যতাকেই শুধু নয়, এমনকি সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টিকেও যেন তা ভাঙছে এবং নতুন করে গড়তে চাচ্ছে। “সমীরণ ঘোষ যে শব্দবাক্যভাষায় কথা বললেন লেখা থেকে লেখায়, বই থেকে বইয়ে চলে যেতে যেতে, সে ভাষা ইতঃপূর্বে শোনেনি বাংলা কবিতা।

২০০২-এর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত কবির ষষ্ঠবই, ‘পর্যটকের ডানা’ – এইসন্দর্ভের এমনই এক রত্নগর্ভ সংকলন; যেখানে বাংলা কবিতার বিষয় ও বিবরণের ‘ট্র্যাডিশন’ মেনে স্বাভাবিকভাবে এসেছে পুরাণ, এসেছে তন্ত্র, এসেছে শরীর-বৃত্তি; অতঃপর শিল্পীকবির শব্দলিপিকুশলতার নিপুণ আশ্চর্যে, অভাবনীয় রূপকল্পে বিবৃত হয়েছে চমকপ্রদ ভাবানুসঙ্গে – “… শেষে পালঙ্কে শোয়ালো যেই/ আর্দ্রজোনাকিবাতি, ঘোটকীর মুখে দেখি আশ্চর্যরমণী/ এত কুহকীপাথর কোথা পেলি, এ-অঙ্গ কোথায় হাতালি কুলটা/ শবপুরুষের সাথে রমনীশবের এইমাত্র কলহখুনসুটি/ যখন জ্যোৎস্না এসে শবাধারে ফেলেছে চৈত্রের দুটো পাতা’’ (শবজ্যোৎস্না)

সে বইয়ে, নাভিজন্মের আলো’য় ‘ব্রহ্মাণ্ডকপোত’-এর উড়াল নিয়েছে পংক্তির পর পংক্তি কখনো; কখনোবা একের পর এক পুরো কবিতাটিই– “তোমার পতঙ্গকথা আমাকে নিশীথ করে অরন্যশিখরে/ আর যা সময়চিহ্ন অথবা সমেঘভেলা খুলে যায় আকাশগঙ্গায়/ ত্যাগের মর্ম জানি, আরও গ্রহণের স্ববিরোধী হাত/ তোমাকে সাজাতে এসে কী-রঙ্গ নিজেই বাঘছাল। ধুনিজ্বেলে/ চিমটেয় পোড়াচ্ছি নিজমেদমাংস সমূহ পরিহাস/ (সং)

“মুহূর্তকে নখরে জ্বালিয়ে ছটি ঘোড়া সহসা ছ’দিকে মিশে গেল
অতঃপর যেটুকু বিদ্যুল্লেখা সেটুকুই বিশ্বদর্শন ……
…………………………………………………………………
নাভি থেকে একটি মৃণাল ক্রমে দীর্ঘ আর ব্রহ্মাণ্ডবিলীন
কে কাকে জন্ম দিই, এই ঘোর প্রশ্নে দিগ্বিদিক আঁধি তুষারপ্রবাহ
আমি ঘোড়া আমার গোলক শুধু ডুবে যাই একই রেতঃপাতে” (নাভিজন্মের আলো)
——————————————————————————————————-
“পুড়ে এসে দেখেছিমাত্র ঈষৎ খয়েরি। নিছক ত্বকের কথা
সভা করে এমতো পাঁচকান আদৌ ভাবিনি
ততক্ষণে গয়ারাম ভিড়িয়েছে যাত্রানাও। দূরঘাট। পাটাতনে
অস্পষ্ট স্ত্রীলোক। দূরবিনে এখনো খোলেনি যে গ্রহমুখ, বণিকের
রত্নঝাঁপি মাঝেমধ্যে নামিয়েছে তীরের তাঁবুতে। যদিও প্রবেশপথ
এত ভিড়, টিনের ছিদ্রে দেখি পড়ে-পাওয়া দুঃখী তপোবন
মুহূর্তে নেমেছি। যথেষ্ট ভিজেছে চুল ডানার পালক

গরলে সামান্য ক্ষতি, জানে ভুক্তভোগী
ব্রহ্মাণ্ডতিমিরে নেমে যখন তুলেছে বিস্মিত অংশমাত্র মুখ” (বীক্ষণ)
——————————————————————————————————-
‘পর্যটকের ডানা’র পালকে পালকে রক্তরাগ ছড়িয়ে গ্রন্থিত, লিপিবদ্ধ অন্তঃউড়ানও — “উড়ে যাওয়া ঘড়ি উড়ন্ত গিটার আর পাখাঅলা মানবমনবী” আর উড়ে চলা ‘ফিল্ম্ক্যান’ আর ‘যাত্রা অবিনাশ’ আর ‘ভ্রমণমুকুর’ “…ওয়াগন উপচে পড়ছে। মালখালাস থেকে লাশখালাশ…/ অবধি দৌড়… / পরমাণু বিষয়ক বক্তৃতায় খ্যাপা ষাঁড়ের রক্তিম লিঙ্গভাগ/ ইনসেটে যা ফুটে উঠতে দেখছি/ তাকেই কী বলা যাবে কার্যকারণ সূত্রের শেষ প্রতিভাস” (ইনসেট) । “ প্রতিরোধে ভেঙে গেলে একক-সংঘের বেলা/ মৃতআলো ঘিরে বস্তুজগৎ। দিগন্তে গৃহযুদ্ধের ছাই/ শিশুহত্যা দ্রোহের শিরোপা নিয়ে বিশ্ববাজারে। এসবই/ বাঁশিঅলা দেখে, ভস্মমেঘে দিনান্তের ধ্বংসরেখায়” (একক-সংঘের বেলা) । “…বাঁচো বা অতিকায় সত্ত্বেও ছুটি/ ফসিলই বলে থাকে কার কিভাবে যাত্রা কেমন নিষ্ক্রমণ” (আবহমান) । “…মীমাংসা দুরূহ। তন্ত্রিতে বাজাও তুমি দুঃখরাগ সমূহ ব্যাদান/ গোধূলিমাদুরে উড়ে পক্ষের কম্পনে আমি আদিঅন্ত শুনি” (মাধুকরী) ।

সময়ের অন্য মাত্রায়, একবিংশ শতাব্দীর পোষ্ট-মডার্ন সাম্প্রতিকে, তাঁর উচ্চারণ যেন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সমসাময়িক আমেরিকান লেখিকা ক্যাথেরিন বু-এর ন্যারেশনের juxtaposition, “When I settle into a place, listening and watching, I don’t try to fool myself that the stories of individuals are themselves arguments. I just believe that better arguments, may be even better politics, get formulated when we know about ordinary lives. …. In the age of globalization …… hope is not a fiction ……. as capital rushes around the planet and the idea of permanent work becomes anachronistic, the unpredictability of daily life has a way of grinding down individual promise.” …..

“রহস্যের রক্তিম পোঁচ অনুবাদ করি, ক্রমে অনুদিত হই/ মাধুরীপ্রেরিতমেঘ হাওয়া তোলে আমার ভেতর/ শুধু ছাই ওড়া দেখে যায় আমার মুকুর” (জলে লেখা লিপি – তিন) । “দুরাশা পর্যন্ত লম্বা কুকুরদের ঘেউ/ শূন্যের নাটবল্টু কী যেন ইঙ্গিত করছে জিভের লোহায়/ কী যেন কেলাসিত” (স্ক্র্যাপবুক ২); “নিজের মাংসের স্তূপে ছুরিগোঁজা ছায়ার মাস্টার/ একরোখা। জাদু আয়নার ঘেউ।” (স্ক্র্যাপবুক ৩৩); “পুনরাভিনয় ছাড়া জগৎ খলশে/ মৃতমাছের ঝুমঝুমি/ মাস্টারের হাওয়ার কুঁজ কামড়ে ধরে/ কুকুরদের ডাকের বিহ্বল” (স্ক্র্যাপবুক ৩৫) ।

কবিতাসংগ্রহের ভূমিকায় এইসময়ের মনস্বী কবি ও গদ্যকার পার্থজিৎ চন্দ লিখছেন, “বিশ্বায়ন ও ভুবনগ্রামের আলোকিত বাতিস্তম্ভের নিচে ক্রমাগত পিষে যাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ, সর্বগ্রাসী ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া পতঙ্গের নিয়তিকে চিনতে পেরেছিলেন সমীরণ” – কবিতায় যার প্রকাশ সূচিত হোল সম্ভবত ‘সাঁই আমাকে ওড়াও’ পর্ব থেকেই। রচনার পরিসরে কবি গড়লেন এবং পেরিয়ে যেতে থাকলেন ভাবসন্ত্রাসের এক একটি স্তর, আর তার ফেলে আসা শ্রমণপথে ক্রমান্বয়ে তৈরি হতে থাকল একটার পর একটা সংকেতসৌধ যার ভেজানো দরজা আপন সংবেদে খুলে খুলে যেতে যেতে পাঠক কিছুটা কবিকে, আর বেশিটা নিজেকেই যেন আবিস্কার করে ফেলেন, এক ঘোরলাগা ঐন্দ্রজালিক কবিতা-বলয়ের কেন্দ্রে …

“সরাইখানার ভিজে দেয়ালের গায়ে যে আলো তাতে কোনও
কেচ্ছা নেই টুপিওলা মাথার। কিন্তু যে যাদুকর জানলা থেকে
ধোঁয়া পাঠাচ্ছে তাকে ধরবে বলেই দেয়ালের জলছবি ছুটলো

পিছনে টেবিলক্লথ ভারী দেরাজ কাঠের নব এমনকী
আপেল-কাটা-ছুরি অব্ধি দৌড়ুচ্ছে। সরাই-এর মালকিন
যার নির্বোধ স্তন আর চোখ দুটোই কেবল এককোণে জেগে

ঘরময় বিয়রবোতল আর রাত-মেয়েদের বুক ও যোনি আলাদা
আলাদা নাচছে। মা-কসম ছেলেদের ওসবও

যাদুকরের খোঁজে আমার হাত টাটকা রাংসুদ্দু উড়ে যাচ্ছে শূন্যে” (রাং / সাঁই আমাকে ওড়াও)

সমীরণ ঘোষের গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘সব নিঃশেষে নামছে’ – ‘সাঁই আমাকে ওড়াও’ কালপর্বেই রচিত এক বোধিপ্রাপ্ত ভাষাশিল্পীর আলেখ্য, যিনি অবিরত কাব্যধারাপ্রবাহের মধ্যেও অচঞ্চল, স্থির দেখতে পান নিরাবরণ নিরাভরণ সময়সত্যকে, স্বতঃউদ্ভাসে বলেন “কালো মেয়েরাও লেখো, কালো শব্দ, কালো মাংসের ভাষা পথময় / …… কালো মেয়েরাও বাঁচো, কালো বাঁচা, সভ্যতা চমকে ওঠে ধাতুর আগায়/ দেহ দিয়ে লেখ, লিঙ্গ দিয়ে বর্বরতা দিয়ে, লেখো শেষের কবিতা”। ঐকান্তিক উচ্চারণে ‘হতে-চাওয়া-কবি’ প্রজন্মের কাছে অক্লেশে উপুড় করেন নিজস্ব বৈভব – কবিতাসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার হদিশ লিখে রাখেন পংক্তিতে পংক্তিতে —

• “… এই তো আলোর ঝিম, হাশিশগন্ধের/ পাতা খোলো, ভাষা খোলো, শব্দের কুয়োয় নেমে যাও/ এত অন্ধকারের ডানা / গান হচ্ছে অস্থি-বেড়ায়। চকমকি জ্বলছে …”

“শব্দ কবির কাছে সজীব মানুষের মতো; কোনো-কোনোটি তাঁর চোখের সম্মুখে ত্রিমাত্রিক ও শরীরী হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তিনি অনুভব করেন তাদের গায়ের গন্ধ, স্পর্শ ও ঝংকার। …ঝংকার বলতে এখানে আমি বুঝি শব্দের শ্রুত সংগীত নয়, তার চামড়ার যে সুস্বর, গন্ধ ও রঙের মত লেগে থাকে, তাই-ই” – লিখেছিলেন চল্লিশের কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী। ২০১৬-য় প্রকাশিত, সত্তরের কবি সমীরণ ঘোষের ‘চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান’-এর কবিতায় রমেন্দ্রকুমারের এই উচ্চারণের বিস্তার – শব্দযুগ্ম প্রয়োগের অভাবনীয়, স্পর্শ এবং ঝংকারের তুরীয় বাঙ্ময়তায়…

• “… তবু পেরোতে চাইলাম চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান/ মর্মঅধিকহাঁস বিন্দুবিহ্বল মুছে যায় …” (মুণ্ডমায়া)
• “… দেহ-দেহ সূর্য ওঠে, দেহ-দেহ চন্দ্র ওঠে/ দেহে ডোবে দেহের মিনার” (ভ্রমণ)
• “… খোঁড়ে তোলে কৃষ্ণপ্রবলভোর/ খোঁড়ে তোলে সুড়ঙ্গনিবিড়ঘনকাল/ তুমিও আভোগ, আমি মুখ্রার বর্ণনিহিতদ্যুতি…” (সংগীতশিক্ষা)

নিভৃত আলাপচারিতায় সমীরণ কখনো বলেছিলেন, “দ্বিতীয় খণ্ডে আরও অনেক মথিত ভাবে যেতে চেয়েছি। তবু সেই সংশয়, কতটা পারলাম জানিনা।” স্রষ্টার সংশয়কে ধ্রুবক ধরে নিয়ে পাঠকের যাবতীয় পরিশ্রম নিঃসংশয় হওয়ার, যে, কবিকে তিনি ঠিক ঠিক পড়তে পারছেন; নিজেকেই পুনঃ পুনঃ সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানোর দায় স্বীকার করার। ফলত, এক-একটি লেখায় দুয়েকটি নবদিশার উন্মেষ হওয়া আশ্চর্যের নয় ।

‘চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান’-এর ‘সংগীত শিক্ষা’ কবিতাটির পাণ্ডুলিপিতে, যুগ্মশব্দে সমীরণ ঘোষ যখন লেখেন –

“… বিবাহে অরাজি, তবু তনুস্নান
মুদ্রাদুই আরোহে অনন্তে মুছে যায়…”

এবং অনির্দিষ্টকারণবশতঃ, প্রকাশিত বইয়ে পাঠক যখন পড়েন —

“… বিবাহে অরাজি, তবু তনুস্নান
মুদ্রা – দুই আরোহে অনন্তে মুছে যায়…” তখন পংক্তিটির দ্বিতীয় সম্ভাবনার অদৃশ্য দরজা খুলে যায়না কি !

এই বইয়ে ‘চৌষট্টি আশমান’কে অবলীলায় ‘চৌষট্টি হাজার আশমান’-এর দ্যোতনা দিয়েছেন কবি সমীরণ ঘোষ; নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতাযাপনপথের এক আনোখা নজরমিনার, আর বাংলা কবিতা যেন সেই ‘ইলিয়টিও ট্র্যাডিশন’-এর পরম্পরায় পেল তন্ত্রসুফিবাউলতত্ত্ব-অধিক দেহজ কবিতার এক আলোকিত বাতিঘর। আগ্রহী পাঠক এই ‘অধিক’ কে অবিনির্মাণ তত্ত্বের ‘diffarance’-এর আয়নায় দেখতে চাইলে, অধ্যাপক গায়ত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক-এর ব্যাখ্যায় পৌঁছে — “যা মৌলিক তা প্রাথমিক নয়, নিজের স্বাতন্ত্র সে চিহ্নিত করে আর সব অন্য কিছু থেকে” — আবার ফিরে এসে দাঁড়াবেন সমীরণ ঘোষের ‘শেষের কবিতা’য়, “ছেড়ে দিলে প্রজাপতি হয়ে মরে যাবো, মথ হয়ে, স্বর্ণগোধিকা/ তোমার রাত্রির পাশে, ঊষাপ্রয়োগের পাশে একান্ত ভ্রমর/ ঘুরে ঘুরে পাহাড়বন্দরজনপদ, ধুলোয় ধুলোয় মুছে যাবো/ মাতৃগর্ভহীন শেষের কবিতা”।

আলোচনার অবকাশ খোলা রেখে, কোনও শিল্পীর সৃষ্টির ‘ঘনত্বের’ একটি আপাত-সরল hypothetical extrapolation-এর প্রবর্তন করা যায় যদি, তাহলে দেখা যাবে, শিল্পীর ‘দেখা’ x-axis, ‘নির্মাণ’ y-axis, এবং তাঁর ‘খোঁজ’ z-axis ধরাই যুক্তিযুক্ত। বলাইবাহুল্য, এই তিনটি অক্ষের মিলনবিন্দু ‘সময়’। ‘hypothesis’-এ ১ম অক্ষ ‘দেখা’-য় শিল্পীর চেতনা ও মননের প্রায় হাত ধরাধরি করে থাকে ‘দর্শন’ – যে দর্শনের উপস্থিতি – কবিতায় – বিনয় মজুমদারের কথায়, “একেবারে প্রত্যক্ষ না হলেও চলে, হয়তো তার আভাস-মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাস হোক আর যাই হো্ক, উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন”;
২য় অক্ষ ‘নির্মাণ’–এর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পীর মেধাস্নিগ্ধ সংহত, সংযত আবেগ; আর এর যে ৩য় অক্ষ – ‘খোঁজ’ – সেটিও ‘non-linear’ – সরলরৈখিক নয় ।

শিল্পীকবি সমীরণ ঘোষের রচনাকে এই hypothesis এর আলোকে একটু বোঝার চেষ্টা করলেই পরিস্কার দেখা যাবে কবির শ্রমণ রেখচিত্রটি । ‘চৌষট্টি আশমান’-এর একবছর আগেই, ২০১৫-য়, তিনি পেরিয়ে যাচ্ছেন, প্রকাশ করছেন, তাঁর ‘অন্তর্বর্তীরেখা’, আত্মপ্রশ্নে বিদ্ধ হতে হতে – “বেলা কি গড়াচ্ছে ! বেলা কি ছুরির নীচে স্বাদ নিচ্ছে নিজস্ব জিহ্বার/ আমার কি আদৌ কোনো কথা যুক্তিপূর্ণ হবে না এই অনার্য ভাষায়…” (জং) ।“…আমি কি প্রস্তুত ! সেই প্রশ্নে উথলে উঠছে চুলা …”। “…আমিও আমার কক্ষে পৃষ্ঠাবৎ ক্রমেই উড়ছি/ যদি কোনো সূত্র খোলে নিজেকে দেখার …” (অভিযাত্রা)। “একটু জোরে হাঁটলেই ব্রিজটা পেরুনো যেত/ কিন্তু একটা পা কোথায় যে হারিয়ে এলাম…”; “… কী করে বুঝবে, তুমি নও, তোমার ছায়ায় কেউ রক্ত মেখে বসে…”। “… আর কার জন্যই-বা লিখবে ! কেন লিখবে ! কীভাবে …” (অন্তর্বর্তীরেখা) ।

সত্তর দশকের চেইয়িনী (নেটিভ আমেরিকান) কবি ল্যান্স হেন্সন বলেছেন “… when a poem works; when it speaks; it speaks to the world and the world hears it. The humanworld hears it. There is no age you can attach to that poem….when poems are powerful enough, they move withn their own space and connect to time….”। এবং সত্তরের আর এক বাঙালী কবি সুধীর দত্ত বলছেন, “কবিতা হোল শব্দ স্থাপত্য – জার্মান কবি গ্যেটে যাকে বলেছিলেন – Frozen Music…”। গোলোকায়নের প্রকোপে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর দুইপ্রান্তের ভাষাসাহিত্যে, সমসাময়িক এইদু’টি আপাত-ভিন্ন ভাবনাস্রোত যে বিশ্বকবিতার বিবর্তনের ধারায়, একটিই প্রবাহের ইশারা, সেটি, সকল সার্থকতার সঙ্গে ধরা থাকল কবি সমীরণ ঘোষ-এর ‘চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান’ আর ‘অন্তর্বর্তীরেখা’র কবিতায় …

“ফিরে এলো বালিকার বেণী। ঘানিগ্রাম। মহামাতৃলোক
একচক্ষুকদম মায়ামুকুরের পাশে হতবাক, খুঁড়ে-খুঁড়ে রাত্রি তুলছে
ওই তো আতপ্ততাঁত ঝরনাজলে বাজালো কঙ্কণ। মোহানাজর্জরখুলি
হাঁ-মুখ অস্থি থেকে দূর পুরাকাল আর নশ্বর ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে
হয়তো মনসাগাছে শয্যা বুনবে মৃতসাপ। বাঁশি আর রাত্রিধুতুরা
নাচে। শূন্যে হাড়ের চাঁদ আবছা মহিষের সিং। ভাবি মা এসে
বাড়াবে স্তন অশ্বত্থের নীচে। রক্তপুঁজএকাকার পৃথ্বী দেখছে
এত চিত্ররূপ। দেখছে মাদকনিশি, বস্তিসন্ত্রাস, সভ্যতার তীরে
জাগা নির্বিকার যৌনশলাকা

যদিও হত্যার ভাষা ব্যাপ্ত উদ্বেল। জাগে সূচনাপৃষ্ঠায়
ঝরাপাতা মরাপাতা কী-জানি-কী ইঙ্গিত রাখে
অস্পষ্টকুসুমে আর দূরের টিলায়” (রাত্রিধুতুরা/ চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান)
———————————————————

“যেটুকু দুলছে ওই গ্রহের আদলে
আমি তার হ্রস্ববর্ণ মাটিতে বসেছি
আমি তার প্রবীণ কোষের ঘুমে
ফিরে আসা সোঁতার আড়াল

নীচু আর যে-তরঙ্গ আলোর
তারও নীচে হয়তো শুক্রযান। আগে আগে
একটি গোলকপ্রায় বায়ুর বৃত্ত

যখন প্রবেশ, এই ঘাত তীব্র আর অসমাপ্তগামী
আমার সাঁতার শুধু কালক্রম দীর্ঘতর হল” (সম্মোহন ২ / অন্তর্বর্তীরেখা)
——————————————————-

“কখনো ছিলাম ।

দিগন্তরেখায় নেমে গোধূলির বর্ণপরিচয়

পাতা ওড়ে পাতা ওড়ে

আর হ্যাঁ, আমিও ছিলাম” (ভ্রম / চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান)

——————————————————-

“আমি কি ফুরোবো
আমি কি ফুরোতে পারি
আমি কি ফুরাই

বৃত্ত ছড়ায় জলতলে
বৃত্ত মুছে যায়
আরও এক শান্ত হাওয়া
ত্রিপথ-তরঙ্গ তোলে
গহনগুঞ্জর

নিভি শুধু অস্তলোপ

আর জাগি
জীবাশ্মতিমিরে” (অনন্ত / চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান)
———————————————————-

“পুরো অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই হয়তো বাড়িটা দেখব
যার ভাঙা দেরাজের ওপর লোমহীন বেড়াল খ্রিস্টপূর্ব
অন্ধতা নিয়ে বসে
খুব প্রত্যয়হীন গানই হয়তো প্রয়োজন। যেন তার সাথে
বিন্দুমাত্র ভাববিনিময় হয়। আর শরীর থেকে সমস্ত ভয়
মুছে ফেলতে বাজাতে থাকব ঝুমঝুমি-সাপ
বাজাব গ্যারেজের জংধরা লোহা, শ্যাওলাময় আদ্যিকালের
কোনো চেলো
আমাদের না-ফোটা চোখে চামচিকে উড়ে উড়ে অজানাকালের
রাত। আমি ও বেড়াল কুলুঙ্গির কোণে
গেঁথে যাব আদিগন্ত হাড়ের মকান” (আলাপ / অন্তর্বর্তীরেখা)

———————————————————-
২০১৮ থেকে ২০২০ সময়পর্বের লেখালেখিতে, জাগতিক চলচ্চিত্রের অনিঃশেষ ছায়াছবি পরম যত্নে প্রাণে ধারণ করে সংবেদনশীল একটি মন ও মননের আলোর ঐশ্বর্যে, ধীরে ধীরে অতি-জাগতিক মহারহস্যের কালোর মধ্যে প্রবেশ করলেন কবি সমীরণ। পিলসুজাসীন ‘শুকনো’ আলোর নিচের অংশটুকুর কাঁপা-কাঁপা অন্ধকারের স্বরলিপি আর কালো গান শুনলেন মনোযোগী কবি, শুনলেন “বালির ওপর ওই গুহ্য প্রাচীনস্বর তপ্ত আর বিষণ্ণ রেখায়”। স্বগত চিৎকারে উথলে উঠল তাঁর সংকেতময় লেখা। একে একে পাঠকের সামনে এলো পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ; ক্রমশ খুলে যেতে থাকলো magic-realism-এর আশ্চর্য রূপরেখা। ‘কালো পাথরের হারমোনিয়াম’, ‘মরচে গোধূলির পাঠ’, ‘হাড়ের দূরবিন’, ‘মরিচগন্ধের সেতু’ ও ‘হাতআয়নার ঘুম’ যেন সমীরণের স্বরচিত সোপান, নিজের কেন্দ্রে নেমে পড়ার বা উত্তর-আধুনিকতায় উত্তরণের, অথবা — দুই দিক থেকেই ভিতরের দিকে যাত্রার, মহাজাগতিক আলো-অন্ধকারে, “… আমাদের পুথির জীবাশ্ম/ স্তন থেকে যোনি থেকে আলো ফেলা সুদূরকালের মেয়ে/ ঘানির অতলে ওই ভুরভুর করছে মহাপ্রাণ/ কালো পাথরের ঘরে কাচের হারমোনিয়াম/ গানসুদ্ধু ভেসে যাচ্ছে অপরিনাম শিসে” (সাত/ কালো পাথরের হারমোনিয়াম)।

জার্মান দার্শনিক হাইডেগার বলেছিলেন, ‘‘ভাষা কবিতার উপাদান নয়, বরং কবিতাই ভাষাকে সম্ভবপর করে।’’ সমীরণ ঘোষের কবিতার সামনে এসে এই উপলব্ধির অন্দরমহল দৃশ্যমান হয়, “শুশুক আকুল। আমিও হেস্তনেস্ত। একই পাত্রে রাখি লবণ গন্ধক/ শূকর ও গোমাংস। ভাবি দ্বিতীয় মীমাংসার আঁশ কীভাবে/ সরাব এত সংশয়নিশ্চলকায়মনে…” (১৩/ মরিচগন্ধের সেতু) । কখনোবা, তিনি ছুঁয়ে থাকেন উচ্চারণের শ্রদ্ধাশীলতায় সুদূরের মহাপ্রাণকে, “ট্রাঙ্কের অতীত থেকে তোমার সন্ধান আজও ন্যাপথলিনের গন্ধে অবিরাম/ তোমার ভ্রমণ যেন পাল্লার আলতো ভেজানো ছায়াপথ” (দশ/ কালো পাথরের হারমোনিয়াম); আবার কখনো তাঁর লেখনির পরতে পরতে ‘বোধি’র ব্যাপ্তিতে বুঁদ হতে থাকেন মগ্ন পাঠক, “…চোখ বন্ধ করে বলা যায় দুটো ট্রাক লোহার দরজা ভেঙে/ ঢুকেছিল প্রশান্তির দিকে/ কিসের প্রশান্তি! যা বিন্দুতে জেগে অবাক বিন্দুতে/মিশে যায় !/ মৃত্যু জন্মায়, আর জন্ম মৃত্যুতে নামে/ কালোমেয়েরা আবার ফিরে আসবে অচেনা ক্ষতের কাছে/ আর এটাই ঘটনা/ ঘোড়াও তৈরি, পিঠে বহ্নিমান অঙ্কুরের ডানা” (ফেরা/ মরচে গোধূলির পাঠ)।
২০১৯-এ প্রকাশিত সমীরণ ঘোষের ‘হাড়ের দূরবিন’-এর প্রেক্ষিতটি চমৎকার বিশ্লেষণে ধরেছেন ‘কবিতাসংগ্রহ’র ভূমিকায়, শূন্য দশকের উল্লেখযোগ্য কবি ও গদ্যকার পার্থজিৎ চন্দ, “এক থেকে চার-লাইনের মধ্যে ধরে রাখা সংকেতময় উচ্চারণ। রুহু ও সমা-র মধ্যে পড়ে থাকা রহস্যময় ক্ষেত্র। সেই রহস্যময় ক্ষেত্রটিকে যেন খুঁজে পেয়েছেন এক সাধক” – স্রষ্টা ও সৃষ্টির এমন apt analogy পাঠকের উৎসাহ বাড়িয়ে তোলার কাজ করে চলে নিশ্চিত; পাঠককে সটান আহবান জানায় পাঠ্যের ভিতরঘরে…
———————————————————————-

“হাড়ের নৌকোয় এসে তোমার ক্ষমার কথা মনে পড়ে” ( মৃতনগরীর ভাপ- ছয়/ হাড়ের দূরবিন)

———————————————————————-

“রাত্রি দু’ফাঁক হয়ে আমাকে নিয়েছে
কালো পাপড়ির মধ্যে ওই বিপুল গর্ভদণ্ড। শূন্যে এসেছি
এ-দেহ পরাগপুঞ্জ
ছায়াপথে লুপ্ত হয়ে যায়” (কালো পাথরের দেশ- আঠারো/ হাড়ের দূরবিন)

——————————————————————–

খুঁড়ি। একটা আঙুল যদি। ভস্মশেষ মুখ তোলে হাড়ের আভায়” (কালো পাথরের দেশ- কুড়ি/ হাড়ের দূরবিন)

——————————————————————–

সমসময়ের বাংলা কবিতার তথাকথিত মূল ধারার সমান্তরালে, বাজারবিমুখ এক নিভৃতচারী শিল্পীকবির নিরলস শ্রম-সাধনার পিঠোপিঠি, নিজের লেখাকে পৌনঃপুনিক ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলশ্রুতিতে বাংলা কবিতার যে প্রাপ্তি, সে এক অত্যাধুনিক অননুকরণীয় সমীরণসম্ভব কাব্যভাষা। ‘হাতআয়নার ঘুম’ থেকে ‘সান্ধ্যবৈঠক’ হয়ে ‘স্ক্র্যাপবুক’-এ তাঁর সেই কাব্যভাষার যে উড়াল — অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে হতেই পারে সেটি ‘chaotic’ অথবা ‘kafkaesque’। কিন্তু, পেশাগত জীবনে প্রকৌশলী ছিলেন যে সমীরণ, তার থেকে কে আর ভাল জানবেন, কেওস থেকেই হারমনির সৃষ্টি ! আর Franz Kafka ! বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই চেক-জার্মান বোহেমিয়ান লেখক যে আজও প্রাণিত করে চলেছেন হালের সাহিত্য-প্রয়াসীকে! “I am constantly trying to communicate something incommunicable, to explain something inexplicable, to tell about something I only feel in my bones and which can only be experienced in those bones.” (Letters to Milena) ফলত, প্রতি-তুলনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারলেই কবিতার প্রকৃত রসাস্বাদনে ব্রতী হওয়ার দরজাটি খুলে যায় পাঠকের সামনে…

“ধাতুর ছিলকে চুলে বিলি কাটি। হাত জ্বলে যায়/ কবেকার শেওলাসিঁড়ির দিকে গোধূলি ঠেলছো/ জ্যোৎস্নার ফেঁসো উড়ে মৃত খিলানের শ্বাস। ভাঙা/ ধাতুর নূপুর। মাংসের অনেক নীচে বিবাহের শীত/ ফোঁপরা ব্রোঞ্জের চাকে কাঁটাপোঁতা ঘুমের আকাশ/ তারও নীচে নৌকো দুলছে। পাশে সমাধির ছোট্ট কোটর/ রাত্রি নেমে হাড়ের আঙুলে উঁকি দেয়” (চেলো/ হাতআয়নার ঘুম) ।“স্তূপের পুতুলে গান। মাটির মাছির/ চোখের দু’ফোঁটা সা/ অস্তহীন। জবার প্রাচীন” (সান্ধ্যবৈঠক – ১০০)

‘সান্ধ্যবৈঠক’-এর কবিতায়, তিন পংক্তির সুরের কাঠামোয় ঠাট জুড়েছে ‘গান’। ঠিক যেন ১০০টি বাক্-প্রতিমা গড়েছেন সমীরণ; যত্নে মুছেছেন উপমান আর উপমেয়র ভেদাভেদ, শব্দের পরমে। কী-এক অলৌকিক জাদুস্পর্শে ‘গান’ — চরিত্র হয়ে উঠেছে এক সাধক শব্দ-তৌলিকের সান্ধ্যবৈঠকের লিখিত ভাষ্যে —

“গানের দোলনা থেকে পাখি ওড়ে/ পাখির পেতল/ সিঁধকাটা। লোহার আকাশ” (সান্ধ্যবৈঠক – ১৯)

“ইশারা চোখের জল/ গানের জাজিম/ কোচাচ্ছে এক কোণে” (সান্ধ্যবৈঠক – ৭৯)

“নোনা রাতের ঝিনুকে ভাঙা আরবিখিলান/ ঘোড়ায় ধাতুর গান। খুরের সুদূর/ দীর্ঘনিথর ঝাঁঝিপথ”
(সান্ধ্যবৈঠক – ৯২)

“You will call a poem a silent incantation, the aphonic wound that of you, from you, I want to learn by heart.” যেমন বলেছেন ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা — তেমন দু’টি কবিতা পড়তে পড়তেই নাহয় ইতি হোক এই আলোচনার।
সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকদলের গীতিকবিতাসূত্রে যে ভাষার জন্ম হাজার বছরের ওপারে, আজ এইসময়ের এক কবিতাসাধকের বোধ ও বোধির তানাবানায়, শব্দযুগ্ম সৃজনের অবিস্মরণীয় সন্ত্রাসে, সে ভাষা এগিয়ে যাক অজানা কক্ষপথে; আর বাংলাকবিতাবিস্ময় শ্রী সমীরণ ঘোষ – ‘আমি ও শুশুক’-এর বাক্-মুখরতায় হোক বা ‘মাষ্টার ও কুকুর’-এর রূপকার্থের কথামালায়, বা অন্য কোনো জাদু-ক্যানভাসে; কৃষ্টির মহাজাগতিক অনিত্যে এঁকে চলুন তাঁর নিত্য কল্পকাব্যদৃশ্য, গাইতে থাকুন সৃষ্টির নিঃশব্দ ব্যথার গান…

“সা পর্যন্ত সকাল। কান বেজে লাল হচ্ছে
মা কোমলের। মৃত দুই দেহের আধান
আকাশ মোচড়াচ্ছে মৃত স্বরের বয়ান” (সান্ধ্যবৈঠক – ০২)

“লাল আলোর ছুরিতে চেরা হস্তিনীপুর
তুমিই কোড়াচ্ছি। ছিপছিপে। গানের মাসিহা

ডান বোঁটার সন্তাপ। বাঁ স্তনের শাগাল
কাটা মণির নৌকো ছোটে তুলোর প্রচণ্ড বায়ুচাপে

তুমিই কোড়াচ্ছি। ভাষার মাংস। হাড়ের হাতায়
স্তুপের নিতম্বে পাখি। ঠোঁটে রপ্ত করছে কালো সুর
স্লেটপাথরের শিস কাজুরি বসাচ্ছে খাঁজে খাঁজে

যোনিও কোড়াচ্ছি। তামার কঠিন স্তব
নীচে সূর্যাস্ত গড়ানো দুই রাং” (অভিবাসন/ স্ক্র্যাপবুক)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes