কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি কবিতা এবং আমার ভাবনা
শীর্ষা
শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় – বাংলা কাব্যজগতে এই দুটি শব্দকে অনেকভাবেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন প্রকৃতির শরীরে ফুটে ওঠা জীবনের ছায়াকে খুঁজে পাওয়া এক কবি। অথবা বলা যেতে পারে বিষাদকে পানের তবকে খিলি দিয়ে পুড়ে গলাধঃকরণ করা এক নীলকণ্ঠ। কিংবা, সামগ্রিকভাবে, আবহমান কাল ধরে যাদের কলমের আঁচড়ে আমাদের জীবনের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের চোখে, ইনি তাদেরই একজন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের যে ছন্দমিল, তার সরগমই ফুটে ওঠে কবির শব্দে। সেই অর্থে বলা যেতে পারে তিনি একজন প্রকৃতিসাধক। কোথাও তিনি আমাদের হৃদয়ের অন্তর্নিহিত একাকিত্বকে কুয়াশামাখা মাঠের নির্জনতা দিয়ে এঁকেছেন। আবার কোথাও আমাদের আদিম অনুভূতিগুলোকে মিশিয়ে দিয়েছেন নিসর্গের একান্ত সুরে।
আমার একটি প্রিয় কবিতা (‘কুয়াশার ভিতরে মানুষ’) দিয়েই শুরু করি –
“কুয়াশার আড়ালে মানুষ, তার ভিতরেও রয়েছে কুয়াশা –
অস্পষ্ট অচেনা গাছ যেন দূরে, শীতল সকালে। ”
মুগ্ধ হয়ে যাই কবির অনুভূতি বোনার শিল্পে। কুয়াশার আড়ালে থাকা মানুষটির অন্দরমহলও যে কুয়াশার চাদরে মোড়া – এই ঝাপসা অথচ রূঢ় বাস্তবটিই পাঠককে কবিতাটির অন্দরে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। শীতলতামাখানো একটি সকালে একটি গাছ যেরূপ অচেনা, আবছা, একটি মানুষের হৃদয়ও যেন তেমনই। তেমনই কুয়াশাজড়িত। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নিপুণ কারুকাজ যেন মিহি সুতোয় বোনা আছে সেই কুয়াশাচাদরে।
“হিমসাদা কুহেলিতে মাঠের নির্জনে তাকে দেখি
বড় একা। তার চোখে দূর-নিরীক্ষণে বুঝি আমিও অস্পষ্ট হয়ে যাই?
পৃথিবীতে সব কিছু ছায়াছায়া – কুয়াশার জলে ভাসা-ভাসা।”
একটি মানুষের হৃদয়ে যে একাকিত্বের বাস, যে বৈচিত্রহীনতার মাখামাখি – কবি তাকেই তুলনা করেছেন হিমসাদা কুহেলির সঙ্গে। মাঠ – যেন একটি মানুষের বিস্তীর্ণ সীমাহীন অন্তঃপুর। কোলাহলশূন্য খাঁ খাঁ স্তব্ধতা পায়চারি করে একা একা। আর তার ধূসর ঝাপসা দুটি চোখের দৃষ্টিশক্তিকে ক্ষীণ করে তোলে বিষণ্ণতার জল। যেন কবিকে অস্পষ্ট করে তোলে। সমগ্র পৃথিবীর মুখই যেন এরূপ – “ছায়াছায়া”, “কুয়াশার জলে ভাসা-ভাসা”। আলোহীনতা, রংহীনতার শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর মুখে। শিরা-উপশিরার মতো। বয়ে নিয়ে চলেছে আদিম নির্জনতার নিরুত্তাপকে। এই পংক্তিটি পড়ে পাঠকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে – কবি নিজেই কি সেই মানুষটি? জীবনের কুয়াশায় কবি কি নিজেকেই দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন? তারই প্রতিফলন কি পরের শব্দগুলি – সর্বত্র ছায়া ছায়া, ভাসা-ভাসা পৃথিবীর অবয়ব?
পরবর্তী পংক্তিগুলিতে কবি কুয়াশার রূপক দিয়ে বিষণ্ণতার একটি সামগ্রিক ছবি এঁকেছেন –
“লোকালয়ে আছে আরও শৈত্যভাব – পাথরের যেন হিমঘর –”
এই পংক্তিটি থেকেই ফুটে ওঠে কোলাহলের মধ্যে নির্জনতার স্পর্শ। মানুষের পারস্পরিক উষ্ণতার মধ্যেও যেন একটি পাথরের হিমঘর বাস করে। বৈপরীত্যটুকুই ধ্রুব সত্য হয়ে ধরা দেয়। “নকশালতা পাতাফুল টিয়াপাখি প্রজাপতি” যাবতীয় শিল্প থেকে, কারুকার্য থেকে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়াল থেকে উঁকি দেয় “ছাই-ছাই” কুয়াশার গুঁড়ো গুঁড়ো ভিড়। সাবেকি ধূসর উষ্ণতাহীনতার আঁচ – চিরন্তন! আর সেই পাথুরে শীতল খাঁচার মধ্যেই মানুষ নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে “সোনাকাঠি রুপোকাঠি” নেড়েচেড়ে আশার প্রদীপ জ্বালানোর।
“মানুষের ভালোবাসা সন্ধ্যার উঠোনে বসে ছোট-ছোট অগ্নিকুণ্ড জ্বালে:”
জ্বালতেই থাকে। মানুষের ক্রমাগত প্রচেষ্টা চলতে থাকে দীর্ঘায়ু কুয়াশাকে হারানোর। হয়তো সফলও হয়। মানুষের বাইরে যে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে রাখে তাকে, তা ক্রমাগত পাতলা হতে থাকে। একটা ঘূর্ণির মতো তা বাইরে থেকে ঢুকে পড়ে মানুষের বুকের ভেতর –
“গোল হয়ে ঘিরে আসে আরও ঘন কুয়াশার স্তর।”
আমার দ্বিতীয় প্রিয় কবিতাটির নাম ‘পাখি’। এই কবিতার প্রথমাংশটিতে একটি পাখির খোঁজ ফুটে ওঠে –
“পাখিটা কোথায় বুঝি চলে গেছে? আশ্চর্য স্বভাব!
দেবদারু গাছে ছিল একদিন ব্যস্ত আসা-যাওয়া:
মাটিতে রঙিন স্মৃতি ঘুরন্ত পালক ফেলে
তারপর আড়ালে সরেছে?
কী এমন অস্থিরতা তার?
বিকেলে ঝড়ের মেঘ কালো হাওয়া উঠেছিল আকাশের কোণে?”
একটি পাখির নিছক চঞ্চলতা দিয়েই কবিতার ঊর্ধ্বাংশটিকে তৈরি করেছেন কবি। আশ্চর্য চঞ্চল স্বভাবের পাখিটির রঙিন আনন্দময় স্মৃতির টুকরো মাটিতে ছড়ানো – এ যেন জীবনের রঙিন সময়গুলির এক আশ্চর্য প্রকাশ। জাগতিক সুখের কিছু খণ্ডচিত্র। এই সমস্ত চাহিদার সাফল্যকে তুচ্ছ করে পাখিটি নিজের অস্থিরতাকেই প্রাধান্য দিয়ে ফেলল? – এই প্রশ্নটিকে অনুসরণ করে তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায় কবির মনের অতলে এক অস্থির অতৃপ্তির বাস। যে অতৃপ্তির চঞ্চলতায় ব্যর্থ হয়ে যায় এযাবৎ জীবনের সমস্ত রং। ঝড়ের মেঘের মতো বা কালো হাওয়ার মতো এক দুরন্ত মাতলামি এসে ছিন্নভিন্ন করে তোলে কবির সত্তাকে। এই পাখিটির রূপকে কবির নিজস্ব অস্থির সত্তাটির দামাল মানসিকতাই ঘোরাফেরা করছে কবিতাটিতে। আর এই অস্থির স্বভাবটিকে যেন পরিচালনা করছে এক অদৃশ্য অতৃপ্তির জাদুকর। কবিতার দ্বিতীয় স্তবকটি পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাখির অবয়ব খসিয়ে বেরিয়ে আসা অস্থির মানুষটির ছবি –
“রাস্তা দেখে ফিরে আসি – আরও গলি – সন্ধ্যার বাসায়
গ্রামোফোনে পুরোনো রেকর্ড বাজে, সচকিত দুঃখ বাজে মনে:”
– কবিতার এই অংশে অত্যাশ্চর্য একটি উপমা দিয়েছেন কবি। গ্রামোফোনে বাজতে থাকা পুরোনো রেকর্ডের মতো পুষে রাখা দুঃখ যেন সচকিত হয়ে কবিহৃদয়ে তাঁর অস্তিত্ব জানান দেয়। এই ধরনের বহির্জগতের সঙ্গে অন্তর্জগতের মেলবন্ধনই কবিতাটিকে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। কবিতার শেষ অংশটি পড়লে নতুন এক চমক ধরা পড়ে পাঠকের চোখে –
“আশ্চর্য এবার
নিজের ভেতরে দেখি সেই পাখি –
খড়কুটো নতুন এখন!”
কবির অন্দরমহলে বন্দী সেই অস্থির পাখিটি তার চরম সত্তাকে জানান দেয় উদাত্তভাবে। রঙিন সময়কে মিথ্যা করে তোলে নতুন খড়কুটো দিয়ে। এই অংশে কবির অন্তর্নিহিত অতৃপ্তিটি প্রকাশিত হয়ে পাঠকসত্তাকে যেন একটি প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। পাখিটির রূপকে কবির এই চঞ্চল মনের ছবিটির উৎস এই লুকিয়ে থাকা অতৃপ্তিই – এই চরম সত্য পাঠককে আন্দোলিত করে। অস্থিরতার সুতোয় বোনা অতৃপ্তির এই খোলস আমাদের প্রত্যেকেরই সত্তায় বিরাজমান – কবির এই কবিতাটি এরূপ নিহিত সত্যেরই প্রতিফলকমাত্র।
কবির অন্য একটি কবিতা ‘লানটাও দ্বীপে পুরোনো বৌদ্ধমঠ’ পাঠ করলে কবিকে আরও গভীরভাবে চেনা যায়। বিষণ্ণতার নিস্তেজ সুর কতখানি যাযাবর সেজে ঘুরে বেড়ায় কবির সত্তায় – এই সহজ সত্যিটা ধরা পড়ে পাঠকের চোখে। এই কবিতাটির প্রথম পংক্তিটিই যেন এক নিরুত্তাপ বিষাদের ছায়া –
“তুমি চলে গেছো এক উদাসীন বুদ্ধমূর্তি রেখে …
ভালোবাসা ”
বুদ্ধমূর্তির এই উদাসীনতার মাধ্যমে কবি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? ত্যাগ ও বিষণ্ণতার মিলন? তথাকথিত ভাবধারায় বুদ্ধ বা ত্যাগ শান্তির প্রতীক রূপেই পরিচিত। অথচ কবি এই সাধারণ সত্যটিকে চিরে আরও কোন গহীন সত্যে পৌঁছাতে চেয়েছেন? ত্যাগের পথে শান্তির পাশাপাশি যে অতিপ্রাকৃত বেদনাগাছের বীজ ছড়ানো থাকে, কবি যেন তারই করুণ ইঙ্গিত দিয়েছেন এই পংক্তিতে। পরবর্তী পংক্তিগুলি অনুসরণ করলে আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে বিবর্ণতার এক সুস্পষ্ট চিত্র।
“চন্দনকাঠের কিছু প্রাচীন শিল্পের রূপছায়া” – বহুমূল্য চন্দনকাঠের মতো বহুমূল্য সম্পর্ক যেন একপ্রকার শিল্পই। অথচ ত্যাগ তাকে করে তুলেছে প্রাচীনের গন্ধে ভরপুর। বিবর্ণতার ধূসর রঙে ছোপানো। ভালোবাসার চলে যাওয়াটুকু বিবর্ণ করে তুলছে বৌদ্ধমঠকে, বৌদ্ধমঠের প্রতিটি উপকরণকে –
“বিবর্ণ এখন ফুলদানি,
দেওয়ালে সিল্কের ছবি, লতাপাতা, ড্রাগনের মুখ!”
এক নিস্তেজ বিবর্ণতাকে এভাবেই যেন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন কবি। বৌদ্ধমঠের প্রতিটি খাঁজে। কবিতার দ্বিতীয় অংশে আমরা আবার প্রাকৃতিক অন্ধকারের পরিচয় পাই, যা নির্জনতারই আরেক রং। “এখন সন্ধ্যার নীল পটভূমি।”
– প্রকৃতির এই বিশেষ সময়টুকুর মধ্যে দিয়ে কবি অন্ধকারকে আটকে দিয়েছেন কবিতাটির ফ্রেমে। আর প্রতিটি অন্ধকারই তো আলোহীনতার নাম। যতখানি আলোর অপর নাম রং।
“চেরীফুল ঝরে আছে প্রাঙ্গণে বিষাদ কিছু স্তব্ধ নীরবতা:” – পংক্তিটির মাধ্যমে সন্ধ্যা, বিষণ্ণতা ও নির্জনতাকে সুপরিকল্পিতভাবেই একই সরলরেখায় এনেছেন কবি। পরবর্তী পংক্তিটিও রংহীনতার পরিচায়ক। বিষাদের খাঁ খাঁ চিৎকার ফুটে উঠছে প্রতিটি পরতে।
“যাত্রীনিবাসের ছাদে রঙিন লণ্ঠন নেই,
ভাঙাসিঁড়ি থেকে
রজত ঘন্টার ঘরে ছুটে এসে হা-হা করে হাওয়া।
হঠাৎ জানালা খুলে শব্দ হয় কী যেন ভৌতিক!”
এই জায়গায় এসে স্বভাবতই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে – হাওয়ার হা-হা করা কি কবির শূন্য অন্তঃপুরের ছবিই তুলে ধরছে? যে ছবিটি শুধু কবির নয়, আমাদের সকলেরই গহীনের একটি পরম সত্য? এই পরম শূন্যতাই কি জীবনের একান্ত রূঢ় বাস্তব? হঠাৎ জানালা খোলার মতো ভৌতিক শব্দ কি আমাদের ক্ষীণ আশা? ‘ভালোবাসা’র আগমন কে সুনিশ্চিত জানার জন্য লণ্ঠন হাতে নিয়ে যাওয়া? শেষ পংক্তিতেই মাথা তোলে কবির সেই সুপ্ত আশার অঙ্কুর –
“চন্দনকাঠের সেই প্রাচীন শিল্পের অভিমান
ভালোবাসা
অন্ধকারে আছে।”
চন্দনকাঠের মতো মূল্যবান, প্রাচীন-শিল্পস্বরূপ সৌন্দর্যখচিত ভালোবাসা এখন অন্ধকারে আচ্ছাদিত। অভিমানের আচ্ছাদন খুলে ফেলার যে নিরুত্তাপ আর্তি অথবা বৌদ্ধমঠের সঙ্গে তুলনীয় যে স্তব্ধ জীবনের চিত্র কবি এই কবিতায় এঁকেছেন, তা সত্যিই কল্পনা-বহির্ভূত। গভীরভাবে ভাবলে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই যেন এক একটি বৌদ্ধমঠের নির্মাণ হয়। কখনো না কখনো। ত্যাগের পাথরে গাঁথা এই মঠের আনাচে-কানাচে খেলা করে বিষাদ এবং শান্তির যৌথ অস্তিত্ব – কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি পাঠককে এই অসাধারণ সত্যটিরই মুখোমুখি করে। আর এভাবেই কবি বাস্তব চাক্ষুষ জ্ঞানকে অতিক্রম করে নিজের স্থান করে নেন অতলান্তিক গহীনে।
কবি শীর্ষার আলোচনা ভালো লাগলো