কবিতা বিষয়ক ত্রিভাবন অনুবাদ <br />  অনুপ সেনগুপ্ত

কবিতা বিষয়ক ত্রিভাবন অনুবাদ
অনুপ সেনগুপ্ত

জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার ও আর্হেন্তিনার দুই কবি হোর্হে লুইস বোর্হেস ও রবের্তো হুয়াড়োসের কবিতা ভাবনার টুকরো গদ্যের অনুবাদ এটি। হাইডেগারের অংশটি নেওয়া তাঁর ‘অ্যান ইনট্রোডাকশন টু মেটাফিজিক্স’ গ্রন্থ থেকে। বোর্হেসের ক্ষেত্রে তাঁর ‘দি আনএন্ডিং রোজ়’ (লা রোসা প্রোফুনদা) কাব্যগ্রন্থের প্রোলগ বা প্রস্তাবনার নির্বাচিত অংশ। আর হুয়াড়োস ১৯৯৩ সালে উরুগোয়াই-এর মন্তেবিদেয়োতে কবিতা নিয়ে যে দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন তার একটির অংশবিশেষ।

| মার্টিন হাইডেগার |

দর্শন কখনোই বিজ্ঞান থেকে বা এর মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়নি। দর্শন কখনোই বিজ্ঞানের শ্রেণীভুক্ত নয়। বরং দর্শনের জায়গা উচ্চকোটির, আর তা বিজ্ঞানের যৌক্তিকতা বা কোনও তন্ত্রের সারণি অনুসারী নয়। দর্শন দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষেত্র ও বিন্যাসে। একমাত্র কবিতাই দার্শনিক চিন্তনের সমগোত্র, যদিও সেই চিন্তন ও কবিতা এক নয়। বিজ্ঞানের কাছে শূন্যতার আলোচনা সর্বদাই ভয়াবহ ও বেখাপ্পা ব্যাপার। কিন্তু দার্শনিক ছাড়া একমাত্র কবিই শূন্যতার কথা, অনবস্থার কথা বলতে পারেন। আর তা এইজন্যে নয় যে সাধারণ ধারণা অনুযায়ী কবিতার কোনও সুনির্দিষ্ট বিধি নেই, বরং এই কারণে যে কবিতার অন্তরাত্মা (শুধুমাত্র যথার্থ ও মহান কবিতা অর্থে) বিজ্ঞানের নিছক চালিকাশক্তির থেকে অপরিহার্যভাবেই উৎকৃষ্টতর। এই অনন্যতার দৌলতেই কবির উচ্চারণ সর্বদাই যেন সত্তাকে প্রথমবার প্রকাশ ও আহ্বান করে। দার্শনিকের বিভাবনের মতো কবিতায় সর্বদা এতটাই জগৎ-পরিসর যে এর মধ্যে প্রতিটা জিনিস – একটা গাছ, পাহাড়, বাড়ি বা পাখির ডাক সমস্ত গতানুগতিকতা ও তুচ্ছতা হারিয়ে জায়গা করে নিতে পারে।

… ভাষার উৎপত্তি বাস্তবিকই রহস্যময়। আর তা এই ইঙ্গিত দেয় ভাষার উন্মেষ হয়তো মানবতার আচমকা সত্তায়িত হয়ে ওঠার সেই বিহ্বল ও গা ছমছমে উৎক্রমে। এই উৎক্রমে ভাষা-সত্তা মূর্ত হয়ে উঠেছিল শব্দে: কবিতা। ভাষাই সেই আদিম কবিতা, সত্তাকে যেখানে কাব্যিক করেছিল মানুষ। বিপরীতক্রমে, যেসব মহান কবিতার মাধ্যমে মানুষ ইতিহাসে প্রবেশ করে, সে-সবই তৈরি করে জাতির নিজস্ব ভাষার ছাঁদ। গ্রিকরা এই কবিতার সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল হোমারের মধ্যে।

| হোর্হে লুইস বোর্হেস |

কবিতা দিয়েই সাহিত্যের সূত্রপাত। আর গদ্যের সম্ভাবনায় হাজির হতে বহু শতাব্দীর ব্যবধান। চারশো বছরের চর্চায় অ্যাংলো-স্যাক্সনরা এমন কবিতা রেখে গেলেন, শুধুমাত্র তা সময়বিশেষেই প্রশংসনীয় নয়, অথচ এঁদের গদ্য কোনোরকমে উৎকথিত। সূচনায় কবিতা অমোঘভাবেই হত কুহক-প্রতীক, সময়ের চড়া সুদে তা বিধ্বস্ত হয়েছে। অন্তত আংশিকভাবে হলেও সেই আদিম রহস্যময় শক্তিকে শব্দের মধ্যে পুনর্সঞ্চারের লক্ষ্য হওয়া উচিত আজকের কবির। সব কবিতারই দুটি বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত: জ্ঞাপনের যথাযথ দৃষ্টান্ত হবে এবং সমুদ্রতটে দাঁড়ালে ঢেউয়ের মতো আমাদের শারীরিকভাবে স্পর্শ করবে। ভার্জিল থেকে একটা উদাহরণ দিই:
Sunt lacrymae rerum et mentem mortalia tangent
(এই জগৎ অশ্রুময় আর নশ্বর যা কিছু হৃদয় স্পর্শ করে)

এবার মেরেডিথ থেকে:
না, এখনও চুল্লির ঝাঁঝরিতে আগুন মরেনি
তারাদের সঙ্গে আমরা কোনও সম্পর্কের প্রতীক্ষায়

অথবা লুগোনেসের এই আলেক্সান্দ্রিন, যেখানে লাতিনে ফেরার চেষ্টা করছে স্পেনীয় ভাষা:
El hombre numeroso de penas y de dias.
(যন্ত্রণা ও দিবসদগ্ধ বিরাট মানুষ)

স্মৃতির পথেঘাটে এইসব কবিতা হেঁটে-চলে বেড়ায়।

বহু – বহু বছর ধরে সাহিত্য চর্চার পর, আমি আর কোনও নন্দনতত্ত্বের কথা বলি না। স্বভাব যে স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা আমাদের জন্যে ধার্য করেছে, তার সঙ্গে আবার কেন তত্ত্ব বা ওই জাতীয় কিছু যোগ করা? রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকৃতির মতোই তত্ত্ব আসলে উদ্দীপকের বেশি কিছু নয়। প্রত্যেক লেখকের জন্যে এর রকমফের আছে। অন্ত্যমিল বর্জন হুইটমনের ক্ষেত্রে যেমন যথাযথ, কিন্তু এই নিরাকরণই ভিক্তর য়ুগোয় হলে নির্বুদ্ধিতা হত।

| রবের্তো হুয়াড়োস |

বাস্তবতার স্তরগুলো উন্মুক্ত করে কবিতা। বদলে দেয় জীবন, ভাষা, আত্মদৃষ্টি, জগৎ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা। বদলে দেয় সৃজন সম্ভাবনার প্রকৃত অন্তর্ক্ষমতা। কবিতা পার্থিবতা সৃষ্টি করে – সৃষ্টি করে উপস্থাপনা, বিদ্যমানতা। কবিতা এক বিস্ফোরণ – ভাষার নীচে সত্তার বিস্ফোরণ। কোনও কিছুর সমাপ্তি না ঘটিয়েই এই পার্থিবতার জন্ম। বাস্তবের সঙ্গে বাস্তব যোগ করে, জগৎ ও ভাষার পুনর্বিন্যাস করে, মানুষকে তার চরমে ঠেলে দিয়ে বাস্তবত্বের অতিপৃক্ততা সর্জনই আসলে কবিতা। আমাদের বিচ্ছিন্নতা, প্রশ্নোত্তরের অন্ধকারিত খেলা ভেঙে বেরিয়ে এক উপস্থাপনা কবিতায় ঘনিয়ে ওঠে। এইসব কারণেই কবিতা যতদূর সম্ভব বাস্তবানুগ, পার্থিব। কিন্তু অতিসরল, অজ্ঞ বা আহাম্মকরাই একে বিমূর্তন ভাবে। অথবা মনে করে রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত ঔদ্ধত্যের সহায়ক পরিবর্তনশীলতা এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল।

হ্যাঁ, যতদূর সম্ভব কবিতা বাস্তবানুগই হয়, কারণ তা বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত মানুষের শিথিল সম্পর্কগুলো এক-জায়গায় জুড়ে তাদের সম্মিলিত করে। তখন চিন্তন ও অনুভব এক হয়ে ওঠে। এক হয়ে ওঠে প্রেম ও প্রজ্ঞান। কিংবা মনন ও কর্মশীলতা।

প্রতারিত ও খণ্ডিত হয়েছে মানুষ। তাঁর কল্পনাসিদ্ধি, অন্তর্দর্শনের ক্ষমতা, মননশীলতা একসময় অসার অলংকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিন্তনের সর্বনাশা অলিন্দে আলাদা হয়েছে কবিতা আর দর্শন। আধুনিক কবির নিয়তি চিন্তা, অনুভব, কল্পনা ও সৃজনের ঐক্যে ফিরে যাওয়া।

এই কারণেই কবিতা আজ অমোঘ এক প্রয়োজনীয়তা, এক উদ্‌যাপন ও সীমালঙ্ঘন, একইসঙ্গে উজানমুখী ও রসাতলগামী। স্বস্তি, মাঝারিয়ানা, মতিভ্রম, অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা কিংবা আদেশাত্মক ক্ষমতার বশ্যতা স্বীকারের জায়গা নেই এতে। প্রবর্তিত কোনও মতবাদ বা ক্ষমতায়নের অনিবার্য আনুগত্য চাহিদার সঙ্গে রফার মাত্রা কতখানি তা বিচার্যই নয় এক্ষেত্রে। নিরর্থকতা-বোধের দেওয়াল ভাঙার জন্যে কবিতাই অন্তিম ফাটল। সেই মুক্তির অতন্দ্র পাহারাদারও।

কবিতা জগতের জরুরি বিশোধক। জীবনকে প্রকৃত ব্যঞ্জনা ফিরিয়ে দেয় সে। আর অনুশাসন, ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় আপ্তবাক্য ছাড়াই এই সংস্ক্রিয়া হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ জগতের প্রকৃত পবিত্রীকরণ করতে পারে কবিতা।

আর কবি যদিও অনুভব করেন তাঁর রাজ্য ঠিক এই জগতের নয়, কিন্তু একইসঙ্গে জানেন এটাই একমাত্র জগৎ নয়। তাই তাঁর নতুন জগৎ সৃষ্টি করা ছাড়া উপায় থাকে না – যে জগৎ এই জগতের থেকেও বাস্তব। এবং কবিতার সেই জগৎই হল আমাদের মুক্তির অন্তিম আশ্রয়। আমাদের রহস্যময় হয়ে ওঠার আবশ্যকতারও শেষ ঠাঁই।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)