এণাক্ষী রায়-এর গল্প ‘ সোনালি মহশির’
দূর থেকে এ-শহরে এলে ঢেউ খেলানো পিচের রাস্তার দুদিকে সরে সরে যায় ঝোপঝাড়, কখনও চা বাগান। আর সামনে রাস্তার ঢেউয়ের ওপারে নীল একটা পাহাড় ক্রমশ স্পষ্ট হয়। মনে হয় যেন খুব কাছে পাহাড়টা। কিন্তু যতই এগোনো যায়, পাহাড় অব্দি পৌঁছনো যায় না সহজে। পাহাড়ের গাছপালা বাড়িঘর স্পষ্ট হতে হতে ভুটান গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে যায়। পাহাড় থেকে নেমে আসা আমোচু শুধু সাক্ষী থাকে এসব দৃশ্যের।
আমোচু পাহাড় থেকে এঁকেবেঁকে নেমে এখানে এসে চওড়া হয়ে গেছে। নদীটাকে খুব ভালোবাসে সাধু। ওদিকের পাহাড়ের খবরাখবর নিয়ে যেমন ধরা দেয় কারমা , নদীটাও তেমন। কারমার কিরা পরা চেহারাটা সমতলে নেমে সালোয়ার কামিজে ভোল পালটে যায়। তখন আর কারমাকে সেই কারমা বলে মনে হয় না। এখানে জিনিসপত্র কিনতে এলে কারমার আঁটোসাঁটো কামিজের নিচে আমোচুর ঢেউ দেখতে পায় সাধু। কারমা দু-একটা কথা বললেই ধন্য মনে হয় জীবন। সেই কারমার পাশে বসে সাধু যে বেশ ক’খানা সিনেমা দেখেছে, ভাবলেও নিজের ভাগ্যে অবাক লাগে সাধুর।
কারমার পাহাড়ি চেহারায় সবসময় একটা ছেলেমানুষি ভাব লেগে থাকে। হাসলে চোখ সরু হয়ে একটা কালো রেখা হয়ে যায়। নাক কুঁচকে যায় সামান্য। সামনের ভাঙা দাঁত ওর হাসিটা যেন দ্বিগুণ সুন্দর করে দেয়। কারমার সঙ্গলাভের জন্য টাকা জমিয়ে রাখে সাধু। ওকে খাওয়ায়, যা চায় কিনে দেয়, সিনেমা দেখায়। কারমার জন্য ন্গুলট্রাম জমায় সাধু। টাকাকে ন্গুলট্রাম বলে কারমার দেশের লোক। কিন্তু গেটের এপারে, সাধুর দেশেও ন্গুলট্রামের ওড়াওড়ি। সাধুর জমানো ন্গুলট্রামগুলো শুধু যে কারমার জন্যই, সে কথা বলা হয় না কারমাকে।
দুই বাচ্চার মা, কারমাকে, যে ভালোবাসে সাধু, এটা জানতে জানতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ততদিনে সাধু আর কারমার মাঝখানে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে বন্ধ গেটটা। সাধু আমোচুকেও ভালোবাসে, আমোচু গেটের বাধা মানে না। বুকে বড় বড় পাথর নিয়ে নেচে নেচে গড়িয়ে পড়ে সমতলে। সীমানা পেরিয়ে এসে আমোচুও পোশাক বদলায়। নাম বদলায়। আমোচুর রোগা পাতলা স্রোত চওড়া হয়। এপারে এসে তোর্সা নাম নিয়ে দিব্যি ঘরের মেয়েটি সেজে বসে থাকে নদীটি।
দু-দেশের মাঝখানে চওড়া সোনার বর্ণ গেটের থামে এঁকেবেকে নাচ করে ড্রাগন। চারটে থামের ওপর গেটের মাথায় প্যাগোডার মতো সোনালি চুড়ো। এই গেট এপার ওপার করা যতটা সহজ ছিল এতদিন, ততটাই কঠিন হয়ে গেছে হঠাৎ করে। এই গেট দিয়ে শুধু গাড়িই যাতায়াত করত অনবরত। পাশের ছোট গেটটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওইপারে যেত সাধুরা, কারমারাও আসত। সেই গেটও বন্ধ। এখন একমাত্র আমোচু কোনো বাধা মানে না। সে যেমন লাফাতে লাফাতে নামত, তেমনি নামে।
বন্ধ গেটের মাঝখানে একটা বিরাট চাকা। তার দুপাশের দুই সোনালি ড্রাগন। কারমার মতো ওরাও সাধুর বন্ধু। মাঝরাতে আকাশে উড়ে উড়ে দেশ পাহারা দেয় ওরা। আকাশের ওপরে যখন তারারা কেঁপে কেঁপে ওঠে, সাদা একটা পথ তৈরি হয় কালো আকাশে। সেই সাদা পথটাকে নদীর মতো মনে হয় সাধুর। হাঁ করে আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায়ই দেখে জিভের মতো আগুনের হলকা মুখ দিয়ে বের করতে করতে আকাশের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ড্রাগনেরা। ওরা মেঘ কেটে কেটে এগোয়, চারদিকের পর্বতগুলো চক্কর দেয়, পারোর আকাশে ওরা নানা রকম মূর্তি ধরে ফুটে ওঠে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে আকাশে জলপ্রপাত তৈরি করে তারারা। সে জলপ্রপাত মাটি না ছুঁয়ে, আকাশেই বিলীন হয়ে যায়। ওরা কমলা বাগানের এদিক সেদিক ঘোরে, তারপর বাঘের বাসা থেকে, পারোচু থেকে, রাজপ্রাসাদ থেকে ঘুরে টুরে, ঠিক ভোর হবার আগে গেটে এসে লেজ নাড়িয়ে বসে পড়ে। যতক্ষণ ওরা থাকে না, ততক্ষণ গেটটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে সাধুর। এসে বসলে, সাধুর সঙ্গে মোলাকাত হয় ওদের। দেশ বেড়ানোর গল্প হয়। সারা দেশ কীভাবে ঘিরে রেখেছে রাজা, একটা মাছি গলবারও উপায় নেই। এই গল্প ওদের কাছ থেকেই শুনেছে সাধু। ওদের সোনালি লেজে রঙবেরঙের মিনেকারিতে ঝাপট মেরে ওরা সাধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে বলে ফেলে কত কথা।
সাধু শুধু জানতে চায় কারমার খবর, জানতে চায় কবে খুলবে গেট। ওরা কারমার খবর দেয় না সাধুকে। বলে — বিড়ি খাওয়া না ছাড়লে কারমার খবর দিতে পারব না গো সাধু। তামাকে শয়তানের রক্ত লেগে থাকে। সমস্বরে দু’জনে এ-কথা বলেই স্থির হয়ে সেঁটে যায় সোনালি গেটের সঙ্গে। বিড়ি খাওয়াটা রোজই ছেড়ে দেবে ভাবে সাধু, কিন্তু কিছুক্ষণ না খেলেই শরীর আনচান করে। বিড়ির ভেতরের তামাকের গন্ধ পায় ড্রাগনরা। ওরা রাগ করে।
গেট খোলে না কিছুতেই । গোটা ইন্ডিয়া জুড়ে জনতা কারফিউ ঘোষণা করা হ’ল যেদিন, তার কিছুদিন আগে থেকেই গেটটা বন্ধ হয়ে গেছে। গেটের এপাশের ব্যস্ত শহরটা, গঞ্জ থেকে টাউন হয়ে উঠেছিল এতদিনে। হোটেল, দোকান, ছোট বড় গাড়ির ভিড়ে সরগরম হয়ে থাকত সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর বোঝা যেত টাউনের খোলসের আড়ালে আসলে এটা একটা গঞ্জ। সেই যে বন্ধ হয়ে গেল গেটটা, তারপর থেকেই গেটের দিকে তাকিয়ে দিন গুনছিল শহরের মানুষগুলো, কবে খুলবে! গেট খুলল না। তার বদলে এই ব্যস্ত শহরটা নতুন শব্দ শুনল একটা, লক ডাউন। লক ডাউন।
সারা দেশ জুড়ে নাকি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি। কেউ কেউ বলল, দেশ নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে। কেউ বলল রোগটার নাম করোনা, কেউ বলল কোভিড নাইন্টিন। সাধু মনে মনে একটা হিসেব কষে নিল। রোগটার দুটো নাম আছে। ভালো নাম কোভিড আর ডাক নাম করোনা। যেমন আমোচুরও আছে দু-দেশে দুটো নাম। নিজের জন্য খুব দুঃখ হয় সাধুর, এই বিদঘুটে রোগটারও দুটো নাম, কিন্তু সাধুর কোনো ভালো নাম নেই।
এতকিছুর মধ্যেও সাধুর মাথায় এটা ঢোকে না, লক ডাউন নামটা কেন? আগে লক আউট কথা সে শুনেছে। যখন চা বাগানে ছিল। শুনেছে লক আপ কথাটাও। আপ আর ডাউনের পার্থক্যটা বুঝতে জান কয়লা হয়ে যায় সাধুর। তার মানে কি একটাই ট্রেন? আসার সময় আপ যাবার সময় ডাউন, অথচ ট্রেনটা একই থাকে। লকআপে পুলিশরা বন্দি করে রাখে, আবার লকডাউনে সমস্ত টাউন বন্ধ ৷ তাহলে আপ আর ডাউন আলাদা হয় কী করে!
লকডাউনের প্রথম কদিন আনন্দে মদটদ খেয়ে, হঠাৎ বন্ধ হোটেলের দামি খাবার সস্তায় পেয়ে মন্দ কাটেনি। তারপরই যেন কেমন মিইয়ে যেতে থাকল ক্রমশ টাউন হয়ে যাওয়া গঞ্জটা। দেওয়ালির রাতে যেমন অদৃশ্য বাতাসে একে একে নিভে যায় মোমগুলো, তেমন করেই একে একে বন্ধ হতে থাকে শহরের দোকানপাট, বড় ছোট হোটেল। গাড়িগুলো নড়ে না চড়ে না। চালকরাও সব বেপাত্তা। কিন্তু বাজারটা চলছিল। লকডাউন উঠে গেলে আবার সব জমজমাট হবে ভেবে আশায় আশায় ছিল সাধু। উঠেও গেল লকডাউন। কিন্তু গেট যে বন্ধ, সেই বন্ধ। একা একা বসে সাধু রাজার ছবিওয়ালা ন্গুলট্রামগুলো গুনে যায়। সেগুলো এখন অচল, কাগজের টুকরোর মতো অচল, ন্গুলট্রামের বড় রাজার মুখ, ছোট রাজার মুখ, তাসের পাত্তির মতো তাকিয়ে থাকে সাধুর দিকে।
লকডাউন উঠে যেতেই পুরো চত্বরটা যেন আরও ভুতুড়ে হয়ে গেল রাতারাতি। যারা বাইরে থেকে এসে এখানে গাড়ি চালাত তারা সব গাড়ি-টাড়ি নিয়ে কোথায় চলে গেল। যারা বাইরে থেকে এসে বড় বড় দোকান দিয়েছিল, তারা সব পরিবার নিয়ে চলে গেল যার যার দেশে। দোকানের মতো দোকান আছে, ঝাঁপ বন্ধ। বড় বড় মল, নিস্তব্ধ। বড় গাড়ি আছে স্থির, চালক নেই। হোটেলগুলো তালাবন্ধ করে চলে গেছে মালিক। এমনকি কোনো কোনো বাড়িতে মেস করে যারা থাকত, ভাড়াটেরা সবাই বেপাত্তা। গোটা একটা শুনশান পুরীতে ভুতের মতো ঘুরে বেড়ায় সাধু। ঘুরে বেড়ায় আর বন্ধ গেটটার দিকে লক্ষ রাখে। গেট খুললেই, থেমে যাওয়া গঞ্জটা আবার টাউনের দিকে এগোবে। ছোট বড় গাড়িগুলো আসবে সব। সাধু ছোট-বড় নানা হোটেলের কার্ডগুলো পকেটে নিয়ে লোক ডাকবে আবার।
এলাকার এরকম নিভু নিভু চেহারা আগে কখনো দেখেনি সাধু। আগেও একবার গেট বন্ধ হয়েছিল, দু-আড়াই মাসের জন্য। সেবার আসামের কিছু জঙ্গি ঢুকে পড়েছিল ভুটানে। অপারেশন অল ক্লিয়ার নামে কী যেন একটা হয়েছিল। জঙ্গি ধরতে, সব দিকের সব গেট বন্ধ করে দিয়েছিল ভুটান সরকার। তখন অবশ্য এই শহর এত রমরম করে বেড়ে ওঠেনি। তাও সেবার গেট বন্ধ হলে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল এই শহর। গাড়ি-টাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেছিল সেবারও। হোটেলগুলো কিছু দিন ঝিমিয়ে নিয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল মাস দু-আড়াই পড়ে। এরকম মাসের পর মাস, দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে থাকে নি।
এসব হয়েছিল প্রায় আঠারো বছর আগে। তারও আগে চা-বাগানের টেম্পোরারি কাজ ছিল সাধুর। তারও আগে স্কুলে দু-চার ক্লাশ পড়া ছিল। তারও আগে মায়ের পাশে পাশে পাতি তোলার কাজে যাওয়া ছিল। তারও আগে মার পিঠে ঝুলত। তারও আগে, মার পেট থেকে বেরনোর আগে, নদীতে সোনালি মহশির হয়ে ভেসে থাকত সাধু। স্পষ্ট মনে আছে। সোনালি মহশির হয়ে কতকিছুর সাক্ষী ছিল সে। এই যে বন্ধ গেটের দিকে হা পিত্যেস করে তাকিয়ে বসে থাকে, এই গেট টেট কিছুই ছিল না তখন। বড় একটা যুদ্ধ দেখেছিল এখানে, এদিকটা তখন জঙ্গলে ঢাকা। লালমুখো সাহেবরা সব চারদিকে মশমশ করে হেঁটে যেত। ঘোড়া হাতি কী দেখেনি তখন! তারও আগে মেঘের জোলো বাতাস মেখে রডোড্রেনডন গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত পারো চু-র উপত্যকায়। গায়ের ওপর দিয়ে শাখায় শাখায় ভেসে যেত মেঘ। শীতের বরফে ঢেকে যেত গা মাথা। বসন্তে ধুপি গাছের সারি থেকে গন্ধের আদান প্রদান করত ধুপি বন্ধুরা। তিব্বতের রানি সোসিয়াল বাঘ হয়ে সেই পথ দিয়েই তিব্বত থেকে ওই তাক্তসাঙে পিঠে করে উড়িয়ে এনেছিল দোর্জে দুলুংকে।
কেউ জানতে চাইলেই বলে দেবে সেই গল্প। কিন্তু কেউ জানতে চায় না। সাধুরই বা সময় ছিল কই, যে গল্প বলবে! এখন অফুরন্ত সময়, নিজের মনেই গল্পগুলো বেড়ে বেড়ে চলে। রোজই যোগ হয় নতুন কিছু। এই সব যে নিজের চোখে দেখেছিল, কাউকে বলতে গেলে পাগল ভাবে ওকে। তাই নিজের মনেই গল্পগুলো নতুন নতুন করে পড়ে সে। যত পড়ে, তত বড় হয় গল্প, বড় হতে হতে এই গঞ্জের টাউন হয়ে যাওয়ার মতো, টাউন থেকে আরও বড় টাউন হওয়ার মতো, বড় হয়ে যায়।
রোজ গেট ধরে দাঁড়িয়ে ওইপারে চোখ রাখে সে। মিলিয়ে নিতে চায়, মেলাবে কী! তখন কি আর এই রকম ঝাঁ চকচকে ছিল গেটের ওই পার! এদিকেও যেমন ওদিকেও তেমন ছিল। যেই মাঝখানে সোনার গেট বসল। দুই দিক যেন রূপকথার গল্পের মতো মাটি চিরে আলাদা হয়ে গেল। একদিকে সোনার রাজ্য আরেক দিকে ঘুঁটের। গেট খোলা থাকলে তাও একরকম। এক পা ওই দিকে আরেক পা এই দিকে দিয়ে মাঝখানে দাঁড়ান যেত। ও দিকের কুমির প্রকল্পের পাশে সিনেমা হলে টুক করে দেখে আসা যেত একটা সিনেমা। রমরম রমরম করে এদিক থেকে ওদিকে হতো বাণিজ্য। সব কিছু তো ভুটানের লোকদের কিনতে হত এপার থেকে। কিন্তু ওই ভালো নাম আর ডাক নামওয়ালা রোগ, গেটটা টাইট করে বন্ধ করে দিল।
এখন ওদিকে কারমা আর এ দিকে সাধু। সাধু আর কারমা, দু’জন দুদেশে। গেটে চোখ লাগিয়ে বসে থেকেও আর কারমাকে দেখতে পায় না সাধু। মাঝখানে সোনার বিরাট চাকা লাগানো গেট। যার দুই দিক থেকে দুইটা সোনার ড্রাগন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। রাত বিরেতে যতই গল্প করুক ড্রাগনরা, দিনের বেলা পাহারায় এক বিন্দুও এদিক থেকে ওদিক হবার জো নেই ওদের। ড্রাগনদের শরীরে নানান রঙের মিনে কাজ ঝকমক করে। তোরণে এঁকেবেঁকে সব সোনালি ড্রাগন কারমাকে পাহারা দেয়। কারমাও যেমন লাঠি হাতে পাহারা দেয় কমলা বাগান। ওদিকের আমোচু রোজ এদিক দিয়ে কলকল করে বয়ে যায়। এমনকি ওদিকের কাপড় ধোয়ার সাবানের ফেনা অব্দি আসে। কারমার গন্ধও যেন ভেসে আসে কিছুটা। তাই সব শুনশান হয়ে গেলেও এ চত্বর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না সাধু। বন্ধ গেটের এপারে শহরটার মতো সাধুর জীবনও থেমে গেছে মনে হয়।
গৌরিগাঁওয়ে একটা রিসোর্ট করছে সরকার। একটা ট্রাকের স্ট্যান্ড হচ্ছে। সেখানে কাজও আছে নাকি। সে কাজের কিছুই জানে না সাধু। শুধু জানে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের গাড়ি এলে দৌড়ে গিয়ে হোটেলের জন্য যাত্রী ডাকা। ওদিকে গেট পেরিয়ে গেলে যেসব হোটেল, তাতে অনেক টাকাপয়সা লাগে। তাই বাস থেকে লোক নামলেই তাকে গেটের এপারের ছোট-বড় নানান হোটেলের হদিশ দেওয়ার জন্য হামলে পড়ে সাধু। টাকা দিলে থিম্পুর গাড়ি, তার পারমিটেরও ব্যবস্থা করে দিতে পারে। গেট না খুললে যে গাড়িও আসবে না আর, এ-কথা বুঝে নিতে আর অসুবিধে হয় না এখন।
এই শুনশান শহরের পথে ঘাটে এবার একটা বড়সড় ম্যাজিকের প্রত্যাশা করে সাধু। ঘুমন্ত রাজকন্যার পায়ের কাছে সোনার কাঠি, মাথার কাছের রুপোর কাঠি অদলবদল করে দিলেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে শহরটা। যারা যারা দেশ-বিদেশে চলে গেছে বাণিজ্য ছেড়ে, তারা সব ফিরে আসবে একে একে। ফিরে আসবে কারমা। আলোময় এই একাকী রাতে কারমাকে ফিরে আসতে দেখে সাধু। কারমার সালোয়ার কামিজ পরা শরীরে সোনালি জরিকাজ। কারমার শরীর থেকে জরিগুলো খুলে নিতে নিতে ওকে কখনো না বলা কথাগুলো এবার বলেই ফেলে সাধু। বুকে পিষে ফেলতে ফেলতে বলে – ভালোবাসি। কারমা কোনো কথা বলে না, ভাঙা দাঁতে হেসে ওঠে শুধু।
রাতের অন্ধকারে চাঁদ উঠলে তারাদের হাজার হাজার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আমোচুর জলে চাঁদের টুকরোগুলো ভেসে ওঠে সোনালি মহশিরের মতো। আমোচুর বুকে শত শত সোনালি মহশির এঁকেবেঁকে সাঁতরায়। তাদের বিরাট শরীরে সোনালি-রুপোলি আঁশ। তাদের সোনালি লেজে কবেকার গল্প লেখা থাকে। রাজার দেশে তাদের ধরা মানা। বরফ শীতল জলে তাদের ঘরবাড়িতে অবাধ বিচরণ। তারা কখনোই পাহাড়ি নদী থেকে এই সমতলে নেমে আসে না। যেমন আমোচুতেও কখনো দেখা যায় না তাদের। অথচ সাধু দেখতে পায় এই আমোচুর বুকেই খলবল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত সোনালি মহশির। ওদের ডানা ঝাপটানোয় জল সোনালি হয়ে উঠছে।
সাধুর মনে হয় কিছুতেই সমতলে নামতে দেওয়া যাবে না ওদের। প্যান্ট গুটিয়ে আমোচুতে পা ডুবিয়ে দেয় সাধু। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ পায়ে লাগতেই সাধুর হঠাৎ করেই অন্য জন্মের কথা মনে পড়ে যায়। কারমার চুলের ঢালের মতো হুড়হুড় করে জল নেমে সমতলে পড়তেই বেশ বড় গর্ত তৈরি করেছে পাথুরে নদীটা। উল্টোস্রোতে হাঁটা দেয় সাধু। বড় বড় পাথরে কবেকার জমা শ্যাওলা সাধুকে উলটে পালটে ভাসিয়ে নেয় কমলালেবুর খোসার মতো। চাঁদের ভাঙা টুকরোগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সাধু নিজেও ওদের সঙ্গে বহু জন্ম আগের সোনালি মহশির হয়ে যেতে থাকে। পাখনা ঝাপটায়। বুক ঘষটে ঘষটে চলে। আমোচুর স্রোত সোনালি মহশিরকে বুকে জড়িয়ে তোর্সার দিকে টানতে থাকে ক্রমাগত। টুকরো টুকরো চাঁদ সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ধরিয়ে দেয় সাধুর হাতে। দু’হাতে দুই কাঠি নিয়ে সাধু অতল জলে সোনালি মহশির হয়ে সাঁতরায়। সাঁতরাতে থাকে। উজান ঠেলে ঠেলে সাঁতরায়। সোঁ সোঁ আওয়াজ তুলে ছুটে আসে ওর ড্রাগন বন্ধুরা। তারা লেজের ঝাপটায় জলের ঘুর্ণি তোলে। সাধুকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেখানে আলোর ঝরনা পাখনা মেলে, খেলা দেখায়। যার একটাও আলোর কণা মাটিতে পড়ে না। আকাশের সেই ঝরনাতলায়, জমানো ন্গুলট্রামে দান দেয় সাধু। সোনালি ড্রাগনদের সঙ্গে তাস খেলে। একদান জিততে পারলেই কারমার হদিশ দিয়ে দেবে ড্রাগনেরা। বাজি।
এণাক্ষীর গল্পের মূল আকর্ষণ তার ভাষাদেশ, বা ভাষার ভুগোল। কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য ভাষার বাইরে একটা কিছু। তার লেখালেখি ধারাবাহিক ভাবে লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়। প্রিয় লেখিকা।
কিন্তু বন্ধু বলেই এত বললাম, নইলে কে আর বলে।