উর্বরতা মিথঃ একটি তুলনামূলক পুরাকথা পাঠ… <br /> অর্ঘ্য দত্ত বক্সী

উর্বরতা মিথঃ একটি তুলনামূলক পুরাকথা পাঠ…
অর্ঘ্য দত্ত বক্সী

নারী মনে নারী মানে কেবল বারি, একটিই তার সাধ—তার প্রথম সন্তান থেকে কলম করে কলম করে কোমল করে সেচ দিয়ে নিয়ে মাথাপ্রবণ নারীর প্রথম সন্তান থেকে বার বার আরো আরো দ্বিগুণ দ্বিগুণ মা হওয়া মিথ—কৃষি বৃক্ষ জলবায়ু মিথ—প্রাকৃতিক শক্তির ইন্দ্রিয়জ মা—সেকালের মাতৃকা পুরাকথা হল এক যে ছিল উর্বরতা রূপকথা… ফার্টিলিটি মিথ।

সাদা সব মার্বেল বার বার লোহিতে লেপিত! বার বার স্বপনে বাঘ পরে বাঘ পরে রাখালিনীর বাঁশি সর্বনাশী বাঘের পিঠে লাঙ্গল লাগিয়ে আমূল চষিয়েছে। নির্বিকল্পের সঙ্গে সহজ শুয়েছে দেবব্যাসী, বেদবসনা সান্ধ্যাহ্নউদাসীনা অগ্নিহোত্রত্যাগিনী বিরহলক্ষ্মী। স্বভাবকামরূপান্তরিতা নতুন মা। স্বেদ অশ্রু তরলহীরাদি যেই বহু বহু স্পন্দিত সুখসূক্ষ্ম অমৃতান্ন হব্য হয়ে গুহায় ঢুকেছে গর্ভগ্লেসিয়ারধারা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভবিষ্যত হয়ে নেমে গর্ভবতী হয়েছে গৃহ। তবেই তো খামারবাড়ি হরিয়ালি দুপুরের ইম্প্রেশানিজম—যৌনভঙ্গিমার অয়েলের মুখগুলি এত কেন মহার্ঘ্য হয় বুঝি আজ—ত্রিশ হাজার ক্যানভাস-কন্যার সতীত্ব নষ্ট করে বিরাট সত্যকে বলে। খাদ্য পুষ্টি রক্তজালিকার মতো লাল লাল সব প্রতীকেরা সকলেই নিজ নিজ তেজঃপুঞ্জ একত্র করে গড়ে তোলে উর্বরতা মিথ। প্রকৃতি তার নিজের প্রসাধন করতে চেয়ে মানবচৈতন্য ছাড়া আর কোন মনমুকুরের কাছে যাবে? লক্ষ লক্ষ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে প্রকৃতির প্রচ্ছায়া পুরুষের কানে কানে এসে বলে উর্বরতা মিথ তোমারই বংশগাথা… আবহমানিক।
মানুষের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতা তার ভবিষ্যতদার্শনিকী আর আদিম দাবি সেখানে নিরাপত্তা। তাই শস্য ও গব্যে ভরন্ত রাখতে চেয়েছে তার খামার। মন্ত্র যন্ত্র আচার ব্রতাদি দিয়ে যদি বাড়ে উৎপাদন! সন্তানহীনার পুত্রবাসনার টান নীলের বন্যা—হাহাকার তবু সুষ্ঠপ্রণালীর সেচে ফলদা—গর্ভে(ধারণে) মুক্ত—তার দেবী ব্যাদিতপদা প্রসবরতা পৃথুলা ধরিত্রীস্বরূপা একটি পুতুল বই তো নয়! ছলে বলে কৌশলে অতিপ্রাকৃতে মা হওয়া আর আরো আরো জন্ম দেওয়ার উন্মাদ নিশ্চিন্তিই উর্বরতা মিথ—‘মা’ঠাকুরণ—মাটির গর্ভ ভরে ওঠে ধান্যসন্তানে—লিঙ্গ নির্বিশেষে উৎপাদনশক্তির উপচে ওঠাই উর্বরতা মিথ।
ফ্রেজারসাহেব বলেছিলেন প্রকৃতি ও মানুষের উৎপাদনশক্তিকে এক ও অভিন্নরূপে দেখা হত। অক্ষম রাজার রাজদণ্ড প্রয়োজনে তাকে হত্যা করে নবোদ্ভিন্ন যৌবনের হাতে তুলে দিতে আমরা হৃদয়ে নিষ্ঠুর হয়ে প্রকৃতির যৌনক্ষমতার পুজো করে যাই। মন্ত্র তন্ত্র পূজার আচার, নৃত্য গীত বাদ্য মিশে একটি গল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পরিচিত হয় ‘মিথ’ নামে। যুগলসাধন করে যৌথসমাজের সমৃদ্ধিবাসনাই উর্বরতা পুরাকথা। এই ম্যাজিক এই মন্ত্র এই উন্মত্ত নৃত্য গীতের দ্বারা প্রকৃতিকে প্রভাবিত করা এবং নারীর সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা, গর্ভবতী হওয়ার ও জন্মদানের ক্ষমতার মধ্যে এক অমোঘ সমাপতন পেল মানব—লাঙ্গল চষা মাটিতে বীজ আর পুংলিঙ্গের কর্ষণজাত রমণ থেকে যে ‘চারা’ জন্মায় তার উৎসবগাথায় সেই সদ্য যুবক আকাশ মুখরিত হল।

আমরা প্রাথমিক নান্দনিকতার পর কিছু বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার ফার্টিলিটি মিথের আলোচনা ও ব্যাখ্যা করে একে বুঝতে চাইব।

সুমেরীয় ব্যাবিলনীয় উর্বরতা পুরাকথা—এন্কি ও নিনউরসাগের গাথা

ভূস্বর্গ দিলমানে এন্কি (সুমিষ্ট শুদ্ধ জলের দেবতা) মিলিত হন নিনউরসাগের (পর্বত/ধরিত্রীমাতা) সঙ্গে। এই সেই দিলমান শহর যা পবিত্র ও কুমারী; যেখানে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু কিচ্ছু নেই। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নেই জল বন্দর বাণিজ্য শস্য সবজি ইত্যাদি। সুতরাং সুমিষ্ট জল ও নাব্যতার দেবতা এনকি সেখানে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। তার ফলে, ফুলে ফলে শস্যে ও অরণ্যের কাষ্ঠে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল দিলমান।
এনকি তার বিশাল যৌনাঙ্গ মাটি ও ঘাসের মধ্যে চাপা দিয়ে যে যৌন উত্তেজনা পেলেন তাতে তিনি তার অর্ধাঙ্গিনীকে জলাভূমির ধারে সহবাসের জন্য আহবান জানালেন। সেই গভীর রাত্রে যৌবনবতী প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে ততক্ষণ প্রেম করলেন যতক্ষণ না তার বীর্য নিনউরসাগকে গর্ভবতী করে তোলে। তিনি এনকির হৃদয়ের জল নিজ গর্ভে ধারণ করলেন এবং নয়দিনে জন্ম দিলেন ‘নিনমু’র। এই নয়দিন অঙ্কুরোদ্গমের প্রতীক (এই নয়দিনেই আব্রাহামীয়—ইহুদী,ইসলাম ও খ্রিস্টীয়—ধর্মগুলির আদি ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন)।
নিষেধ সত্বেও নিনমু যখন জলাভূমির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন এনকি এই অসামান্যা রূপবতীকে দেখে কামাসক্ত হয়ে নৌকায় চড়ে জলাভূমি পার করে তার কন্যাকে গর্ভবতী করেন। নিনমু জলাভূমি-চারণভূমি-বীজক্ষেত্রের প্রতীক। তিনিও নয়দিনে এক কন্যার জন্ম দেন যার নাম নিনকুরা (তিনি বীজের প্রতীক)। যিনি কীনা এনকির কন্যার কন্যা—নাতনি। নিনকুরাও একইভাবে জলাভূমিতে বিচরণকালে এনকির দৃষ্টিপথে পরেন এবং তাদের মিলনের ফলে জন্ম নেয় মহতী আনন্দময়ী নারী উত্তু, যে কীনা এনকির নাতনির কন্যা।
এবার গল্পে বদল আসে। নিনউরসাগ জানতেন একদিন এনকি উত্তুকেও যৌনমিলনের জন্য প্রলুব্ধ করবেন। তাই তিনি উত্তুকে নির্দেশ দেন যে, এবার যদি এনকি ঊষর প্রান্তর থেকে শশা আপেল ও আঙুর উৎপন্ন করে আনতে পারেন তবেই তিনি তার বাহুলগ্না হবেন। এবং তাই হয় একদিন। উত্তুর গৃহের সামনে এনকি তার বৃহদাকার লিঙ্গের বর্ণনা দিয়ে উত্তুকে মোহিত করার চেষ্টা করেন। উত্তু কিন্তু নিনউরসাগের আদেশ ভোলেনি। সুতরাং এনকি ঊষর মরুভূমিকে জলে পূর্ণ করে মরূদ্যান বানিয়ে সেখানে ফসল উৎপাদন করেন এবং দ্রুত তা উত্তুর কাছে নিবেদন করে তার গৃহে বিয়ার পান করতে করত মোহময়ী ও নবযৌবনা উত্তুতে লাগাম চড়ান।
পুরাকথাবিদরা এই অজাচারকে একই জমিতে বারংবার কৃষিকাজ করার প্রতীকরূপে মনে করেন যে জমি ছিল আগে অনুর্বর শুষ্ক।
উত্তু নিজের যোনিতে এনকির বীর্য ধারণ করে রাখেন। নিনউরসাগ তার ঊরুদেশে ও যোনিতে পতিত এনকির বীর্য সংগ্রহ করে নিজের যোনিতে স্থাপন করেন। সেখান থেকে আটরকমের উদ্ভিদ উৎপাদিত হয়। তারা পৃথিবীর প্রথম উদ্ভিদসকল। শাক-সব্জি, পাটগাছ ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়াটি একটি কর্ষিত ভূমিতে উৎপন্ন চারা নিয়ে অন্য কর্ষিত ভূমিতে তাকে স্থাপনের প্রতীকস্বরূপ।
নিজের স্ত্রীর মাধ্যমে উৎপন্ন উদ্ভিদগুলিকে দেখে তাদের গুণাগুণ ও ব্যবহার স্থির করার জন্য এনকি(যিনি সবকিছুর ভাগ্যনির্ধারক) সেগুলিকে ভক্ষণ করেন। সেই কথা শুনে মাতা নিনউরসাগ প্রচণ্ড ক্রোধের সঙ্গে জলস্বরূপ তার স্বামীকে কখনও সঙ্গ না দেওয়ার ও আমরণ নির্বাসিত করার অভিশাপ দেন। তার এই অভিশাপে জল অবরুদ্ধ হয় ও মাটির সঙ্গে সংযোগ হারায়। ফলে সর্বত্র প্রবল খরার সৃষ্টি হয়। সেই অভিশাপে এনকির দেহের আটটি অংশে প্রবল ক্ষত উৎপন্ন হয়।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেবদেবীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেন। একটি শৃগাল কিছু বরের বিনিময়ে নিনউরসাগের সন্ধান করে তার কাছে এনকির মৃতপ্রায় অবস্থার কথা ও নিরাময়ের জন্য জরুরি ঔষধের সন্ধান করার কথা জানানোর প্রতিশ্রুতি দেয় দেবরাজ এনলিলের কাছে (শৃগাল মৃত্যুর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাণী, এইজাতীয় মোটিফ রূপকথাতেও পাওয়া যায়)।

বার্তা পেয়ে নিনউরসাগ মরণাপন্ন এনকির মন্দিরে ছুটে আসেন ও তার স্বামীকে নিজের যোনিতে স্থাপন করেন। তাকে সেই ঠাণ্ডা শান্ত আশ্রয় দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করতে থাকেন— “হে প্রিয়, তোমার শরীরের কোন অংশে কষ্ট হচ্ছে?” এনকি এক এক করে উত্তর দেন… মাথায়, চুলে, নাকে, মুখে, গলায়, হাতে, পাঁজরে, দেহের পার্শবদেশে… । প্রতিবার তিনি প্রশ্ন করেন, এনকি উত্তর দেন এবং প্রত্যেক অংশকে নিনউরসাগ শুশ্রূষা করেন আর সেই ব্যথা নিজে গ্রহণ করে আটজন দেবতার জন্ম দেন। এনকি তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দৈবত্বে প্রতিষ্ঠা করেন।

এই আখ্যানটিকে পুরাকথাবিদরা জমিকে অতিরিক্ত চাষের প্রতীকরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। এনকির অসুখ আসলে সেচখালগুলিতে জলের অভাব ও বিভিন্ন স্থানে সেই জলের আটকে পরা(যাই কীনা এনকির দেহের বিবিধ অংশে ক্ষত)।
এই গাথার মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে এনকির যৌনশক্তির ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের কথা যা বহু নারী সম্ভোগ এমনকি অজাচার হলেও নিজের সন্তানসন্ততির সঙ্গে যৌনমিলনের মাধ্যমে এক বহুমাত্রিক উর্বরতা মোটিফকে প্রতীকায়িত করে। ঊষর প্রান্তরগুলি এই যৌনমিলনাকাঙ্খাকে চরিতার্থ করার উদ্দাম প্রচেষ্টায় উর্বর হয়ে ওঠে। মানুষের কৃষিপ্রযুক্তি ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। আটরকমের নতুন উদ্ভিদের চাষ শুরু হয়। অতিরিক্ত চাষ করার ফলে জমি পুনরায় অনুর্বর হয়ে পরে। এনকির দেহের ক্ষতগুলি ও তার নিরামক উদ্ভিদ্গুলি সকলই ভেষজ উদ্ভিদের আবিষ্কারের প্রতীক যারা মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে নিরাময় করে নতুন সুস্থ কোষ উৎপন্ন করতে সক্ষম।

যৌনলালসা চরিতার্থ করতে জলের দেবতার মরুভূমিকে উর্বর করে চলার প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত অসুস্থতা ও বিষাদগ্রস্ততা এসে পরে। অন্যদিকে নিজের উৎপাদনশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে নবযৌবনা উত্তুর গর্ভ থেকে বীর্য গ্রহণ করেন অসূয়াসম্পন্ন ভূমিদেবী। এ দুইই তাদের দাম্পত্যের জন্য নৈরাশ্যের প্রতীক। তদুপরি সেই মাতৃকাদেবীজাত আট উদ্ভিদকে ভক্ষণের মাধ্যমে এনকি নিজের সন্তানদেরই আত্মসাৎ করার মতো উর্বরতা পুরাকথার সন্তান স্নেহের বিপ্রতীকে এক বর্বরোচিত ক্রিয়া করে বসেন। এই দুই ঘটনাই স্বাভাবিক দাম্পত্য ও সন্তান উৎপাদনের বিপরীত ক্রিয়াঃ পৌঢ়া নিনউরসাগ একটি সদ্যযৌবনার গর্ভ থেকে বীজ সরিয়ে নেন, যেখানে তা এক পুরুষের মাধ্যমে প্রদেয় হয়ে সেখানেই থাকা উচিত; আবার এনকি তার সন্তানদের ভক্ষণ করে যেখানে তাদের মাতৃকাদেবীর দ্বারা জন্ম হয়ে বেড়ে ওঠার কথা।
এইরূপ আচরণের জন্য এনকি অসুস্থ হয়ে পরেন এবং তাকে সুস্থ হতে পুনরায় নিনউরসাগের যোনিতে আশ্রয় নিতে হয় যা তার পুনর্জন্মের প্রতীক। নিনউরসাগের যোনিতে আশ্রয় নিয়ে এনকি তার দেহের রোগগুলিকেই যেন সন্তানের জন্মদানের মাধ্যমে নিরাময় করেন। এখানে কিছু ধোঁয়াশা থাকলেও পুনর্জন্মের মোটিফটি স্পষ্ট এবং জল পুনরায় সেই সেই জায়গাই পূর্ণ ও উর্বর করে তোলে যেগুলি আগে কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত ছিল ও পরবর্তীতে আরো জায়গা উর্বর করে তোলে।
লেভি স্ট্রসের মতে এই আখ্যান একটি চমৎকার উদাহরণ যেখানে মনুষ্য উর্বরতাশক্তি ও প্রকৃতির উর্বরতাশক্তি প্রবলভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত—অগণিত পুরাকথা ও আচার অনুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু এই বিষয়টিই।

দিমিতার ও পার্সিফোনঃ গ্রীক পুরাকথায় উর্বরতা মিথ
দিমিতার ছিলেন ধরিত্রীমাতা। তিনি উর্বরতা প্রতীকিনী। মাটি ও বীজের উর্বরতা শক্তিস্বরূপিনী। ধরিত্রীতে উৎপাদিত সকল শস্য উদ্ভিদ ও অন্যান্য ফল ফুল ভেষজ লতা গুল্মের দেবী। সকল ঋতুর অধিষ্ঠাত্রী। সর্বোপরি প্রকৃতির সকলপ্রকার ভরন্ত উৎপাদন সংগ্রহের দেবী। মানবদের তিনি চাষ করা শিখিয়েছিলেন এবং কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ক্রিয়ারও দেবী হিসাবে তাকেই উপাসনা করত গ্রীকরা।
সবার উপরে তিনি ছিলেন এক মহীয়সী মাতা। মা। মাতৃত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি পর্বতশৃঙ্গে বাস করতেন এবং সব কৃষিক্ষেত্রের রক্ষাকর্ত্রীও ছিলেন তিনিই। উজ্জ্বল কেশরাজিশোভিতা দেবী কৃষিকার্যের সকল পর্যায়ে সব ক্রিয়াগুলিকে তার পদ্মহস্তের আশীর্বাদে সহজ ও সফল করে তুলতেন। লাঙল চষা কৃষিকার্যের জন্য প্রস্তুত জমিতে দীর্ঘ সবুজবস্ত্রপরিহিতা হয়ে তিনি বিচরণ করতেন।
দিমিতার তার অনূঢ়া কিশোরী কন্যা পার্সিফোনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। সেই অপ্সরাতুল্য রূপসী কন্যাটি যখন মাঠে ফুল নিয়ে খেলছেন তখন পাতাললোকের দেবতা হেডিস তাকে দেখে কামমোহিত হয়ে তাকে হরণ করেন। একজন কুমারীর সঙ্গে ফুলের সম্বন্ধ সবচেয়ে বেশি। পার্সিফোন এমন একজন কুমারী যিনি “পুরুষ” এই শব্দটি বিষয়েই অনাবগতা। তার অতিরিক্ত আসক্ততা তার মায়ের সঙ্গে আবার ধর্ষিতা(হোমারের সাহিত্যে) হওয়ার পর তার সকল সত্তা সমর্পিত হয়ে যায় হেডিস/স্বামী/পুরুষের প্রতি। এমত নারী যেন বর্ডারলাইন পারসোনালিটিতে বিদ্ধ! তার দুইদিকে দুটি চরমরূপের সম্পর্ক। এক মা-মেয়ে এবং অন্যদিকে সদ্য বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রী। পার্সিফোন একটি আধ্যাত্মিক এবং কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত দর্শনের প্রতীক। তার পাতালপ্রবেশ বা কুমারীত্ব হারানো প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু। তাই তাকে মৃত্যুর দেবী হিসাবেও পূজা করা হত। তাই বিবাহ ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় একজন কিশোরীর আধ্যাত্মিক ধারণায়। বিবাহেই তার যাবতীয় পূর্ণতা ও বিবাহেই সেই অনূঢ়াস্বরূপা দেবীর শেষ পরিণতি—মৃত্যু।
দিমিতার ও তার কন্যা যেন একই দেহে ও মনে দ্বৈতসত্তা। একে অন্য ব্যতীত অপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক। পার্সিফোন সর্বোপরি তার মায়ের লাডলি। সে ব্যতীত দিমিতারও যেন শস্য দেবী ধরিত্রী মা হতে পারেন না। আবার পার্সিফোন তার স্বামী হেডিসকে ছাড়াও অপূর্ণ। তাকে হেডিসের হাতে অর্পণ করেছেন স্বয়ং জিউস। সুতরাং পার্সিফোনের এই কুমারী মিথে এক সম্পর্কের ত্রিভুজ তৈরি হয়—মা-কন্যা-কন্যার প্রেমিক। এবং এইজাতীয় ত্রিভুজ কিন্তু হোমারীয় জিউস সাম্রাজ্যে খুবই প্রচলিত ও স্বাভাবিক এক ঘটনা।
আবার আমরা গ্রীক গাথাগুলিতে আরও একটি নারীকে এই পুরাকথার সঙ্গে সম্পর্কিত দেখি। তিনি হলেন পার্সিফোনের সখী হেকাটে। তিনি পার্সিফোনের ধর্ষণের সময় নিকটস্থ গুহায় ছিলেন ও সেই কুমারীর আর্তনাদ শুনেছিলেন, যেমন শোনেন দিমিতার। তারা দুজনেই সেই ধর্ষণের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সূর্যদেবতার কাছে যান। গাথাগুলিতে দুরকমের কাহিনি পাওয়া যায় যে, পার্সিফোনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য পাতালে কখনও যান দিমিতার আর কখনও হেকাটে। পার্সিফোনের হয়ে একইভাষায় সওয়াল করেছেন দিমিতার ও হেকাটে দুজনেই। এই ত্রিভুজটি হল মা-কুমারী-চন্দ্রদেবী। তারা প্রতীকায়িত করেন পৃথিবী স্বর্গ ও সাগর ত্রয়ীকে। হেকাটে কিন্তু ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক উভয়তই এক আদিদেবী যিনি গ্রীক মিথলজিতে জিউস পূর্ববর্তী সময়ের দেবী। হেকাটের এই তৃতীয় সত্তাটি ৩ দিয়ে তাই প্রতীকায়িত হয়েছে। তার তিন মাথার মূর্তিটি পরে অনূঢ়া ও নৃত্যরতা তিন কন্যা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এই ৩ কোন ঘটনা বা বীজের দ্বৈততার অতিরিক্ত এক তৃতীয় সম্ভাবনার কথা বলে আর কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনাটি বিরাট। হেকাটে হলেন আলো আনয়নকারী দেবী। জ্ঞান বা প্রযুক্তি আনয়নকারী আগুনের দেবদেবী অর্থে নন—চন্দ্রদেবী অর্থেই তিনি আলোবহনকারী দেবী। দিমিতার ও পার্সিফোনও টর্চজাতীয় আলোকময় বস্তু বহনকারী। কখনও তাদের তিনটি আলোকরেখা পরস্পরকে ছেদ করে যায় যেগুলিও প্রতীকবিশেষ। সবদিক থেকেই হেকাটে হলেন দ্বিতীয় দিমিতার। দিমিতার ও পার্সিফোনের পুরাকথার মোটিফ জিউস ও হোমারীয় যুগের বহু আগেকার এবং তাদের যুগল প্রতীকের মধ্যেই পরবর্তী হেকাটের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যগুলির বীজ ছিল। এককথায় বলা যায় যে, প্রাচীন গ্রীকের ‘হেকাটে’ দেবীর মধ্যে চন্দ্র ধরিত্রী ও কুমারীর(শুধু পার্সিফোন নয়, তার প্রেমিক আর্টিমিসেরও) গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে একত্রিতরূপে আরোপিত করেছিল। দেবী হেকাটে একাধারে আবার দিমিতার ও লিটো উভয় দেবীরই কন্যা।
আবার চন্দ্রসম্বন্ধীয় দেবী ও ভূতপ্রেতের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও হেকাটের আরো এক পরিচয় আছে। তার পরে জন্ম নেওয়া সকলের মাতৃসমা সেবাকারিণী ও পালনকারিণী তিনি, ঠিক যেমন কীনা দিমিতার। সুতরাং সব দিক দিয়েই দেখতে গেলে দিমিতার ও হেকাটে একই সত্তা।
পার্সিফোন গাথায় পার্সিফোন নয়দিনের মাথায় (নয় দিনে চারা উৎপন্ন হয়) বেদানার দানা খেয়ে ফেলায় দিমিতার কিন্তু কোনোদিনই তার কন্যাকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাননি। এবং যে চারমাস পার্সিফোন পাতালে কাটাতেন ততদিন ছিল দেবী দিমিতারের বিরহ ও শোকের সময়। তাই সে সময় কোনো শস্য জন্ম নিত না। তাই দেবতাদের মধ্যস্থতায় বসন্তে পার্সিফোনকে ফিরে পেয়েই মাতা হয়ে ওঠেন উপহারদায়িনী—সবুজ-স্বরূপিণী ও ফল(fruit)প্রদায়িণী এবং একইসঙ্গে ফলপ্রদা ঋতুরও আনয়নকারী। মিথের বিজ্ঞান এ বিষয়ে সন্দিহান যে তারা এই দেবীকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে—ধরিত্রী হিসাবে না শস্য হিসাবে না কোনো অন্তঃসলিলা গোপন শক্তিদেবীরূপে? কিন্তু আসলে তিনি এই তিন গুণেরই অধিষ্ঠাত্রী দেবী
দিমিতার কিন্তু গাথাগুলিতে কোথাও মানবদের কৃষিবিদ্যা শেখাচ্ছেন, এমন বিবরণ নেই। একইসঙ্গে উৎপাদিত শস্য দিয়ে কী করতে হবে তাও তিনি বলেন না। শস্য ভূমি থেকে পুরোপুরি ফলন্ত হয়ে উঠলে তিনি মানবদের ইলিউশিনিয়ান রহস্যকে ব্যক্ত করেন। সেই রহস্যময় দেশের পৌরাণিক রাজা ও তার সন্তানদের তিনি কৃষিবিদ্যার প্রয়োগ শিখিয়েছিলেন হয়তো; ভাগ্যবান সেই মানুষ যে দিমিতারের অবাঙ্মানসগোচর সেই ক্রিয়াগুলির সাক্ষীঃ তার সাধক ছাড়া কেউ আর মৃত্যুর ঘন অন্ধকারের মধ্যে এত ফলপ্রসূতা দেখতে পায় না। শস্য ও মাতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে গুহ্যরহস্যের সরাসরি সম্পর্ক।
ইলিউসিসে এসে দিমিতার রাজার কনিষ্ঠ পুত্রকে পালনের দায়িত্ব পান। তিনি রোজ রাত্রে শিশুটিকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতেন ও তারপর জীবিত করে তুলতেন। তার মাধ্যমেই তার পুনর্জীবন ও অমরত্বের গুহ্যবিদ্যার প্রকাশ ঘটাতেন(মনসামঙ্গল!)। তখন তিনি গানের সুরে মানবদের অজ্ঞানতার কথা ব্যক্ত করতেন। যদি তারা শুভত্ব ও শয়তানির পার্থক্য বুঝত তবে বীভৎস কাণ্ডের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক অর্থ উদ্ধার করতে পারত(এখানে কোথাও কি কালীর রূপকটি প্রকট হয়ে আসে?)। এর প্রকৃত অর্থ হল শয়তানের মধ্যে ছদ্মবেশে লুক্কায়িত শুভত্বই যে অমরত্ব তা উপলব্ধি করা।
শস্যের যা ভাগ্য শস্যের যা গুণ তা মানুষের যুক্তির নাগালের বাইরে হতে পারে; তাই দিমিতারও অধরা! দিমিতারের প্রসাদ আগুনে সিদ্ধ করেই মানুষ ব্যবহার করতে পারে। তাকে যেভাবেই ভক্ষণ করা হোক না কেন, আগুনে পুড়ে মৃত্যুই তার একমাত্র পরিণতি। কিন্তু তবুও সে অমর। বারবার তার মৃত্যু ও পুনর্জন্ম হয়। তাই দিমিতারের মতোই কিছু মেক্সিকান আদিবাসীরা সদ্যোজাতকে খড়ের আগুনের ধোঁয়ার চতুর্দিকে তিনবার করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে যাতে সে বড় হয়ে সফল অর্থাৎ সফল একজন কৃষক হয়ে উঠতে পারে। হয়তো রাজার কনিষ্ঠ সন্তানকেও দিমিতার সফল কৃষক হয়ে ওঠার পাঠই দিতে চেয়েছিলেন! সুতরাং দিমিতারের যদি কোন প্রকৃত উপহার মানুষকে দেওয়ার থাকে তবে তা হল কীকরে অমরত্বকে উপলব্ধি করা যায় তার দার্শনিক পাঠ!
তবে এবার প্রশ্ন উঠবে যে, যেভাবে দিমিতারকে দেখা হয় অর্থাৎ মহীয়সী মাতারূপে, তা কি তার দেবীকরণের পূর্বে একটি ফলন্ত শস্যগাছকেই মাতারূপে দেখা নয়? অথবা তার কন্যাটিকে কি একটি চারাগাছরূপেই প্রাথমিকভাবে দেখা হত না? আবার অন্যমতে দিমিতারের হরণ করা কন্যা বপণের পূর্বে একটি বীজই নয় কি যা বপণের সঙ্গে সঙ্গেই ভূমিতে অন্তর্হিত হয়ে যায়/মারা যায় এবং নয়দিনে পুনরায় চারারূপে পুনর্জন্ম পায়?
মা তার প্রিয় কন্যার বিচ্ছেদে শোকার্ত(মেনকা; উমা বা দুর্গাও আদিতে শস্যদেবী)—এই মানবীয় রূপ ও সম্পর্কের বহিরাঙ্গের গভীরে আছে শস্যের দার্শনিক সম্পর্ক যা শাশ্বত ও স্থায়ী সত্য। শস্যপ্রতিমা একইসঙ্গে প্রারম্ভে ও অন্তে স্থায়ীভাবে বিরাজ করেন(সৃষ্টি ও ধ্বংসের ভারতীয় দেবীতত্ত্ব)। শস্য মাটির গভীরে গিয়ে মৃত্যু ও বিচ্ছেদের মাধ্যমে আবার মাটির কাছেই ফিরে আসে, তার ভরন্ত সদ্যযৌবনকে নিড়ানোর(হত্যা) মাধ্যমেই তার মায়ের সঙ্গে মিলন হয়। সে ও তার মা সর্বদাই সংযুক্ত। অবিচ্ছেদ্য।
শস্যের এই ভাগ্য গ্রীকদের পার্সিফোন পুরাকথার কথা মনে করাতো। যখন যখনই আধ্যাত্মিক মৃত্যু ও পুনর্জন্ম—বিচ্ছেদ ও মিলন হত তখনই মনে করাতো। জগতে এমন কীই বা আছে যা তাদের সে কথা মনে করাতো না! তাই এই পুরাকথা আর প্রাকৃতিক সত্য হয়ে রইল না—বরং তা আরো ব্যাপক ও মহান হয়ে উঠল; যা আবার কৃষিকাজকেও দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির স্তরে নিয়ে গেল। এই হল মিথের কাজ। সে প্রকৃতি থেকে নিয়ে আরও সৃষ্টিশীলতা ও উর্বরতা সমেত আবার প্রকৃতিতেই ফেরত দিয়ে দেয়।
গ্রীকদেশের কিছু কিছু স্থানে বীজ বোনার সময় মেয়েরা (ভারতীয় মেয়েদের পবিত্র দিনে উপোস করার মতো) এখনও উপবাস করে। ঠিক যেমন দিমিতার উপোস করেছিলেন শোকে এবং উভয়ক্ষেত্রেই শস্যদানা বা পার্সিফোন ভূমির নিচে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। বীজবোনার সময় গ্রীকদের বারবার সেই নিষ্পাপ কুমারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা মনে পরে আর তাই তখন তারা উপবাস করে খুব স্বাভাবিক দুঃখবোধে (হয়ত প্রথা আচার বাদ দিয়ে আমাদের দেশেও উপবাসের জন্য তীব্র কোনো অনুভূতি জড়িয়ে ছিল!)।
পূজা-অনুষ্ঠান-আচারে এই বীজ বোনা ও শস্যের ধরিত্রী মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আরো কিছু যোগাযোগ আছে। হোমারিয় সময়ের পূর্বের পুরাকথায় এক শূকরচারণকারীও পার্সিফোনের সঙ্গে মাটির মধ্যে হারিয়ে যায়। হেডিসকেও সেই শূকরচারণকারীর নামে ডাকা হত। বীজবপণের সময় তাই শূকরকেও এই দুই দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে কবর দেওয়া হত। শূকর যেন প্রকৃতপক্ষেই মাটির গর্ভের সন্তান যেমন কীনা ডলফিন জলের। শূকরের সঙ্গে মাটির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আর শূকরের প্রজননক্ষমতার অসীমত্ব তাকে ফার্টালিটির পশুপ্রতীক হিসাবে স্বয়ংসিদ্ধ করেছে। বীজ বোনার নামে গর্ভবতী বীজগুলি যেমন দিমিতারের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করা হয় সেরকমই সেই গর্ভবতী শূকরীদের বলি দিয়ে পাত্রে করে দেবীর উদ্দেশ্যে মাটিতে বোনার সময়ই প্রোথিত করা হত। মা-পশুকে মহীয়সী মাতাদেবীর মাটিতে হারিয়ে যাওয়া কন্যার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত যতদিন সে ধরিত্রীগর্ভে থাকবে ততদিন। এমনকি পচতে থাকা মৃত শূকরীদেরও নিয়ে এসে বপনভূমিতে গর্ত করে গেড়ে দেওয়া হত যাতে পচে যাওয়া পশুর সার এই ফলনপ্রক্রিয়াকে আরও ফলপ্রসূ করে। এটির মাধ্যমে স্পষ্টত বোঝানো হয় যে আসলে মাটির নিচে শস্যদানাও পচতে থাকে; যার প্রতীকায়ন মা-শূকরী; এক ফলপ্রসূ মৃত্যু! যেন তারা বারবার স্মরণ করছেন যে কুমারী এখন পাতালে মৃত্যুপুরীতে বাস করছেন।
এইভাবে শূকর ও শস্য এক সমান্তরাল ধারণা হয়ে ওঠে। দিমিতার মিথে এই পচন ও ক্ষয় পার্সিফোনের নরকে বসবাসের অবস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। তাই কুমারীর উদ্দেশ্যে শূকরী উৎসর্গীকরণ ধর্মীয় প্রথায় পরিণত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না গমের দানা গমগাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ছে এবং মারা যাচ্ছে, সে একসঙ্গে থাকছে; কিন্তু যদি সে মারা যায়, তবে সে আরো শস্য হয়ে জন্মাচ্ছে।
এরপর প্রশ্ন আসে যে যদি পার্সিফোন বছরের এক তৃতীয়াংশ মাটির নিচেই থাকবে তবে কি এই ফলপ্রসূ মৃত্যু চারমাস ধরে হয়? না, তা নয়, প্রকৃতপক্ষে গর্বিতা দিমিতার তার কন্যার(পাকা গমগাছ বা ধানগাছ) সঙ্গে অনেক পরে স্বর্ণাভ(গম/ধান) পোশাক পরিধান করে দেখা করতে আসেন। তার মেয়াদ চারমাস। অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে শস্যদানা মাটিতে পড়ে যাওয়া থেকে পূর্ণ ভরন্ত উদ্ভিদ হয়ে ওঠা অবধি সময়। তখনকার দিনেও শস্য চারমাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যেত এবং তা রাখা হত দিমিতারের মন্দিরে দেবীর সম্পদ হিসাবেই।
সুতরাং বিস্তারিত আলোচনা থেকে এটা অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করা গেল যে বছরের এই তিনভাগ করা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনার রূপক হতে পারে না। প্রাচীন দিমিতারিয়ান উপাসকগোষ্ঠীগুলিতে তার এই ত্রিমাত্রিক প্রকৃতি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। দিমিতার যে আবার হেকাটে তা আমরা আগেই দেখেছি এবং হেকাটে তিনলোকের অধীশ্বরদেরই ভার্যা। চন্দ্র শস্য ও প্রেতপুরী—এই তিন বিষয়ের সঙ্গেই হেকাটের গভীর সংযোগ রয়েছে। তার ধর্মীয় সংখ্যাও হল ৩ যা কীনা পাতাললোক ও মাটির নিচে বসবাসকারী সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলির প্রধান সংখ্যা যাদের সভ্যতা কীনা এখনও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে কুণ্ডলিনীর মণিপুর চক্রের(তৃতীয় চক্র) অভিজ্ঞতাতেই আটকে রয়েছে। পার্সিফোন মিথে তাই বছরকে তিনভাগে বিভাজন আধ্যাত্মিকতার ও পৌরাণিকতার একটি স্বতন্ত্র চিন্তন; উর্বরতা বা ঋতুচক্রের প্রাকৃতিক নিয়মের অন্ধ অনুসরণ নয়।

মেসোপটেমিয়ার উর্বরতা মিথঃ ইনানা/ইনান্না ও দুমুজ্জির আখ্যান
কৃষি ও ফলনশীল ঋতুগাথা এবং উর্বরতা মিথের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন আমরা পেয়ে যাই সুমেরীয় ইনানা-দামুজ্জি পুরাকথায়। আমরা প্রথমেই মিথটির মোটিফে গ্রীক পার্সিফোন-দিমিতার মিথের বিশেষ একটি সামঞ্জস্য পাই এবং তা হল পাতালগমন। শুধু পাতালগমন না বলে একে বলা যায় মৃত্যু-পাতালগমন-পুনর্জন্ম মিথ। এরইসঙ্গে প্রকৃতি-মহীয়সী মাতা মোটিফটি পাই। পাই কৃষিকাজ ও উর্বর ঋতুর ফলনের সরাসরি সম্পর্ক। আমরা ফ্রেজার ও ইয়ুঙীয় দিক থেকে এর ব্যাখ্যা পাই হয়তো সদর্থকভাবে। যদিও আমরা মূলত উর্বরতা মিথ নিয়েই আলোচনা করছি, তবুও অন্যান্য উর্বরতা মিথের সঙ্গে এর তুলনামূলক উপাদানগুলির বেশ কিছু পার্থক্য থাকায় এর এক নব্য ব্যাখ্যাও আমরা আলোচনা করব। সেখানে আর এটি উর্বরতা মিথ থাকবে না; বরং এক ব্যভিচারিণী দেবীর লালসা রিরাংসার মূর্ত আখ্যান হিসাবে প্রতিপন্ন হবে এটি।
সুমেরীয়দের পশুপালক থেকে কৃষক হওয়ার সময়ে রচিত এই অন্যতম আদিম মিথের স্বামী-স্ত্রী জুটি পশুপালক রাজা দুমুজ্জি-স্বর্গের দেবী ইনানা। ইনানার ভাই সূর্যদেবতা উতু দুমুজ্জিকে তার বোনের স্বামী হিসাবে চান, যদিও ইনানা/ইসতার কৃষকদেবতা এনকিমদুকে পছন্দ করতেন। এনকিমদু বহু শস্য ও কৃষিজাত দ্রব্য উপহার দিতে চায় দুমুজ্জিকে, যদিও সেই পশুপালক দেবতা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইনানাকে তার থেকেও অনেক বেশি উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুমুজ্জি তার পতি হন। এই পশুপালক রাজার সহধর্মিনী হিসাবে ইনানা হন উর্বরতা, শস্যবৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতার দেবী ও তার সঙ্গে সিংহাসনে বসে তিনি স্বর্গীয় শ্রীলাভ করেন। পরেও আমরা বারবার ইনানাকে রাজসিংহাসন ও মুকুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেখব।
প্রফেসর ক্রামারের অপরিসীম পরিশ্রমে মিথ টুকরো জড়ো করে করে ওল্ড টেস্টামেন্টের গাথার মূল ও আদিমতম যে মিথটি পাওয়া যায় তাতে ইনানা/ইসতার কেন পাতালে গমন করেন তার সঠিক কারণ পাওয়া যায় না, কিন্তু আমাদের জার্নি শুরু হয় ‘ডিসেন্ট অফ ইনানা’ থেকে।
পাতালের অধীশ্বরী ছিলেন ইনানার বোন এরেসকিগাল। তিনি তখন সদ্য বৈধব্যের যাতনায় দগ্ধ। তার স্বামী স্বর্গের বৃষ গুলুলাল্লার মৃত্যুতে শোকে কাতর। পাতালপ্রবেশের কারণ হতে পারে বোনকে সান্ত্বনা দেওয়া অথবা হয়তো প্রেতলোককে অধীনস্থ করার আকাঙ্ক্ষা। যাই হোক, পাতাল প্রবেশের আগে ইনানা তার অধঃস্তন সহচরী নিনসুবুরকে বলে যান যে, যদি তিনি ৩ দিনেও পাতাল থেকে ফিরে না আসেন তবে সে যেন পালাক্রমে তিনজনে শ্রেষ্ঠ দেবতার কাছে গিয়ে ধর্না দেয়; এনলিল, চন্দ্রদেব নান্না ও ব্যাবিলনের প্রজ্ঞার দেবতা এনকি।
রাণীর ভূষণে সজ্জিতা ইনানা পাতাললোকের দ্বারে গিয়ে সেখানকার দ্বাররক্ষকের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন ও পাতালের দ্বার না খুললে তা ভেঙ্গে ঢোকার হুমকি দেন। এরেসকিগাল এই সংবাদে তীব্র অসন্তুষ্ট হন। এরেসকিগালের নির্দেশে নরকের সাত দ্বারের রক্ষিকা ও পাতালের দেবীর অধঃস্তন সহচরী নেতি পাতালের আইন অনুযায়ী ইনানাকে প্রতিটি দ্বারে তার অলংকার ও বস্ত্রখণ্ডগুলি ত্যাগ করতে বলেন। এক এক করে দ্বারগুলিতে ইনানা ত্যাগ করেন তার মুকুট, নেকলেস, সোনার ব্রেসলেট, জুতো, ওড়না, বহিরঙ্গের পোশাক ও অন্তর্বাস। এইভাবে নগ্নিকা, অবনত মস্তক ও সকল দৈবীশক্তি হারানো ইনানার দর্পচূর্ণ সত্তাটি সিংহমস্তকা ও মানবদেহধারিণী, সর্পহস্তা এরেসকিগালের সম্মুখে উপস্থিত হল। তিনি ও পাতালের সাত বিচারক ইনানার বিচার করলেন। (এই কাহিনীতে বারবার ৭—এই সংখ্যাটি আসছে। আমরা ধারণাই করতে পারি যে সাত দ্বার সপ্ত কুণ্ডলিনী চক্র! এ কথা বলার আরও কারণ আছে।) এরেসকিগাল তার দিকে মৃত্যুর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেন, ক্রোধের শাণিত কটুবাক্য বর্ষণ করেন, অপরাধ অস্বীকার করার জন্য ব্যবহৃত কপট মিথ্যা বাক্যগুলি ছুঁড়ে দেন। ইনানা পচনশীল শবদেহে রূপান্তরিত হয়ে গেলে তাকে নরকের রাজসভার দেওয়ালে উল্টো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
তিনদিন তিনরাতেও ইনানা নরক থেকে না ফিরলে নিনসুবুর তার নির্দেশানুযায়ী ইনানার পিতা ও দেবতা এনকির কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এনকি নখের ময়লা দিয়ে নপুংসক দুই অদ্ভুত দর্শন প্রাণী তৈরি করেন। এনকি তাদের পুনর্জীবনলাভের জন্য প্রয়োজনীয় জাদুখাদ্য ও জীবনের জল সমেত নরকে প্রেরণ করেন।
তারা সেখানে গিয়ে দেখে নরকের দেবী যেন প্রসব যন্ত্রণায় ছটপট করছেন। তার স্তন উন্মুক্ত, কেশরাজি উদ্ভ্রান্ত ও দেহ বস্ত্রহীন। তারা দেবীকে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয়, বদলে রাণী তাদের ইচ্ছামতো বর দিতে সম্মত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছু স্তোকবাক্য দিয়েই তারা ইনানার মৃতদেহ দাবি করে এবং সাতবার পুনর্জন্মের খাবার ও জল মৃতদেহে ছিটিয়ে তাকে পুনর্জীবিত করে তোলে (৭ লক্ষণীয়)।
কিন্তু নরকের নিয়মানুযায়ী, নরক থেকে মর্ত্যলোকে ফিরে যেতে গেলে কাউকে তার পরিবর্তে গচ্ছিত রেখে যেতে হয়। এরেসকিগালের আদেশানুসারে নরকের গাল্লা দৈত্যেরা ইনানার সঙ্গে তার পরিবর্ত পেতে মর্ত্যলোকের দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটি দরজায় ইনানা তার বস্ত্র ও অলংকারগুলি ফিরে পেয়ে পুনরায় শক্তিমতী দেবী হয়ে ওঠেন। পৃথিবীতে ফিরে এলে ইনানা সখী নিনসুবুর বা পুত্র লুল্লুকে পরিবর্ত হিসাবে পাঠাতে নিমরাজি হন, কারণ তারা ইনানার জন্য শোকগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু তার পশুপালক স্বামী ও রাজা দুমুজ্জি তার স্ত্রীকে মৃত ভেবেই হোক বা নয়, রাজকীয় পোশাক পরে সিংহাসনে মহানন্দে বিরাজিত ছিলেন। স্বামীর মধ্যে কোনও শোক লক্ষ্য না করে ইনানা তাকেই নরকে তার পরিবর্ত হিসাবে পাঠানোর মনস্থির করেন।
বিপদ বুঝে দুমুজ্জি উতুর(সূর্যদেবতা ও ইনানার ভাই) শরণাপন্ন হন। দুমুজ্জির স্বপ্ন আখ্যান অনুযায়ী এবং দুমুজ্জির বোন জেসটিনানার সাবধানবাণী অনুযায়ী দুমুজ্জি প্রথমে ঘাসে, তারপর ছোট ঘাস থেকে বড় উদ্ভিদ হয়ে ডোবায় আশ্রয় নেন। উতুর ক্ষমতায় দুবার সাপ ও হরিণের বেশে পালিয়ে গিয়েও বন্ধুর প্রতারণায় শেষপর্যন্ত এক বুড়ির কুঁড়েঘর থেকে দানবেরা দুমুজ্জিকে ধরে নরকে নিয়ে যায়। যেমনভাবে সাত দরজার মধ্য দিয়ে গেছিলেন ইনানা, তারই মতো পুরো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
দুমুজ্জির মাতা সুতুর, বোন জেসটিনানা ও ইনানা তার পাতালগমনে শোকগ্রস্ত হয়ে তার খোঁজ শুরু করেন। দুমুজ্জির অবর্তমানে কৃষি ও প্রকৃতিতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত স্থির হয় জেসটিনানা দুমুজ্জির বদলে বছরের ছয়মাস নরকে থাকবেন এবং দুমুজ্জি মুক্তি পেয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তখন ঋতু অনুকুল হয় আর শস্য উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়ে ধরিত্রীরাণী পুনরায় উর্বর হয়ে ওঠেন। ইনানা ও দুমুজ্জির মিলন হয়। দুমিজ্জির আরেক নাম সুমেরীয়, আরাবিয়ান ও হিব্রু ভাষায় ‘জুলাই’। জুলাই থেকেই বর্ষাঋতু শুরু হয়।
দুমুজ্জির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম প্রকৃতপক্ষে একইসঙ্গে প্রাকৃতিক শস্য, ঋতু ও আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম। “beautiful indeed is the mystery given by the blessed gods: death is for mortals no longer an evil but blessing”.
প্রকৃতপক্ষে ইনানা ও এরেসকিগাল পরস্পরের মিরর ইমেজ; ইনানা যখন উর্বরতার প্রতীক এরেসকিগাল বন্ধ্যত্বের। এই দুই বোন প্রকৃতি ও তার দ্বান্দিকতা; ঋতুচক্র, দিন ও রাত, শীতলতা ও উষ্ণতা, আলো ও অন্ধকার, জীবন ও মৃত্যু—এর দ্বৈত প্রতীক। শেষপর্যন্ত তাকে অতিক্রম করে এক আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনার আভাস পাওয়া যায়।
ইউরোপীয় বা ভূমধ্যদেশের উর্বরতার মিথের পারস্পরিক তুলনায় এর মোটিফ বা প্রবণতাগুলি ধরা পড়বে। আগেই আলোচিত হয়েছে পার্সিফোন-দিমিতার মিথ। অন্যান্য মোটিফ ও সমান্তরাল গাথাগুলি আলোচিত হলে আমরা একটি সামগ্রিক ধারণা পাবো।
প্রথমত; উর্বরতার দেবীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন অপেক্ষাকৃত কম বয়স ও মর্যাদার পুরুষসঙ্গী। মেসোপটেমিয়ার মিথে এনলিল ও নিনলিলকেও পেয়ে যাই এর উদাহরণ হিসাবে। সিবিলি ও আটিস, পার্সিফোন-আফ্রোদিতি-এডোনিস, আইসিস ও ওরিসিসের মধ্যেও একই মোটিফ পাওয়া যায়। ইনানা কিন্তু একইসঙ্গে স্ত্রী, ভগিনী, মাতা এবং দুমুজ্জির নরকগমনের কারণ। আইসিস-ওরিসিস মিথেও এই সাদৃশ্য রয়েছে। যিশুমাতা মেরীও ধীরে ধীরে উর্বরতার দেবীতে পরিণত হন। তাকে দেবতাদের জননী, মর্ত্যলোকের রাণী, স্বর্গের রাণী, নারীদের নারী, পুনর্জন্মের কাণ্ডারী, চার্চের মাতা ইত্যাদি অভিধায় পরবর্তীকালে ভূষিত করা হয়েছে। আফ্রোদিতি-এডোনিস মিথও সরাসরি ইনানা-দুমুজ্জি মিথ থেকেই নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসবো।
দ্বিতীয়ত; রাজা ও পশুপালক হিসাবে দুমুজ্জির অবস্থান বিশেষ লক্ষণীয়। ওরিসিসও রাজা। তৎকালীন এই ভূমধ্যদেশীয় সভ্যতাগুলিতে রাজার অবস্থান পশু ও শস্যের উর্বরতার সঙ্গে সরাসরি সম্বন্ধীয়। পার্সিফোনের পাতালগমনের সময় তার সঙ্গী ছিল একজন শূকরচারণকারী এ আমরা আগেও দেখেছি। দুমুজ্জি পশুপালকরূপে দুগ্ধের প্রতীক যা পুনর্জন্ম ও শিশুলালনকারীরূপেও পূজিত হয়। আটিসও পশুচারণকারী এবং সে ও এডোনিস উভয়েই রাজপুত্র। ইনানা বহু জায়গাতেই রাজার সঙ্গে রাজসিংহাসনে আসীনরূপে চিত্রিত ও খোদিত। এগুলি সভ্যতার সেই স্তরের গাথা যে সন্ধিক্ষণে চারণ ও কৃষি সমান গুরুত্বে সহাবস্থান করছে। আমাদের দেশে রাজা জনকের কথা মনে পড়ে।
তৃতীয়ত; সাত এই সংখ্যাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যু, পরলোকযাত্রা ও পুনর্জন্মের জন্য। যেমন ইসতার/ইনানা ও দুমুজ্জি সাতটি দ্বারের মধ্য দিয়ে গমন করে নরকে পৌঁছোন, তেমনই সাতটি ধাপে কুণ্ডলিনী সহস্রার ভেদ করে। সাধকের দৈহিক মৃত্যু ও আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম হয়। ৭ পুরাকালের সাত গ্রহের অক্ষপথের সঙ্গে তুলনীয়।
তিন সংখ্যাটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে এই ভৌগোলীয় মিথগুলিতে এক ত্রিভুজ তৈরি হচ্ছে। দিমিতার-পার্সিফোন-হেডিস; আইসিস-অরিসিস-সেথ; ইনানা-এরেসকিগাল-দুমুজ্জি ইত্যাদি। তামুজ/জুলাই মাসে দুমুজ্জির পরলোকক্রিয়ার উৎসব তিনদিন ধরে চলে। অরিসিস ও এডোনিসের পুনর্জন্মের উৎসবও তিনদিন ধরেই চলে। পার্সিফোনের জন্য দিমিতারের শোকপালনের আচার-অনুষ্ঠানও তিনদিন ধরেই পালিত হয়। আমাদেরও ব্রাহ্মণদের উপনয়নে নবজন্মের আচারও তিনদিন ধরেই পালিত হয়। ৩ রূপকথাগুলিতেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি সংখ্যা।
বস্ত্র ও অলংকার মোচনের আচারও এই মিথের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতিটি মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মিথের সঙ্গেই বস্ত্রমোচন ও পরিধানের মোটিফ যুক্ত থাকে; যেমনকীনা অরিসিস ও আটিস মিথেও দেখা যায়।
আমরা এও লক্ষ্য করি যে, পাতাললোকে গমনের শোকপালন করেন দুটি নারী একত্রে। যেমন ইনানা ও জেসটিনানা, দিমিতার ও হেকাটে, আইসিস ও নেফটিস ইত্যাদি। এদের দ্বারাই পাতালগমনকারীর উদ্ধার হয়।
জীবনের জল আটিস অরিসিস ও খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষাকরণের সময়ও ব্যবহৃত হয়, যা ইনানাকে নবজীবন দিয়েছিল। গিলগামেশ মিথে যেমন দিয়েছিল সাপকে। মিথ্রা ও ইলিউসিস মিথেও এই মোটিফের দেখা পাওয়া যায়।
সর্বোপরি পুনর্জন্মের পর সকল নরকভোগী দেবদেবী পৃথিবীতে ফিরে এসে পবিত্র ও মহান বিবাহবন্ধনে পুনরায় আবদ্ধ হয়ে নতুন করে সমগ্র প্রকৃতিকে যেন প্রসব করেন। রহস্যবাদী ধর্মগুলিতে সর্বদাই বিবাহ ও দম্পতিযুগলকে উর্বরতার আর্কিটাইপ হিসাবে বন্দনা করা হয়। বহু প্রেমের ও বিবাহের গীতি ও মন্ত্র এদের জন্য রচিত ও গীত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে এই মিথমোটিফগুলি পশুপালক থেকে কৃষক হওয়ার এবং মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার সময়ের ফসল। মানুষের সভ্যতা গ্রামীণ থেকে নগরকেন্দ্রিকে পরিণত হওয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এই মিথের গূঢ় তাৎপর্য। এই জন্যই অনেক ঐতিহাসিক মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বেশ মিল পেয়েছেন।
মাতৃ গূঢ়ৈষা, লিঙ্গছেদন ভীতি ও বিপরীত ঈদিপাস তত্ত্ব দিয়ে মনোসমীক্ষণ একে ব্যাখ্যা করে যেখানে পাপবোধ—পুনরুদ্ধার, পরিণত-অপরিণত নারী-পুরুষের মনের অবস্থা ও আনন্দ-শোকবোধের দ্বৈততা বিদ্যমান।
আধ্যাত্মিক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে আত্মার বস্তুগত হওয়াই পাতালগমন আর জীবাত্মার পরমাত্মায় মিলনই উর্দ্ধগতি। বস্তুর আধ্যাত্মিকরণই পাতালগমন ও চৈতন্যের পুনর্বিজয়ই হল তার মুক্তি। এইজাতীয় তাৎপর্যই রামায়ণের মিথের।
এই প্রতিটি ক্ষেত্রের দ্বান্দ্বিকতাই গঠনবাদীদের প্রধান নিরীক্ষার জায়গা।
ইয়ুঙীয় তত্ত্বে হয়তো ইনানা দুমুজ্জি পুরাকথা ব্যক্তিরূপায়ন প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত যেখানে হয়তো এরেসকিগাল ইনানার মানস ছায়া। তারা একই সত্তার মধ্যের চরম বৈপরিত্যের নিদর্শন। কিন্তু ‘ডিসেন্ট অফ ইনানা’য় সর্বশেষে এরেসকিগালকেই বন্দনা করা হয়েছে। ইনানাকে নয়। অন্যদিকে শাস্তিপ্রাপ্ত দুমুজ্জি বা জেসটিনানার কোনো দোষ নেই। তারা ইনানার ইচ্ছার জন্যই বলিপ্রদত্ত হয়।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার এই মিথ প্রসঙ্গে অবস্থান আমরা তাদেরই পুরাতন গিলগামেশের গাথা থেকে স্পষ্টভাবে পেয়ে যাই। গিলগামেশ দুভাগ দেবতা, একভাগ মানব কিংবদন্তী। এবং একজন পরাক্রমী ও সুশাসক রাজা। সেই গাথা অনুযায়ী, রাজা গিলগামেশ ও এনকিদু দানব হুমবাবাকে হত্যা করলেন এবং পরে রাজা গিলগামেশের রাজকীয় পোশাক ও ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হন দেবী ইনানা/ইসতার। তিনি গিলগামেশকে প্রণয় নিবেদন করেন কিন্তু গিলগামেশ তা প্রত্যাখ্যান করে এই বলেন যে, দেবী নিজের চাহিদা মিটলেই প্রণয়ীদের সর্বনাশ করেন (যেভাবে কোনো অপরাধ ছাড়াই দুমুজ্জিকে শাস্তি পেতে হয়)। ক্রোধে দেবী প্রতিশোধপরায়ণা হয়ে পিতা-দেবতা এনকির শরণাপন্ন হন। এনকিকে বাধ্য করে ইনানা স্বর্গের ষাঁড় গুগালান্নাকে চেয়ে নেন গিলগামেশকে আক্রমণ করার জন্য। যদি তা না করা হয় তবে দেবী নরকের দ্বার খুলে দিয়ে অশরীরী দিয়ে পৃথিবী পূর্ণ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন; ঠিক যেমন ইনানা-এরেসকিগাল গাথায় আমরা দেখেছি যে দেবী নরকের দ্বারে এসে তা খুলে দেওয়ার জন্য একইরকম কথা বলেছিলেন। এবং এই স্বর্গীয় ষাঁড়ই এরেসকিগালের স্বামী যাকে গিলগামেশ ও এনকিদু বধ করেন।
এনকিদু সেই দৈত্য ষাঁড়ের পা খুলে নিয়ে দেবীর দিকে তারই প্ররোচনায় ছুঁড়ে মারেন। এতে মরণশীল দ্বারা দেবতাদের অপমান হয়েছে—এই অভিযোগে এনকিদুর প্রাণ নিয়ে নেওয়া হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আসন্নপ্রসবা বিধবা বোন এরেসকিগালের স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ইনানাই; অথচ তাতে তার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। উল্টে প্রায় মজা দেখতেই তিনি নরকে ভগ্নীপতির শেষকৃত্যে যোগ দিতে যান। দেবীর পাতালগমনের কারণ এই জন্যই ছিল ধোঁয়াশাময়, যা এখন টুকরো জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে অনেক স্পষ্ট। দেবী যেমন এনকিদু ও নিরপরাধ তিনশত লোকের মৃত্যুর কারন, তেমনি তার স্বামী ও ননদেরও দুর্দশার কারন। সুতরাং এই কাহিনিকে উর্বরতা মিথের পরাকাষ্ঠা বা পুনর্জন্মের ও আত্মজ্ঞান লাভের দিকে যাত্রার ইয়ুঙীয় ব্যাখ্যা থেকে সরিয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষদের মতো স্বভাবের দেব-দেবীর দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচারের কাহিনি বলেই মনে হয়।

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes