
আবিদ আজাদ:এক আত্মনির্জন কবি
সুবীর সরকার
আবিদ আজাদ।বাংলাদেশের কবিতায় এক ব্যতিক্রমী স্বর।সত্তরের এই কবির আয়ুষ্কাল ১৯৫২_২০০৫।তিরিশ বছরের কবিতা লিখবার জীবনে প্রকাশিত হয়েছে ১৪ টি কবিতার বই।লিখেছেন দুটি কবিতা নাট্য_”লাল চোখ” ও “সুন্দর”।
সম্প্রতি কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী আমাকে আবিদ আজাদের কবিতা সংগ্রহ পড়বার সুযোগ করে দিয়েছেন।প্রায় দিন ১৫ আমি এই কবির কবিতার ভেতর প্রায় ডুবেই ছিলাম। সে এক অদ্ভুত অবগাহন।আমি কবি আবিদ আজাদকে নুতন করে আবিষ্কার করলাম।চিনলাম।জানলাম।এক অপার মায়া বিছানো আবিদ আজাদের কবিতা ভুবন।যদিও তার কিছু কবিতা বন্ধু কবি মাসুদার রহমানের সৌজন্যে আমার পড়া ছিল।
কিন্তু কবিতা সমগ্রে আমি তীব্র ভাঙচুর নিয়ে সম্প্রসারিত কবি আবিদ আজাদের কবিতার যাত্রাপথ আর তার বাঁকগুলিকে নিজের ভেতর জড়িয়ে নিতে পারলাম।
আবিদ আজাদের কবিতার পরতে পরতে সময় সমাজ দেশ কাল মাটি বাতাস আর আন্তর্জাতিক এক সম্পর্কসূত্র কি তীব্র জায়মান!
একদা বাম ধারার রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে থাকা কবি আবিদ আজাদের কাছে কবিতা আসলে এক স্বনির্বাচিত কাটাকুটির ভুবন।আত্মক্ষয় দিয়ে প্রতিটি একাকী শ্রম কবির ইতিহাস ভূগোলের ভেতর ক্রিয়াশীল থাকে।
পড়তে পড়তে ঘোর লেগে যায়।আবিদ আজাদের কবিতা জুড়ে প্রাকৃতিক রৌদ্র,বৃষ্টির পুষ্টি আর ধারাবাহিক স্মৃতির প্রহার।
২.
১৪ টি বই পুরোটা পাঠের পর কিন্তু বেশ অনুভব করতে পারি সবগুলি বই নিয়ে লিখে ওঠা কিছুতেই সম্ভব নয়।খেই হারিয়ে ফেলবার তুমুল আশঙ্কা সেখানে।
সুতরাং,অনুজ অরবিন্দ চক্রবর্তীর প্রস্তাবকে মান্যতা দিয়ে আমি কবি আবিদ আজাদের “আরো বেশি গভীর কুয়াশার দিকে” এই বইটি নিয়েই বরং কিছু বলি।
আরো বেশি গভীর কুয়াশার দিকে কবিতার বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে।
বইটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৩৬ টি কবিতা।
গোটা বই জুড়ে কবি আত্মগত এক ভঙ্গিমায় দেখা ও না দেখাকে স্মৃতিসূত্রে কেবল গেঁথে দিয়েছেন।
এক আলোপৃথিবির গান গেয়েছেন কবি।
আবহমান আর চিরায়ত চলনে মায়াবাংলার ছবির পর ছবি।খুব সহজ ভাষায় ইঙ্গিত ইশারার দোহারে কি তুমুল স্বরাট আবিদ আজাদের কবিতা।
আবিদের এই বইয়ের কবিতায় সাবলীল চলে আসে বর্ষার সোনাব্যাঙ,জুবুথুবু মেঘ,আর ডাস্টবিন উল্টে থাকা ফুটপাতের পাশে খুব একা এক মফস্বলের সন্ধ্যে।
আবিদ আজাদ বলে ওঠেন_
“আমি বিষন্ন চিবুকের সেই মেয়েটির
বিষন্ন হয়ে বসে থাকবার স্মৃতি
কোনদিন ভুলতে পারবো না।”
কেমন আনমনা হয়ে পড়েন পাঠক!
পাঠক স্থির থাকতে পারেন না।পাঠকের স্থবিরতা ভেঙে পরে।
আবিদ তখন আবারও বিদ্ধ করেন পাঠকের সমস্ত মনোযোগ_
“একদা তোমার রাজভিখিরির মতো গলা শুনে
আমাদের দেশে শুরু হয়ে যেত বসন্তউৎসব;
বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে মেয়েরা গাইত স্তব,
পাড়া বেপাড়ায় ছুটত ফোয়ারা_রাষ্ট্রীয় গুঞ্জন।”
ভোর কিংবা মেঘের হাওয়ার ডানায় ভর দিয়ে পাঠক বুঝি এক পুরাণের দিকে অন্তহীন উড়ানে যাবার প্রস্ততি শুরু করে দিতে থাকবে এই পংক্তিগুলি আঁকড়ে ধরে।
কবি আবিদ আজাদ আমাদের স্নায়ু আর তন্দ্রাকে তছনছ করে দিতে জানেন।ম্যাজিশিয়ানের মত কুশলী কলম থেকে আমাদের জন্যই বুঝি বেরিয়ে আসে এমন সব লাইন_
“তোমার অপরাহ্নের আলো শুষে নেয় জ্বর ও ব্যাধির
উত্তাপ
তোমার উপস্থিতির মধ্যে আমার তরঙ্গক্ষুব্ধ পৃথিবীর
অস্তিত্ব
মা,তোমার মুখ আমার আবহমান নিসর্গ,আর আমি
তোমার একান্ত নির্ভর।”
কি অমোঘ!মধ্যনিশীথের কোকিলের ডাক নিয়ে চুরমার করে দেয় আমাদের অন্তর্গত মহাল!
৩.
আবিদ আজাদ সেই গোত্রের একজন শব্দশিল্পী যাকে পাঠ করতে হয় খুব নিবিড়তা নিয়ে।
শৌখিন আর সুখী কবিতার পাঠকদের জন্য তিনি নন।মেধা,মনন,স্বপ্ন,দেশ,মাটি,মানুষ,বৃক্ষ,পাখি,নদী,জলাশয় দিয়ে আবিদ আজাদ তার কবিতার পরিসর নির্মাণ করেন।পাঠকের জীবনবোধ কেঁপে ওঠে তার কবিতায় প্রবেশ করবার পর।
“নজরুল এবং একটি লাল চিরুনি কবিতায়” তিনি লেখেন_
“সেই লাল রঙের চিরুনিটা আমি হারিয়ে ফেলেছি আবার
মনে হয় বাংলা কবিতার জন্য ওরকম একটা লাল
চিরুনির বড়ো প্রয়োজন আজ
লাল রঙের তীব্র একটা চিরুনি
আছে আপনাদের কারো কাছে?”
আমি একজন পাঠক হিসেবে চুরমার সমুদ্রের ভেতর ডুবে মরতে থাকি।
আর দেখি কবি আবিদ বিড়বিড় করে খুব নিচু সুর জাগিয়ে দিয়ে বলছেন_
“হে আল্লাহ তুমিই মাবুদ,আর আমের বউল হয়ে
আমার বুকে আছেন আমার দুঃখের রসূল।”
গহিন এক জীবনবোধ,সহজিয়া দর্শন দিয়ে সেজে ওঠে আবিদ আজাদের কবিতার চাঁদ ধোয়া উঠোন।
স্মৃতি,প্রেম,অপরূপ দৃশ্যসকল আমাদেরকে বড্ড উন্মনা করে তোলে।
কজন কবি পারেন এভাবে পাঠককে নিবিড় আর মেদুর করে তুলতে!
এখানেই কবি আবিদ আজাদ তার জাত চিনিয়ে দেন।
(আবিদ আজাদ বাংলা ভাষার একজন আধুনিক কবি। তিনি বাংলাদেশের বিংশ শতাব্দীর কবিতার ইতিহাসে সত্তর দশকের সঙ্গে চিহ্নিত। তার কবিতা লিরিকধর্মী, অনুচ্চকণ্ঠ এবং চিত্রময়। তিনি শিল্পতরু সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন।
জন্ম
১৬ নভেম্বর ১৯৫২
মৃত্যু
২২ মার্চ ২০০৫
মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।)
ঋদ্ধ হলাম।