আবহমান উৎসব সংখ্যা,২০২১
আবহমান উৎসব সংখ্যা, ২০২১। সূচি - গৌতম বসু-র অপ্রকাশিত কবিতা, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, গৌতম চৌধুরী, রাহুল পুরকায়স্থ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, শংকর চক্রবর্তী, দীপক রায়, সৌম্য দাশগুপ্ত, সর্বজিৎ সরকার, সব্যসাচী সরকার, সুদীপ বসু, সৈকত ঘোষ, সেবন্তী ঘোষ,ঋজুরেখ চক্রবর্তী, যশোধরা রায়চৌধুরী, পূর্বা মুখোপাধ্যায়, নীলাঞ্জন হাজরা, অনিন্দিতা গুপ্ত রায়, শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী, চন্দন ঘোষ, তৃষ্ণা বসাক, মনোনীতা চক্রবর্তী, সেলিম মণ্ডল, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিশংকর বিশ্বাস, অনুপ সেনগুপ্ত, প্রসূন মজুমদার, পঙ্কজ চক্রবর্তী, পার্থজিৎ চন্দ, রাণা রায়চৌধুরী, সুবীর সরকার, পায়েল সেনগুপ্ত স্নেহাশিস পাল, শৌভ চট্টোপাধ্যায়, তৃণা চক্রবর্তী, শতানীক রায়, রিনি গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দাশগুপ্ত, শ্যামশ্রী রায় কর্মকার, পলাশ দে, সুদেষ্ণা ঘোষ, সোনালী চক্রবর্তী, তন্ময় ভট্টাচার্য, উৎপল চক্রবর্তী, গৌতম মণ্ডল, সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়, সার্থক রায়চৌধুরী, সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বেবী সাউ, কস্তুরী সেন, শাশ্বতী সান্যাল, অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়, তৃষা চক্রবর্তী, সায়ন রায়, সন্দীপন চক্রবর্তী, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়, মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া, সন্মাত্রানন্দ,, সোনালী ঘোষ, শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী, ঈশানী বসাক, জাতিস্মর, রণজিৎ অধিকারী, অদিতি বসুরায়, সৌভিক গুহসরকার, প্রগতি বৈরাগী একতারা, শর্বরী চৌধুরী, শীর্ষা, স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোতোষ আচার্য, নীলাদ্রি দেব, রুমা তপাদার, প্রত্যূষা সরকার, অরিজিৎ চক্রবর্তী, রাজেশ্বরী ষড়ংগী, শূদ্রক উপাধ্যায়, পৌলমী গুহ, শুভম চক্রবর্তী এবং হিন্দোল ভট্টাচার্য
গৌতম বসু-র অপ্রকাশিত কবিতা
জরাবর্গ থেকে নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা
পিঠে যে বাদ্যযন্ত্রটি বাঁধা রয়েছে
অতর্কিতে, শতখণ্ডে ভেঙে পড়েছে কিসের অন্তরাল,
কে জানে কেন, মৃদু ঝড় উঠেছে, ঘণ্টাধ্বনি শুনছি,
এত দুর্ভাবনার স্তর কেন দেখি, আকাশপরিবারে ǁ ১
সত্য এই, বাহিরে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। সত্য এই, অলক্ষ্যে
যা ঘটে তা সূক্ষ্ম ও অধরা; তোমার ভিখারীর বেশ,
ওই ফাঁকা রাস্তা, এদের কোনও বিবরণ লেখা যায় না ǁ ২
আত্মগ্লানির নদীতীরে ঘুরি। এইখানে সে এসেছিল,
হত্যার মতো অভ্রান্ত, মাটি পুড়ে গেছে কোথাও-কোথাও ;
মাটি পুড়ছে, এ-ছাড়া বলার মতো কোনও বিষয় নেই ǁ ৩
পশুর শরীর আর গন্ধর্বের মন নিয়ে বেঁচে উঠি,
পিঠে যে বাদ্যযন্ত্রটি বাঁধা রয়েছে সেটি আমার নয়;
দেহমনও নয়, কেবল তোমার উপহাসটি আমার ǁ ৪
৯ ভাদ্র-৭ই আশ্বিন ১৪২৪
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
ক্ষণ
আমার ও আমার মায়ের জন্মলগ্ন ছিল কোনো এক
অপরাহ্ন চৌঠা মাঘ পড়ন্ত রোদের প্রান্তদেশে
সুদীর্ঘ স্মৃতির ছায়া যেখানে তীর্যক হ’তে হ’তে
ঈষৎ সোনালি রঙ…তখনই জলঘড়ি থেকে টুপ্…
শব্দের তন্মাত্র হয়ে প্রথম খসেছে তারও আগে
আকাশ বিজ্ঞানশূন্য, তুমি আমি কিছুই ছিল না।
কালগণার সেই সূচনায় যে আদি পুরুষ
তিনিই আমার বাবা। অবিকল তাঁরও জন্মক্ষণ
অপরাহ্ন চৌঠা মাঘ…তারও আগে মহানাস্তি, কোনো
দুপুর ছিল না আদি বিশ্বাণু বীরভূম থেকে এই
প্রকৃতি ও প্রাণীকুল, বৃক্ষরাজি, বায়স, চড়ুই
কোকিলাদি নানা পক্ষী নিচে ধূলি ধূসরিত পথে
কতিপয় অজ, গাভী, সারমেয় তথা চতুষ্পদ
শিশুবিশ্ব- সেও তার আপন রিঙ্গনলীলা কাল
পার হচ্ছে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে কোনো এক
চৌঠা মাঘ, তেরশত বাষট্টি বঙ্গাব্দ অভিমুখে।
গৌতম চৌধুরী
এক টুকরো
পাথর দিয়া গাঁথা বাক্সের ভিতর থাকিয়া থাকিয়া নড়েচড়ে এক কঙ্কাল। হয়তো কাঁপিয়া উঠিল একটি মাত্র আঙুল। বা, কোটরের নিচে না-থাকা চোখের মণি। পাথর দায়িত্বশীল। পাথর অস্বচ্ছ। ভিতরের কথা কেহ কিছুই টের পায় না। শুধু কঙ্কাল টের পায়, যে, সে বাক্সের বাহিরে। সে আমবাগান বাঁশবাগানের পাশ দিয়া হাঁটিতেছে। হাঁসচরা পুকুরের পাশ দিয়া, সরিষা ক্ষেত তিসি ক্ষেতের পাশ দিয়া, হাঁটিতেছে। বাঁকা নদীটির কাছ বরাবর আসিয়া এইবার সে ডানা মেলিয়া দিল। শরৎ হেমন্তের ভিতর দিয়া, শীত বসন্তের ভিতর দিয়া। পাথর তাহাকে আটকাইবে কোথায়!
মনকে বাঁচাইয়া রাখা মুশকিল। অথচ সকল কলকবজা তাহার হাতে। সে চাহিলে, চোখের পলকে শূন্যে মিলায় শৃঙ্খল। সে চাহিলে, সাত সমুদ্র তের নদী পার। কিন্তু চাহিবে কে? গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া মন তো গাড়লের মতো বসিয়া আছে। গা বাহিয়া উঠিতেছে কেঁচো কেন্নো পিঁপড়ার সারি। এঁটুলির মতো রক্ত খাইতেছে জোঁক। কোনও দিকেই তাহার গা নাই। যেন চারিদিকে এক পাথরের বাক্স। তাহার ভিতর এলাইয়া পড়িয়া আছে এক কঙ্কাল…
রাহুল পুরকায়স্থ
বহ্নিপথ
(কবি গৌতম বসুর স্মৃতিতে)
ধায় বৃক্ষ। তারা জাগে সারারাত। তুমি অনুবাদ করো
এই পথসমূহের, অগ্নিসমূহের, বৃক্ষসমূহের!
এরা সেই মৃত্তিকার
একদিন সীমানা পেরিয়ে এসেছিল,
‘জল দাও, ফ্যান দাও’ ধ্বনিতে মুখর এই জলে
ভেসে গিয়েছিল,
তাদের ভূমিকা করো, বলো, বন্ধু, আমিও চেয়েছি ত্বক
আগুনের, শান্তির ও তান্ত্রিকতার,
যেন বাতাসের আগে আগে ছুটে যেতে পারি,
পথের শিকড়ে যেন পিঁপড়ে-জীবন খুঁজে পাই,
কলহের শেষে পাই চাঁদ-ভাঙা রাতের আহার
দেহজলে নৌকা চলে। মাঝি কই!
এসো তার কথা বলি
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
বাজনার মতো
তোমার লাইটার জ্বললে বিঠোভেন বেজে উঠত।আমার ফোন জাগত,রাজেশ্বরী দত্ত-র গানে।উৎসব, চুমুকে খেতাম আমরা। কাউকে ক্ষতবিক্ষত দেখলে, লজ্জা পেতাম একসঙ্গে।লিণ্ডসে স্ট্রিটের রামধনু গড়িয়ে নামত যেই ভিখিরির পিঠে, পালাতে পালাতে, ধর্মতলার মোড়ে, রঙের দোকানে থেমে,স্বস্তি পেতাম। তুমি বলতে,’এ শহরে প্রেম করা যায়,বলো!’ ‘তার আগে নর্দমার জল খেয়ে শুদ্ধ হতে হয়,’ জবাব দিতাম! এভাবেই গদ্যকবিতা লেখা,আর,রোগ শোক অসুখবিসুখ, এসে সেইসব পাতাগুলো উড়িয়ে দেবে।রোজ,এরকম।…
আসলে এমন কিছু কখনো হয়নি। সব, মিথ্যেকথা!তবু কল্পনা করতে ক্ষতি নেই
শংকর চক্রবর্তী
মঞ্চ
কিছু বার্তা দিতে মঞ্চে উঠে পড়েছিলে
আশ্চর্য জটিল কালো মাথাগুলি দুলে দুলে বাতাসে উড়ছে
এতকাল এইসব মাথা সত্যি যে গোবরে ভর্তি ছিল
এমন কথা তো কেউ বলেনি কখনো
মঞ্চে শুধুমুধু রাগ দেখিয়েছো তুমি
হাতের দ’দিক যেন দু’রকম রঙে মাখামাখি ম্যাজিকও দেখাও প্রয়োজনে
পিঁপড়ের সারি
ওইতো মাথার দিব্যি দিয়ে হু হু লড়ে যায় দুরন্ত কেঁচোরা
মলিন মুখের পাশে দুনিয়া জয়ের হাসি তোমাকে কীভাবে একদিন সার্কাসের মঞ্চে তুলে দিল তুমি বুঝতে পারোনি।
দীপক রায়
আজ আমার ঘরে
আজ আমার ঘরে খুব হাওয়া
আজ আমার ঘরে কত আলো
আজ আমার ঘরে ঘন মেঘ
আজ আমার বিজলির আলো
আজ আমার — জুতা হ্যায় জাপানি
আজ আমার– টোপি ইংলিস্তানী
আজ আমার ঘরে আছো তুমি
আজ আমার — জুতা হ্যায় জাপানি
আজ আমি বেঁধেছি দু’চোখ
আজ শুধু কানামাছি খেলা
আজ আমার আনি বানি মানি
আজ আমার মিছে তালিবানি
আজ আমার– জুতা হ্যায় জাপানি
আজ আমার– টোপি ইংলিস্তানী
আজ আমি বলব না কিছু
আজ আমি শুনে নেব সব
আজ আমি বলব না কথা
আজ আমার– জুতা হ্যায় জাপানি
আজ আমার– টোপি ইংলিস্তানী
সৌম্য দাশগুপ্ত
ভদ্রাসন
লিপিকা সর্পিল, তাকে প্রতিবাদে ছোবল মেরেছে
ভাঙেনি ধানের শীষ, রূহ্ ভরে গেছে অভিমানে
এই কলাক্ষেত্রে আল ধরে যদি ত্রিসীমানা হাঁটো
চর্যার অরন্ধনে ম্লান হয়ে যায় দশ দিক
ভাবি তাকে সংবেদনে করপুটে বীমার সেবায়
সুরক্ষিত রাখি, তবু সেকথা সে শোনেনা শোনেনা
ভান যদি করো, তার বেদনাও তদূর্ধ বলয়ে
চক্রাকার ঘোরে, এই মূর্খতাকে যত্নে বেঁধে রাখা
প্রত্যয়ের দগ্ধতায়, বিকিরণে, মমতায়, ক্লেশে
অসর্পিল সরলতা শিখে নেয় এই ভদ্রাসন ॥
৭ অক্টোবর, ২০২১
সর্বজিৎ সরকার
অবাঙমনসোগোচরম
কথা। জলের প্রত্যাশী হতে চেয়ে
পথে পথে ঘুরে ঘুরে, কবে যেন
নির্বাহী হয়ে গেছে। উদাসী তবু
বহন করে না কিছু আর।
কথা। একদা সংলাপে শিশির
ভোর, মহালয়া। আসন্ন আলোর
আকাশ। রাত্রি ও ঊষা
জল পারাপার করে নিত্য সারারাত।
জল। বহন করে মন। মনের
সারাৎসার জল, তবু জল বাহক মাত্র।
কৃষিক্ষেতে সেচ। তৃষ্ণায় আশাবরী।
মনবাহী আদিহীন অন্তহীন জল।
অজ্ঞাত সূর্যোদয়ে আজ, সে নীরকথা
অবাঙ মনের আত্মা। নয়নে অগোচর।
সব্যসাচী সরকার
বৈষ্ণবপদাবলী
ছুঁকছুঁক করার ধারাবাহিক প্রবণতা
জোকারকে যেখানে দাঁড় করায়,
তার চারপাশে রোমহর্ষক বৈষ্ণবপদাবলীর গন্ধ।
এখান থেকেই তা হলে লীলাখেলা শুরু,
ভাবে জোকার।
কীর্তনে হরিনাম, দূরে দূরে লন্ঠন জ্বলে।
গ্রামদেশে গোপনে গোপনে,
জানলার কোণে ঠিক সরে যায় কেউ।
ভীরু প্রেম জেগে থাকে,
পুড়ে যায় ঘৃত—
জোকারের ঠোঁটে বিষ, মহিলাঘটিত…
সুদীপ বসু
রেডিও
একদিন আচমকা রাঙপিসির দুব্যান্ডের ছোট্ট ‘মার্ফি’ রেডিওটা খারাপ হয়ে গেল। রেডিও ছিল রাঙাপিসির প্রাণ। দিনরাত রাঙাপিসি রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনত। রেডিওর জন্য রাঙাপিসির বিয়ে মাঝপথে দুম করে ভেঙে যায়।
কিন্তু একদিন রেডিওটা খারাপ হয়ে গেল। দিনের পর দিন যুদ্ধের কোনো খবর নেই। রাঙাপিসির দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। খুব একলা কোণঠাসা লাগত নিজেকে। জনে জনে লোক ধরে ধরে রেডিওটা সারাই করে আনার জন্য কান্নাকাটি করত।
ছ’জন রেডিওপরীক্ষক রেডিওটা দেখেশুনে ফেরত দিয়ে দিল। সব ঠিকঠাকই আছে । তারা জানাল। তিনজন রেডিওবিশারদ সব কলকব্জা একে একে খুলে আবার একে একে লাগিয়ে দিল। না কোথাও কোনো যুদ্ধের খবর লেগে নেই। তারাও জানাল রেডিওটা ঠিকই আছে। পাঁচজন রেডিওবিশেষজ্ঞও একই কথা বলল।
ভিজে মেঘের বিকেলে, হেমন্তের শেষবেলা , মুহুর্মুহু আকাশগর্জনের মাঝখানে হা-খোলা জানলার বাইরে তাকিয়ে রাঙাপিসির মন অন্ধকার হয়ে যেত। তখন সেই দুম করে ভেঙে যাওয়া বিয়ের কথা মনে পড়ত খুব। কলোনিমাঠের সেই শনশনানি ছায়া-অন্ধকারে একটি মনমরা নক্ষত্রের ভিতর থেকে যেন সে এসে দাঁড়াল। সেই নক্ষত্রপুরুষ। ‘ভুল হয়ে গেছে , বিজু , ফিরে চলো। চলো না!’ কিন্তু রাঙাপিসি ফিরেও তাকাত না। বলত, ‘ছাই যাবো। ছাই।’
পাঁচহাত ঘুরতে ঘুরতে রেডিওটা একদিন শহরের এক ডাকসাইটে ইন্জিনিয়ারের হাতে এসে পড়ল। তিনি তাঁর নিজস্ব ল্যাবরেটারিতে প্রায় আড়াই মাস ধরে গভির পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানালেন, ‘রেডিওটা একদম ঠিকই আছে, কেবল যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেছে।
তা শুনে রাঙাপিসির সেই কূল- আছড়ে- পড়া কান্না আমি কোনদিন ভুলব না। খুব বৃষ্টির রাতে, নিকষ অন্ধকারে, মাঠঘাট ভেসে যেত যখন, অ্যাসাইলামের তিনতলার জানলায়, বিদুৎচমকে দেখা যেত, সারা শরীর চাদরে মোড়া, প্রেতের মতন রাঙাপিসি, জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হ্যাঁ যুদ্ধের অপেক্ষায়।
সৈকত ঘোষ
আইকন
মুহূর্তের জলসায় বৈভব নিভে যায়
পাশাপাশি চেনা হুইলচেয়ার
মুখচিত্রে লিবার্টি হেসে ওঠে
শুষে নেয় আবহমান ঈর্ষার মিথ
সুযোগ আসলে অপ্রস্তুত আগুন
মেট্রো-শহরে প্লাগইন জোনাকি রাত
ভালোবাসার ফেব্রিকে দৃশ্য বদলে যায়
হঠাৎ গজিয়ে ওঠে একচেটিয়া অধিকার
চুঁইয়ে পড়া বিকল্পে
জীবন খুঁজে পায় জাঁদরেল অভিনেতা
দম দেওয়া পুতুলের মতো সে নাচে গায়
মৃত চোখে কী পারফেক্ট এক্সপ্রেশন!
সেবন্তী ঘোষ
দুটি লেখা
সীমান্ত
১
বাতাস থাকে তেমনি উতলা,
ওপারে পৌঁছানোর তাড়া একই রকম,
এক টুকরো কাগজ যেখানে রক্তলেখায়,
এক লহমায় ভাগ্য বদলে দেয় অযুতের।
লাইন যেমন স্পষ্ট, তেমনি অস্পষ্টও খুব,
কল্পিত পর্বত চূড়ায় এক ফাটলের মতো,
সে আড়মোড়া ভাঙতে পারে,
ফালাফালা করে একান্ন পীঠে
ছড়িয়ে দিতে পারে দেহ,
একেকটা অঙ্গে চেকপোস্ট বসে, খানাতল্লাশির,
নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, ওই মন্দিরের-
তদ্গত সেবায়েত তুমি, প্রকৃত প্রেমিকও!
২
পাখি খুঁজে পাবে না,
পিঁপড়ে ও না!
তুমিও না।
নদী তো আরোই না!
নস্য থেকে গুলতানি,
আরক থেকে গরু ,
এপার ওপারে চলে যাবে,
জল বেকুবের মতো ঝরবে,
দানব ট্রাকের ওপর আছড়াবে বর্ষা ,
ওপারের শ্বাসমূল এপারে জেগে উঠবে,
অনবধানে পা গেঁথে যেতে পারে তাতে,
দুটো কুঁড়িও ফুটে উঠতে পারে!
ঝরাফুল সরে সরে ভুলিয়ে দেবে ,
জোছনায় শিকারে বেরোবে শেয়াল,
প্যাঁচার মুখ থেকে এপারে ধড়,ওপারে মুন্ড!
প্রতিটি সীমান্তে তুমি,
এমনই চমৎকার দৃশ্য দেখতে পারো,
মানুষের শ্রেষ্ঠ কল্পনাই পারে
এমন অদৃশ্য দৃশ্যের জন্ম দিতে!
ঋজুরেখ চক্রবর্তী
রাতঘুম
কোনওকিছুই সহজ থাকে না আজীবন। কোনওকিছু আজীবন সরলও থাকে না আর ছকবাঁধা ঐকিক নিয়মের মতো।
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এখন তোমাকে একবার টুক করে হাতঘড়িতে বা মাথার বালিশের পাশে রাখা ফোনে সময়টা দেখে নিতে হয়। এই দেখে নেওয়াটা জরুরি কেননা অভিজ্ঞতা থেকে তুমি জেনেছ, রাত নামক সময়কালটার সর্বজনমান্য কোনও শুরু ও শেষ নেই, রাত হল বহমান অন্ধকারের এক অতিযাপিত নিভৃতি মাত্র। প্রেমিকের রাত, সন্ন্যাসীর রাত, একজন খেলোয়াড়ের রাত, এই প্রত্যেকটা রাত আলাদা আলাদা, কিংবা ধরো একজন হাঁপানি রোগীর রাত। এবার, তুমি যেহেতু তোমার আশপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এই অসংখ্য রাতের ভেতর থেকে যেকোনও একটা রাত একেকদিন ইচ্ছেমতো বেছে নিতে পার, তাই প্রত্যেক রাতেই ঘুম কিংবা ঘুমের মায়ার মাঝখানে সহসা জেগে গেলে সময়টা দেখে তোমাকে বুঝে নিতে হয়, শুরু না কি শেষ, কোন অর্ধে তুমি আজ ছেড়ে রেখে এসেছ তোমার স্বপ্নগুলোকে, বুঝে নিতে হয় ঠিক কোন ভঙ্গিতে এবার তুমি সিগারেট খেতে উঠবে, বুঝে নিতে হয় বারান্দার রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নীচে আলোধোয়া চওড়া রাস্তাটা আর রাস্তার ওপারের বাড়িগুলোর অন্ধ আলো-অন্ধকার জানলাগুলোর মধ্যে ঠিক কোনদিকে দৃষ্টিপাত করলে তোমার অস্থির অন্তঃকরণ হয়ে উঠতে পারবে অস্থিরতর, আর ফের এসে শুয়ে পড়ার আগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে টয়লেটের খোলা জানলা দিয়ে নাম-না-জানা কোনও পাখির ডাক তুমি শুনতে পাবে কিনা, বুঝে নিতে হয় তাও।
ঘুম কিংবা মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, কোনওটাই যে আর সহজ থাকবে না তোমার জীবনে, তা কি তুমি ভেবেছিলে কোনওদিন? ঐকিক নিয়মের সব সূত্র ভেঙে দিয়ে এতরকমের এতগুলো রাতের ভেতর থেকে রোজ একেকটা রাত বেছে নেওয়ার সুযোগও যে তোমার থাকবে, তাও কি কখনও ভেবেছিলে তুমি?
অথচ মানুষ চিনতে হলে তার দিন দিয়ে নয়, তার রাত দিয়ে চিনতে হয় তাকে, একথা তো সেই কবে থেকেই জানা আছে তোমার! শুধু নিজের বেলায় এত একবগ্গা
যশোধরা রায়চৌধুরী
কীটদষ্ট রামায়ণ
কীটদষ্ট রামায়ণে ছবি তৈরি হয়
প্রতিটি অক্ষর ফাঁকে তৈরি হয় প্রতীক, গূঢ়তা
কীটের চলার পথে প্লেটে ছাপা তিনরঙা ছবিতে
রাম আর সীতার মধ্যখানে তৃতীয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে ওঠে।
এই তবে নতুন বচন?
এই তবে প্রান্ত থেকে বক্তব্যের গুটি গুটি মূল কান্ডে ফেরা?
বিপ্লবের উঁকিঝুঁকি রুপোলি মাছের মত পোকার ভেতরে
দেখি আমি। কীটদষ্ট রামায়ণে পুরনো পুজোর ফুল শুকিয়ে রয়েছে
সেই সেই স্থানে দেখি খোবলানো গর্ত হয়ে আছে
চাঁদের ক্রেটার যেন… ভেতরেই কীটজন্ম বপন করেছে শুচি ফুল…
বিপ্লব এভাবে তবে? নব নব উদ্ভাসে সবল?
পূর্বা মুখোপাধ্যায়
খর্পরকথিত
বলির পাঁঠার সঙ্গে পুরোহিতের যে সম্পর্ক হয়, তাও যে একটি অত্যাশ্চর্য সম্পর্ক, ইহজীবনে এ ব্যাপারে আমার চেতনা হত? মহামায়া চেতনাকে থাবড়েথুবড়ে ঘুম পাড়ান। দৈবাৎ সাধ হয়, কোল থেকে একটু গড়িয়ে দেন, আমরা ঝাঁকি চিনি। ঝাঁকি মানে হৃৎকম্প। কালি করালবদনা মুক্তকেশী ঘোরা লোলজিহ্বা বিদ্যুৎদংষ্ট্রা সাক্ষাৎ মরণদশা ঘনিয়ে তুললে তবেই বুঝতে পারি বলির পাঁঠার সঙ্গে পুরোহিতের নিঃসাড়ে একটি সম্পর্ক হয়। পাঁঠার নিবিড় আত্মরতি কচি তেল চুপচুপে কাঁঠালপাতাতে যে মন নিয়ে মগ্ন ,তা ক্ষুধাশান্তির। পুরোহিতের প্রতি তার আকর্ষণও নেই বিকর্ষণও নেই। সে মগ্ন তাই নিশ্চিন্ত। পুরোহিত ছাগশিশুর প্রতি আকৃষ্ট, আসক্ত এবং গভীর বিশ্বাসে নির্ভরশীল যে প্রাণীটি অচিরে তাঁর মোক্ষপথ ধুয়ে দেবে। তার ছিটকে যাওয়া রক্ত তাঁর আগামীর জয়তিলক।
বলির পাঁঠার মাংস নিরামিষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়।
নীলাঞ্জন হাজরা
দ্বিপদী
১।
থামিয়ে রেখেছি আর্তনাদ, থেমে-থাকা বৃষ্টিবিন্দু
চোখ দুটো হাড় হয়ে গেছে।।
২।
নক্ষত্রময় কত নাম, কেউ আর ডাকবে না
রাত ডুবে গেছে ঠোঁটের কিনারে।।
৩।
কোলাহল খুঁড়ে দুই গজ, দফন করেছি অক্ষর
কথাদের আর ভাষা নেই, কথা নেই আর ভাষাদের।।
৪।
গড়িয়ে আসা রক্তের তরজমা
সিরাজুল ধানখেতে শুয়ে রাতভর পড়ে চলে সারাটা আকাশ।।
৫।
পাঁজরময় শুধু দাঁড়ের শব্দগোলা জল
সমস্ত ভবিষ্যতে ওত পেতে রয়েছে অতীত।।
অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
অক্টোবর : একটি মুখবন্ধ
বদলে যাওয়ার কথা বলাবলি করি—
এত কি সহজ?
না কি কথার ভিতর ঘুরে ঘুরে
ক্লান্তির কাছে পরাভব, থেমে যাওয়া উপায়ন্তরহীন!
জিভ যেন ঘাতক ছুরিটি, এত ধার!
এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে, উপড়িয়ে নিতে পারে—
সেই ভয়ে বিপর্যয়ের মুখে রোগাভোগা গাছের বাদামী আরো ব্যথাময়।
স্থিতি ও প্রলয় খুব জায়গা বদল করে,
অগোচরে বেড়ে যায় জল।
সেতুর ভঙ্গুরতা, অস্থায়ী তাঁবুর জীবন, বালিঘর এইসব নিয়ে কথা হয়। আলোচনা শেষে কিছু বোধের কপাট এলোমেলো।
উড়নচণ্ডী তার স্বভাবমহিমা কাচের এপারে আঁকে আফশোস —
আর একবার যদি শুরু থেকে লেখা শুরু হয়,
এইসব বাচালতা, ক্ষমার অযোগ্য ভ্রম
সংশোধন করে নেওয়া যায়?
অথবা হয় না কিছু সেরকম।
চোখের তাকিয়ে থাকা স্তব্ধতা ছুঁয়ে থাকে—
দেখা থেকে দৃষ্টি হারায়।
শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী
দুটি কবিতা
স্তোক
দূরের রাতবসন্তে তোমার বারান্দায় এসে বসেছে
কোনো এক যুবতীর পরমায়ু পায়রাপ্রতিম।
ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঝরে পড়ছে তার ইচ্ছেপালকগুলি
আর বিছিয়ে যাচ্ছে আলোঝলমল ড্রয়িংরুম জুড়ে।
উড়ে বেড়াচ্ছে, উড়ে বেড়াচ্ছে আর
আগলবিহীন ব্যথা ফুটে ফুটে উঠছে তার ডানায়,
ফুল ফুল ফুলে উঠছে রতিকথা, প্রণয়সম্ভার।
তাকে বলো, ফিরে যাওয়া ততটাও অসম্ভব নয়।
তাকে বলো থেকে-যাওয়া, ছুঁয়ে-থাকা, তার চেয়ে অনেক কঠিন।
সব ঝুঠ হ্যায়
তাকে গিয়ে বলে এসো রাত্রির তারুণ্যের কথা।
তাকে গিয়ে বলে এসো শেয়ার বাজারে কত লাভ হল আজ,
অথবা দুপুর–ভাতে সোনালী মাংসের ঝোল কতখানি তৃপ্তি করে খেলে।
আগামী সফরে স্পেন, অথবা পেরুর দিকে গেলে
কোন পথে লং ড্রাইভ হবে —
কিংবা উইকেন্ডে সেই ছোটখাটো গ্রামে গিয়ে ভুট্টাক্ষেতের ধারে
রেড–ওয়াইন বিধৌত কতখানি ঘন চুমু ছিল?
তাকে গিয়ে বলে এসো এ‘সব দাঙ্গা–খেলা, শিশুমৃত্যু
সাময়িক, তুচ্ছ ঘটনা —
কদিন বাদেই সব বিনোদনে মায়া হয়ে যাবে।
পোড়া ঘর, ভাঙা আলো, মৃত্যুভয় সমস্ত বেবাক “ঝুঠ হ্যায়“!
একখানা পুড়ে যাওয়া পায়ের খন্ড নিয়ে
অপেক্ষায় আছে যে মেয়েটি, পিতার অবশিষ্ট শরীরের।
চন্দন ঘোষ
জিৎ
একবার ভগবান শয়তানের সঙ্গে পাশা খেলতে বসেছিলেন,
মানুষকে বাঁচাবেন বলে…
শয়তান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছিল।
আর ভগবান হেরে যাচ্ছিলেন।
ওঁকে সরিয়ে দিয়ে আমি বসে পড়লুম,
আস্তিন গুটিয়ে…
শয়তান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
আমিও হেরে যাচ্ছিলাম।
আর শয়তান হাসছিল।
একসময় দেখি শয়তান ভয় পাচ্ছে।
খুব ভয়, মুখ ফ্যাকাশে…
আমিও আর হারছি না।
চমকে উঠে আয়নায় তাকিয়ে দেখি
আমি ক্রমশ ক্রুর এক শয়তান হয়ে যাচ্ছি
ধারালো শ্বদন্তের পাশে ঝুলছে
পাতলা এক-টুকরো কুয়াশা।
তৃষ্ণা বসাক
উপাখ্যান
এই উপাখ্যানে বলা আছে প্রথম থেকে শেষ,
ঝর্ণার ধারে দুপুরবেলায় একটা বক বলতে শুরু করেছিল
কোন একদিন; একবার মাত্র সে থেমেছিল-
পুরনো আগুন থেকে নতুন আগুন জ্বালিয়ে নেওয়ার জন্যে,
লম্বা লম্বা গাছের শাখায় উজিয়ে এসেছিল মেঘ,
কতদিন, কতদিন একটা ভালো গল্প শুনি না, মেঘ ভাবছিল,
কটমট করে তার দিকে চেয়ে বৃদ্ধ বক বলেছিল
এটা গল্প নয়, এটা উপাখ্যান।
নিঃক্ষত্রিয় দুপুর, ঝর্ণার জলে নুড়ি ফেলার মত
একটা পুরুষও ছিল না পাড়ায়,
মেয়েরা বেরিয়ে পড়ল জল আনতে-
আমি, অচিন পাখির মত, তিনকূলে কেউ নেই,
থেকে গেলাম।
উপাখ্যানের প্রথম অক্ষর শুরু হয়েছিল
আমাকে দিয়ে।
কিন্তু এই নির্মাণ কী জন্য? একটুপরেই তো
রঙ্গিন কাপড়গুলো খুলে নেওয়া হবে,
ভ্যান ভর্তি হয়ে বাঁশ চলে যাবে
পরবর্তী আশ্বিনে,
তাহলে, তাহলে বোধহয় এতসবের কোন দরকার ছিল না,
তিনটে কোটেশন জমা দেবার, এক ক্রেট মাল, মিস্টি, বড়সাহেবের মেয়েকে
ইস্কুলে ভর্তি করার জন্যে এত ছোটাছুটি
সময় ভীষণ কাঁপছে, হঠাৎ করে রাস্তাটা
এত সরু হয়ে গেল, আগে থেকে আমাদের জানানো হয়নি,
কে যেন বলেছিল, দেখিস,
গলিটা গিয়ে সমুদ্রে খুলে যাবে-
জল নোনতা লাগলেই তাই আমরা
সমুদ্র সমুদ্র করে লাফাচ্ছিলাম,
চোখ বুজে কুড়োচ্ছিলাম মিছিমিছি ঝিনুক!
কিন্তু কী জন্যে এই নির্মাণ?
আগে থেকে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি?
দাঁড়ি টেনে খুব স্পষ্টভাবেই দুটো লম্বা কালির আঁচড়,
যার মানে শেষ, শেষ, শেষ।
আমিই শুধু জানতাম।
সেদিন দুপুরে উপাখ্যান শেষ করে
ঘুমিয়ে পড়েছিল বক, অনেক বয়স তার,
দেখছিলাম টুপটুপ করে তেলের মত মেঘ
সরল গাছের গা বেয়ে নেমে আসছে।
চেঁচিয়ে বলি ‘সাবধান, হাত উঠিয়ে নাও,
উঠিয়ে নাও বাক্য, মন, সমর্পণ, স্মৃতি!’
মূর্খ মানুষ বিশ্বাস করে না আমার কথায়,
পুরুষরা ম্যারাপ বাঁধে,
হাজার ফুটের জল খাওয়াবে বলে,
মেয়েরা, জ্যোৎস্নায়
কুসুম কুসুম বালির ওপর হেঁটে যায়।
মনোনীতা চক্রবর্তী
ইন্দ্রাবতীর ডায়েরি থেকে
আলো আর কোণ, এই দুটোই ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট! সামান্য হেরফেরেই স্বরূপ ও মহিমা বুঝিয়ে দেয়। তাই, সমঝে চোলো।নইলে কত সহজে তুমি বা আমি অথবা আমরা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বো তা বোঝার আগেই সব শেষ! গলি-মহল্লায় সেজে দাঁড়ানো মেয়েগুলো জানে যে সামান্য একটু আলো নড়ে গেলে ছায়ারা প্রেতাত্মা হয়ে শরীর জুড়ে হেঁটে যায়। গান গায় না। গানকে হাসতে-হাসতে ওই পরিত্যক্ত দালানে নিয়ে গিয়ে বলে ঘুঙুর হতে; আর না-পারলেই টুটি চেপে ধরে! আপনারাই বলুন যে গান কী-করে ঘুঙুর হবে! আদৌ সম্ভব? কিন্তু কোণ বদলে গেলে ঘুঙুর গান হতে পারে।
আলো আর কোণ, দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ।
মেজেন্টা রঙের ভিতর খিদে গুঁজে যে-মা একটার পর একটা রাত নিজের মাংস নিজে ঝলসেছে; সেই মা জানে আলো নড়েচড়ে গেলে কত মুদ্রা ঝুরো বালির মতো ভেঙে পড়ে; নাচ হেঁটে যায় গানের খোঁজে, এক কোণ থেকে অন্য কোনে…
এ সমস্ত ঝাঁঝ ও ঝাঁকুনি একটা পৃথিবীর সারমর্ম।
প্রকাণ্ড এক ঝাঁপ; কেউ-কেউ অবশ্য এর থেকে মুক্তি পায়….
প্রেম বেচতে শুনেছেন? দেখেছেন কখনও?
হয়তো দেখেছেন অথবা দেখেননি;
যাঁরা দেখেছেন, তারা এটুকুর বাইরেও আরও অনেক বেশি কিছু জানে;
একসময় চোখে এতটাই খরা নামে যে তাঁর ওই রুমালের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। রুমালটা আবর্জনা থেকে উঁকি মেরে শুধু হেম সেলাইয়ে লেখা ওই নামটা সুযোগ পেলেই দেখায়; ওটা আমি অনেক কষ্টে লিখেছিলাম তোমার নাম…
স্বপ্ন আলগা হলে সুতো খুলে আসে
একের পর এক; সব কেমন আবছা হতে থাকে; তুমি থেকে সারা পৃথিবী! নাকি আমার লেজি আই ভুল পাওয়ারে চোখ মুড়ে দেয়… কে-জানে!
পায়েল সেনগুপ্ত
সে এক গল্প ছিল
খুলেছি মুখোশ সব মাঝরাতে তবু যন্ত্রণা
শরীরের কোষে কোষে রেখে যায় অনন্ত ছাপ
কুহুতানে তীব্রতা মায়া হীন ভালবাসা বোধ
এখনও কাঁপিয়ে তোলে দিনগত কঠিন শিকল
সে এক গল্প ছিল সূর্যের ডাকহরকরা
দিনান্তে ফেলে যেত ম্রিয়মাণ বার্তার লিপি
আমারও বিহঙ্গ জীবন ছিল উল্লাসে ওড়া
ডানা নয় হাত ছিল, তবুও তো কেটে যেত মেঘ
এখন মেঘের দল মৃত্যুখবর বয়ে আনে
বলে যায় বিশ্বের সভ্যতা ইতি হয়ে এল
যুদ্ধ বর্ম পরো শেষবার দেখে নাও প্রেম
মধুর বাক্যব্যয়ে আর কোনও ফল নেই জেনো
মেঘদূত ইতিহাস পড়েনি কখনও মনে হয়
ভালবাসা ছাড়া বেঁচেছিল নাকি কেউ কোনও যুগে?
লড়াই সামনে এলে তোমার চোখের ছায়াপথ
যদি দেখি, কোনখানে লুকোতে পারব নিজেকে
বেঁচে থাকা আসলে যে মৃত্যুর পরিহাস শুধু
জেনে গেছি তাই কোনও অভিমান ফেরাতে পারি না
বিষাদের পাশে বসে ভালবাসা সোমরস খেলে
সামগানে মুদি চোখ চিতাকাঠ পরোয়া না করে
সে এক গল্প লেখে সূর্যের ডাকহরকরা
প্রেমহীন বার্তা সে দিনান্তে বয়ে নিয়ে আসে
শরীরে শরীর নেই, তবুও ইথারে কিছু ভাসে
মেঘদূত এখনও সে সংকেত গোপনীয় রাখে
সেলিম মণ্ডল
আয়না
১
হতাশায় আয়না ভেঙে যায়
যে মুখ দেখে, সে আয়না কেনে না
আয়নার ভাঙা টুকরো জমিয়ে রাখে
কখনো কখনো হাত কাটে, গলগল করে রক্ত বেরোয়
হতাশায় আলো পড়লে— লাল আভা মুখে লাগে
২
আয়না থেকে ঝরে পড়ছে মেদ
মাংস এত রুগ্ন— রোদের ছটা পড়লে
হাড় বেরিয়ে আসে
হাড়ে ফুটে থাকে চিরুনির দাঁত
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
আত্মপ্রতিকৃতি
এ বসবাস সাংকেতিক
এ প্রতিবেশ অন্ধ বেহালাবাদকের
এ শহরে প্রতিটা আত্মপ্রতিকৃতি আয়না হয়ে ওঠে
যার ভিতরে আমি আরও আয়না ধরে আছি
অবান্তর সমুদ্র আসে, নৌকার তলায়
পিষে যায় আরও সহস্র আয়নার চূর্ণ
প্রতিটা বিম্বই ডোবে
ফ্যাকাশে মাছের শরীরে ঠিকরে ওঠে
জ্যোৎস্না, গ্রীষ্ম ও বাড়ি ফিরতে চাওয়া
মণিশংকর বিশ্বাস
রাহু
‘সত্যি জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি আমি’—
যদি এই লাইন না-ও লিখে থাকেন
তবু এই লাইন ভাস্কর চক্রবর্তীর
আমারও
সেই কবে থেকে একটার পর একটা ঢেউ
প্রেমহীনতা, বিষাদ, সম্পর্কহীনতা,
এমনকি ‘আয়নায় নিজেকে নির্লোভ দেখবার লোভ খুব’—
এরকম একটার পর একটা ঢেউ বা ভুতের হাতে থাপ্পড়
এসে আছড়ে পড়েছে এই, ঠিক এইখানে।
(এটা বলে আমি জামা খুলে কিছু একটা দেখাই)
আর আমি
ঠিক একটা বিন্দুর মতো—
বিন্দুর যা স্বভাব, ডাইনে বায়ে সামনে পিছনে উপরে নিচে
অথবা অন্য কিছুর সাপেক্ষে তেরছা
যে কোনো দিকেই সে চলে যেতে পারে
কিন্তু কোত্থাও যাবে না—
যেন গতরাতে জীবনে প্রথমবারের মতো
বাবা-মায়ের যৌনমিলন ও যথেচ্ছ শীৎকার-শোনা
হতচকিত কিশোর এক—
অনর্থক পাপবোধে ভারী—
রক্তমুখী নীলা
পড়ে থাকবে দুর্ঘটনায় কর্তিত আঙুল থেকে দূরে
অনুপ সেনগুপ্ত
বহন
শিশিরের মতো আমিও ঝরেছি সারারাত
কখনও পিঁপড়ে হয়ে হেঁটেছি
দেওয়ালের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত
আকাশের সুরঙ্গ খুঁড়ে রেখে এসেছি
নক্ষত্রের অশ্রু
কখনও তোমার আকাঙ্ক্ষায় ফুটেছি
গোলাপ হয়ে
তোমার গানের পশ্চিম সীমায়
অনন্ত সূর্যাস্ত হতে চেয়েছি
চেয়েছি পারদ-বিন্দুর মতো
সব নিজেকে একটি নিজতে
মিলিয়ে দিতে
আমার জ্বরাক্রান্ত নীরবতায়
তোমার সোচ্চার হাতের মৃদু স্পর্শভার:
বহন করে চলেছি
প্রসূন মজুমদার
ইঁদুর ও ইঁদারার দিন
তারা যে গতিতে খসে দুর্ঘটনা সেভাবে ঘটে না।
অঘটনে ঘটনা কোথায়?
অগতি ও না-গতির যতটা ফারাক তারও বেশি ঘটনারা ঘুরে যায় দ্রুত।
পুণ্যমন্ত্রপূত চাল পোড়ে কারো নাকের অদূরে,
তাকে জুড়ে ইঁদুরের মুখে ধরি ইঁদারার না-এ।
গাঁয়ে , এলো পায়ে ধূলে পা রাখা নরম নারী পায়ে তার নূপুর পরেনি।
শব্দ নেই, লব্জ এই, তারই নিঃশব্দ নূপুরে ভারী ইঁদুরের হত্যাদৃশ্য লিখে যেতে পারি।
পঙ্কজ চক্রবর্তী
এই প্রান্তদেশ
নির্বাচিত কবিতায় তোমাকে পেয়েছি। মাছরাঙা পুকুরের পাশে জবাগাছে। এদিকে খেয়াল নেই উঠোনে বসে আছে অবাক হারমোনিয়াম। বেণী দুলিয়ে পাশের বাড়ির মেয়েটি বলে গেল বাবার আজ হাসপাতাল থেকে ছুটি। এতসব কথার ভেতর তোমার জন্ম হল সাতই আশ্বিন। নদীর ভিতর থেকে উঠে এলো অষ্টধাতুর বিগ্রহ। হাইস্কুলের মাঠে তিনরাত্রি ব্যাপী যাত্রাপালা, শেষদিনে রফিকণ্ঠীর বিচিত্রানুষ্ঠান। জীবন নামক অতিশয় শোক একদিন শেষ হয়ে আসে। আলপথে শুয়ে থাকে পুরোনো সাপের খোলস। দুই বাড়ির মাঝখানে অসুখ অসুখ দূরত্ব।
নির্বাচিত কবিতার থেকে উঠে এল পথ, ভাঙা দেউলের ধূসর দরজা। আলপথে নেমে যেতে যেতে প্রতিটি শব্দ বলে গেল—ছোটো ফুল, সূর্যাস্তে তারই প্রতাপ…
পার্থজিৎ চন্দ
বাষট্টি শ্রমণপথ
তারপর অক্টোপাস তার হাঁ-মুখ দেখালো
ভেতরে জ্বলছে লোহার প্রদীপ, যোনি আকৃতির তারাদল
নৌকা আসছে-যাচ্ছে তুলে নিচ্ছে যাত্রীদের, শ্রমণপথের বন্ধু, শোনো
বহুদূর থেকে দাহ্য বয়ে আনা
উরুবেলা আমাদের তীর্থ, তীর্থের ডুমুরগাছে পাখি বসছে
পথের শত্রুতা আজ ডুমুরের ফুল, ফুটে আছে
নৌকা আলো করে। ফুটে আছে তোমাদের কাটা উরু…
নদীজলে অক্টোপাস-শুঁড় লকলক করছে
হাঁ দেখে বুঝেছি সে’ও আমার বন্ধু হবে, শ্রমণপথের বন্ধু
জলের ওপর এ আগুন আয়োজন…গাথা হোক
গাথা বেয়ে নদীর ওপারে গিয়ে শান্ত উড়ে যাক তোমাদের অস্থিভষ্ম
অক্টোপাস-পেটে দীর্ঘ মাধুকরী এক; শ্রমণপথের বন্ধু
বাষট্টি শ্রমণপথ, তোমাদের হাড়-মাংস দাও যাত্রাপথ দাও কাটা-উরু দাও
খাই
রাণা রায়চৌধুরী
বিষ
কেবলই মনে হচ্ছে, গায়ের ওপর একটা সাপ উঠে আসছে। বিষধরই হবে। ফণা সমেত, রাজপথ সমেত। কোমরে মাদুলি। উঠে আসছে, উঠে এল।
আমার ভিতরে রেডিও বাজছিল। বিনাকা গীতমালা, দুই ব্যাটারি, সেটি থেমে গেল, সেটির ভল্যুম গেল বেড়ে।
সাপ, সাপিনী তাহার ওষ্ঠ আমার ঠোঁট ছুঁয়ে আছে, আমার ফার্নিচার ছুঁয়ে আছে, আমার দোকান-পাট রাস্তা পথ গলি আমার গ্রহ-নক্ষত্র আমার পুকুর ছুঁয়ে আছে। এ চ্যানেল থেকে ও চ্যানেলে ঘুরছে, ফণা পেঁচিয়ে ধরেছে আমায়।
এইভাবে অনেক দূর এসেছি আমরা, পথিককে জিজ্ঞেস করি, বটতলা কতদূর?
ফণার সাইড ব্যাগে আছে পুরাতন রেডিওটি, দুই ব্যাটারি। সঙ্গে পুরোনো টিফিন কৌটোয় আরো পুরনো দিনের বিষ, বিষও দুই ব্যাটারির, তবে তার ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর, পথ-ঘাট রাস্তা গলি
দোকান-পাটের ভল্যুমে তেমন জোর নাই আর…
সুবীর সরকার
ব্যাল্যাড
উপত্যকা থেকে ব্যাল্যাড ভেসে আসে
আমরা উঁচু একটা রাজপাটে উঠে আসি
দেখি রাজা নীলাম্বরের ঘোড়া ছুটছে
ঘন্টা বাজছে কামতেশ্বরি মন্দিরে
কত তরুণ আমাকে ভালোবাসেন
কত তরুণ আমার দিকে বিদ্রুপ ছুড়ে দেন
আর আমি মৃত্যু নিয়ে নিজস্ব এক সেমিনার সেরে
নেই
এখন কোন মৃত্যু ভয় নেই।
এখন কোনো ফোবিয়া তাড়া করে না
আমাকে
খুব ভালো আছি।
হাসপাতালের করিডোর দিয়ে দৌড়তে থাকি
আর পকেটে কীটনাশক নিয়ে ঘুরে বেড়াই
অপেক্ষা করি কবে কোন তরুণ কবি
আমার বুকে বসিয়ে দেবে বিষ মাখা ধারালো
ছুরি।
স্নেহাশিস পাল
পুরনো পোস্টকার্ডের লেখা
ফুল
চলো ভোর তুলি, — কানা ক্যামেরায়
নাকি চোখ-আঁকা চক্ষুহীন তৃষিত সাজিতে?
শুধু বুঝি, পদক্ষেপে ভ’রে থাকবে নদী-গলা আলো, মৌমাছি-সাম্পান …
ওই পাড়ে স্মৃতিদের পাড়া।
মরে যাওয়া স্বপ্নের কিনারে মৌলীদের গ্রাম…
ছড়া
দুই হাত ভ’রে
সহস্র নীড়ের আলো মাখি — বাতিঘরহীনভাঙাদেহে …
দূরে, নাবিকের মায়া… …
তার বাড়ি তুলে রাখি…
যতখানি সাগরের চিহ্নহীন পথে;
সে আবার ফিরে আসে…
ততখানি চাঁদ দিই… ভাঁটার কপালে
আমার প্রেমের মৃতদেহ, ঘোর-লাগা ছড়া বলে —
জোনাকি-উপুড় জাহাজের !
শৌভ চট্টোপাধ্যায়
অন্ধকারের জিভ
কে যেন বলেছিল, “History keeps repeating—it’s one long stutter.” আর আমি, তড়িঘড়ি, কথাটা নিজের ডায়রিতে টুকে রেখেছিলাম। হয়তো কোনো সিনেমায় শোনা, কিংবা কোনো বইতে পড়েছি। এখন আর মনে নেই।
গবেষকরা লক্ষ করেছেন, স্কিৎজোফ্রেনিকদের আঁকা ছবিতে, শূন্যস্থান প্রায় থাকে না বললেই চলে। সামান্যতম শাদা জায়গাটুকুও যাতে ভরে ওঠে আকারে, রেখায় ও অহেতুক আঁকিবুকিতে, তারই আপ্রাণ চেষ্টা স্কিৎজোফ্রেনিকদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আসলে, যেকোনো অনির্দিষ্ট শূন্যতাকেই ভয় পায় তারা—‘Horror Vacui’!
স্মৃতির অবিশ্বাস্য জটিল গোলকধাঁধায় ঘুরতে-ঘুরতে, এইসব মনে পড়ছে এখন। এই অবিরাম নির্মাণ, ক্রমশ উপচে-ওঠা পণ্যের স্তূপ, আর অবিরাম বর্জ্য-উৎপাদন—এ কি তবে আরো বড়, আরো জটিল কোনো বিকারের লক্ষণ? এ কি তবে আমাদের সমবেত স্কিৎজোফ্রেনিয়া?
অনিবার্য ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সময়ের উল্টোদিকে হেঁটে যাওয়া, আর কোষে-কোষে জমে-থাকা অসংখ্য স্মৃতির গায়ে আঙুল বুলিয়ে বেঁচে-থাকার এই অন্তহীন প্রয়াস—একে কি সত্যিই পরিত্রাণ বলা যায়? শুনেছি, ‘নস্ট্যালজিয়া’ শব্দটা এসেছে গ্রীক ‘নোস্টোস’ থেকে, যার অর্থ ঘরে ফেরা। আর, ‘অ্যালগোস’ মানে যন্ত্রণা। সপ্তদশ শতকে, নস্ট্যালজিয়া ছিল এক মানসিক রোগ। পরে, রোম্যান্টিকদের হাত ধরে, আমরা তাকে ভালবাসতে শিখেছি। কিন্তু, ঘরও তো এক শূন্যতা বই আর কিছু নয়। একটি চতুষ্কোণ শূন্যতার চারিদিকে ওই দেয়ালের ঘেরাটোপ—সে কি আমাদের রক্ষা করবে, না কি তিলে-তিলে দমবন্ধ করে মেরে ফেলবে একদিন? ঘরে ফেরা মানে, তাহলে কি, শুধু এক শূন্যতার কাছে ফিরে আসা, বারবার? ঘরে ফেরা মানে, তাহলে কি, শুধু এক অর্থহীন পুনরাবৃত্তির ভুল?
মাথার ভেতর এই ফুটিফাটা অন্ধকার, আর ছোট-ছোট গর্তের মধ্যে জমে-থাকা কালো, ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস, ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
তৃণা চক্রবর্তী
ব্যালকনির পরিসরে
তোমার বিষণ্ণ মানুষ ভালো লাগত না
তেমন কাউকে দেখলে তুমি জোরে গান চালিয়ে দিতে
শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদের মতো বসে থাকতে থাকতে
আমি একদিন আবিষ্কার করেছিলাম
জীবনটা ঠিক সিনেমার মতো হতে গিয়ে
পাহাড়ের নিচে এসে থেমে গিয়েছে
পাহাড়ের নিচেই কেন, নদীর পাশে এসেও থামতে পারত
এর সঠিক উত্তর নিয়ে ভাবতে ভাবতে
বিকেলের রোদ সরাসরি এসে পড়ল আয়নায়
এক আয়না থেকে বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়ল অন্য আয়নায়
সমস্ত হাসি ভেঙ্গে ছড়িয়ে গেল অনন্য বিকেলে
গানের রেকর্ড থেকে শোনা গেল অবিশ্রান্ত বৃষ্টি
বিষণ্ণ মানুষ তোমার একেবারে ভাল লাগত না
ছুটির দিনের বিকেল অহেতুক কেটে যেত ব্যালকনির পরিসরে
শতানীক রায়
সূর্যের সাত ঘোড়া ও নানা কাহিনি
একবারও বুঝতে পারোনি কীভাবে যে জল হয়েছে। সবই। “…এভাবে জল সবকিছুই গ্রহণ করে।” সবার অজান্তেই মাঝি সারাজীবন নৌকা চালায় বৈঠা ধরে। তোমার জীবন সূর্যদেবতার মতো— সকালে বালক, দুপুরে ক্রুদ্ধ যুবক আর সায়াহ্নে সোনালি চুলের বৃদ্ধ। এত নরম যে, ফোয়ারার জলও স্পর্শ করতে পারে না তোমাকে। আপেল গাছ ও নৌকার নিয়তি শেষে মাঝি হয়ে কেউ আজীবন বৈঠা ধরে। তুমি এক-একদিন প্রতিটি কাহিনির উপকাহিনির ভেতর থেকে শুরু হয়ে সূর্যের তিনটি সোনালি চুল হয়ে ফিরে আসো।
রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
একটি কবিতা
জলপথ এখন আর ততটা তরল নয়,
বাঁধ পড়েছে স্রোতের মুখে।
মাঝে মাঝে যখন লকগেট খোলা হয়
জলের তোড়ে অনুভূতিরা ছত্রাখান হয়।
তবুও ভেসে যাওয়া ছাড়া নেই উপায়ান্তর-
জমা রাখা আছে মন ও শরীর,
দোহাই প্রেমের আতান্তর!
ফিরবি না কি মন?
করবি না কি একবার গতিমুখের বদল?
সময় গেছে অনেক,
রাগ করবে না ভৌগোলিক মহল।
খাতরেখা অবশ্য মুছে যাবে না কোনোদিনই,
আগাছার জঙ্গলে শ্যাওলাদের পা ছোঁয়াছুঁয়ি;
চাঁদের টানে কখনো কখনো অনুভূতিরা কাঁপবে;
নয়তো সবই নতুন রকম, নতুন পথে হাঁটবে।
রাহুল দাশগুপ্ত
তিনটি কবিতা
লেখা ও আমি
যখন আমি লিখি, ঠিক সেই সময়টুকু
বসে থাকি সত্যের চেয়ারে,
কেউ তখন আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না
সমস্ত ঘটনার দিকে
সমস্ত চরিত্রের দিকে
সমস্ত অনুভবের দিকে
আমি তাকাতে পারি মোহমুক্ত হয়ে
আমি একটা নতুন মানুষ হয়ে উঠি
যেন জন্মান্তর হয় আমার
কিছুতেই মিথ্যে বেরোয় না তখন হাত দিয়ে
যেসব ঘটনাকে কোনওদিন বুঝতে পারিনি
যেসব ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছি
যেসব ঘটনার রহস্যের অতলে তলিয়ে গেছি
লিখতে বসে হঠাৎ তার মর্মার্থ টের পাই
যেসব চরিত্রকে দেবতা মনে হত
হঠাৎ তাদের চাতুর্য টের পাই
যেসব চরিত্রের জন্য ছিল ক্ষোভ বা অভিমান,
ঘৃণা বা অনুকম্পা
তাদের মহত্ত্বে অকস্মাৎ চমকে উঠি
লেখা আমাকে সত্যের কাছে নিয়ে যায়
লেখার কাছে যেতে গিয়ে
আমি ভয়ার্ত, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকি…
জীবন
একজন সুস্থ মানুষের পিছনে
পাগলা কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার নামই
জীবন…
এই জীবন আমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিয়েছি
একটা জানলা–দরজাবিহীন খাঁচার ভিতরে
পরস্পরকে ঠেলে, সন্ত্রস্ত বা প্রতারিত করে
আমরা শ্বাস নিচ্ছি,
একের শ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে বহু শ্বাসের ভিতর
তবু কোনও ঝড় তৈরি হয় না
তবু কোনও ঝড় আছড়ে পড়ে না
খাঁচার নিশ্চিদ্র গর্জমান দেওয়ালে,
ওই খাঁচার ওপাশেই
গর্জন করে চলেছে একটা পাগলা কুকুর
ওই কুকুরটিই আমাদের দাঁড়াবার জায়গা
ওই কুকুরটি আছে বলেই
আমরা একের পর এক পরীক্ষা দিয়েছি
একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়েছি
একে ধরেছি, তাকে মেরেছি
শ্লোগান দিয়েছি আর পতাকা নিয়েছি কাঁধে
রক্তপাত দেখেও চমকাইনি, বরং
তৈলাক্ত করে তুলেছি আমাদের যাতায়াতের পথ…
আর ও শুধু আমাদের সুস্থ জীবনকে
তাড়িয়ে নিয়ে গেছে খাঁচার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে…
কী লাভ সুস্থতায়?
তার চেয়ে আগুন বা মাটির কাছে
আত্মসমর্পণ করাও ভালো,
মৃত বা অসুস্থ মানুষের কাছে কেউ প্রত্যাশা করে না
জীবনের,
কেউ তার পিছনে শোনে না
তেড়ে আসা পাগলা কুকুরের চাপা গর্জন…
প্রার্থনা
প্রতিবার বীর্যপাত
একটি নতুন
পরাজয়
কতবার যৌনতার
হাতে তুলে দেব
ঘরবাড়ি?
একটি দারুণ প্রেম
দিতে পারো
হে জলপ্রপাত?
দেহবাদে লাথি মেরে
হাতে নেব
মোজেসের লাঠি
যৌনতার ঘাড় ধরে
বাড়ি থেকে
বের করে দেব…
শরীরে আগুন জ্বলে
চোখের পলক পুড়ে
ছাই
একটা দারুণ প্রেম
দিতে পারো?
মায়ের মতন
যে আমাকে ভালোবেসে
যে আমাকে
পালটে দিয়ে যাবে…
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
জ্যোৎস্নাতীত
পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মেয়ের মুখের মতো সন্ধ্যা হয় রোজ
আকাশে শাঁখার টুকরো চাঁদ
শিক্ষক দিবসে রাত কতটা গুমোট হয়ে ওঠে?
অংকে লেটার পাওয়া রিতা, টুসি, মনিকার
ইলেভেন বন্ধ হওয়া চোখ
যতটা নিষ্প্রভ লাগে, তারও বেশি বলে মনে হয়?
অথচ ভাদ্রের দিনে বিড়াল, কুকুরও নয়
অথচ অতিথি এলে না খাইয়ে ফেরানো নয়
এইসব মেয়েদের জন্য কিছু
লেখা নেই? চল নেই?
অন্তত দু’একটা উদার নিয়ম?
চব্বিশঘণ্টার রাত শিক্ষক দিবসে
চব্বিশঘণ্টার রাত প্রতিটি বছর
তবে আজ জ্যোৎস্না কেন এতো?
কই! আজ পূর্ণিমা তো নয়
তবে কি দুঃখের দেহে জ্বর?
কোথাও প্রত্যন্ত গ্রামে গার্হস্থ সব দায় সেরে
শবর বাচ্চাদের পড়িয়ে, নিজেরা পড়ে
অবিচারের কষ্টি-কালো মুখে
আলোর থাপ্পড় মেরে ফিরে যাচ্ছে
রুপালি ও নমিতা শবর
পলাশ দে
পোশাক
ছিটকে ফেলে দেওয়ার আগে বলো দোষ কোথায়
কী কীভাবে ভাঙচুর হল ঈশ্বরীয় মুহূর্ত
এক জীবন চুপ থেকে আজীবন সহ্য করতে করতে
এই সেই ঝিঁ ঝিঁ ডাক …
পাত্তা না পাওয়া নদীর আচমকা জোয়ার জোয়ার
সাপের ফণা আর তোমার তৃতীয় চক্ষু খুলে যাওয়ার বিস্ময়ে
তুমি কেন তুমি কেন কেন তুমি তারাভর্তি পোশাক
আলতো খুলে রাখলে আমার সামনে
কী দোষ বলো ,
আমি, নক্ষত্র হাতড়াতে হাতড়াতে তোমাকে পেরিয়ে যাই
সুদেষ্ণা ঘোষ
আমাদের উৎসব
হলুদ হয়ে যাওয়া গল্প থেকে সেই বেলুনওলা শেষমেশ চলে গেল।
ফেলে গেল ভ্যানিলার একটা নেশাধরানো গন্ধ…
দূরের জলে লাইটপোস্টের আলো মাছের মতো ছটফট করত।
আমরা মুখের মধ্যে আধখানা জিভ নাড়াচাড়া করতাম।
হঠাৎ-হঠাৎ জ্বলে উঠত অপারেশন টেবিলের মাথাগরম আলো…
হঠাৎ-হঠাৎ একটা সরু গলি হাত ছাড়িয়ে পালাত অন্ধকারের ভিতর।
জ্যোৎস্নায় চারদিকে ঘুরে বেড়াত রংআঁকড়ানো বেলুনের দল।
শ্বাসকষ্টের ভিতর আমরা ছটফট করতাম।
‘মাঝে-মাঝে ভয় করে,’ কেউ কি বলত?
কেউ কি বলত, ‘জলের এত কাছে চলে এলে কিচ্ছু যায় আসে না।’
কাচ ভেঙে আমরা মিশিয়ে দিতাম নিচু গলার গানে।
পুড়ে যাওয়া পিঠে গাঢ় অক্ষরে লিখতাম, ‘দিস ইজ নট ফেয়ার…’
আমাদের গল্পে কান্নার শব্দ ছিল না একচুলও।
কিন্তু আমাদের গল্প জুড়ে উজ্জ্বল সব বেলুন…
সোনালী চক্রবর্তী
প্রলোভন
একটা প্লাবন চাইছি ভীষণ, হয়তো প্রপাত ঘিরে ভূকম্পের উদ্ভাসে। পাখি ভাসছে অনেক হিরণ্যগর্ভ হ্রদে, এমনই মেঘেরা স্থির হয়ে আছে সম্ভাবী জলজ বিস্তারে। তোমায় বলা যাচ্ছে না, বিস্ফারে নতজানু হয়ে-পড়া প্রেমের আদিম অভ্যাস বলে পিরানহাকেও প্রজাপতি বোধ হচ্ছে এই অকালে। শোনো… এভাবে প্রস্তর সেজো না জিভ আর নরমের সংলাপে। প্রতিটি ভাদর শূন্য রেখে গেছে মন্দির এতদিন বিশুদ্ধ কুকুরের অভাবে। নাভির কদম পেরিয়ে দ্যাখো, আশ্চর্য সর্পের ন্যায় সে মুকুলিত ভেদ, যেমত মধুকুপি নদীটিতে আলো জ্বেলে কাছিমেরা নামছে বিষাদসরণির স্নানে।
তন্ময় ভট্টাচার্য
শেষ-নব্বই
কুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ছি আমরা। বেতের তৈরি, কেলেকুষ্টি। আধকৌটো চাল ঢালা সেই কুলোয়। ফোটানোর আগে, বেছে নিচ্ছি পোকা। একটা-দুটো-তিনটে। হাতের তালুতে ধরে রাখছি কিছু। বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে কনুইয়ে। আমরা চালকে দুভাগ করতে শিখে গেছি। মাঝখানের পথ পেরিয়ে অন্যদিকে যেতে চাইছে পোকা। আমরা জড় ও জীবে ভেদ করছি। বাংলা ও বাংলায়। তারপরও একই থাকছে অন্নব্যবস্থা। কুলো ঝেড়ে টাঙিয়ে রাখছি দেওয়ালে। চশমা ছাড়াই দেখতে পাচ্ছি বেতগুলোয় ফাঁক বাড়ছে, পোকার ইচ্ছে কমে এল, রেশন দোকানে আর দাঁড়াতে দিচ্ছে না বেশিক্ষণ।
উৎপল চক্রবর্তী
তেহাই
বুক ফেটে যাচ্ছে।
কিছু শব্দের হাত পা কেটে বেদম তেহাই চলছে শুধু।
সমগ্র রচনা তৎসম শব্দের মতো হারিয়ে যাচ্ছে আকাশে
‘বিবেক-রবি-রশ্মি’র মতো
কিছু পেপারব্যাক এব্রিজড ক্লাসিক বসে থাকছে বক্তৃতা মঞ্চে। সর্বত্র স্পেশাল এফেক্টের প্রচুর চাহিদা।
আমিও ডানাযুক্ত এক পিপড়ের ডিমের ভিতর
মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে উঠি।
গৌতম মণ্ডল
দুটি কবিতা
স্ফুলিঙ্গ
এই নদী প্রবহমান
এই মোহনা রাত্রির অবসান ;
আকাশ যার ললাট,
তার আকাঙ্ক্ষায় কেঁপে ওঠে তালবন।
বনের অনেক গভীরে কারা বল্লমহাতে
পায়চারি করে? সাইকেল থেকে নেমে
হেঁটে যায় বনের ব্যাসবরাবর?
ছায়া পড়ে। অবসন্ন রাত্রির ছায়া।
ছায়ার ভিতর নিঃশব্দে ছড়িয়ে যায়
বিলুপ্ত জ্যোৎস্নার জল।
প্রভাতকালের স্ফুলিঙ্গ
নিস্তব্ধতা
তারপর একসময় ঘর ঢুকে যায়
ঘরের ভিতর
রাত্রির ভিতর অচেনা রাত্রি
আমি হেঁটমুণ্ড হয়ে,ভূতগ্রস্ত,
ঘুরে বেড়াই অতীতপ্রান্তরে
প্রান্তর থেকে চলে যাই
আরেক প্রান্তরে
আমাকে এভাবে দেখে
চমকে ওঠে ফাল্গুনের বাতাস
বাতাসের গাঢ় নিঃশ্বাস
আমার অবসন্ন শরীরে ঢেলে দেয়
জ্যোৎস্নার মদ ও মাধুরী
শিশিরের নিস্তব্ধতা
সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়
কাশিয়ারা
যৌবন পালিয়ে যাচ্ছে — আমার থেকেই কোথায় যে!
তোমাকে পাবো কী করে! কী দিয়ে ফুলের করে নেব!
পাড়ে পাড়ে ঝরে পড়ছে কাশের অনেক দূর ঘর —
যেখানে গাছের আরো কচিকাঁচা ভাবনার ঝড়
কেমন মুখের থেকে আলো ভাব বিদায়ের মাঠে
মাঠের ওপারে ভালো এপারে কালো যত ভাবে
সবই কী লাভের অঙ্কে? চাল মারছে তোমাকে আমাকে…
সূর্য ডুবছে ওই ওই —যৌবন উড়েই যাচ্ছে ওই
সবুজ রঙের সমুদ্রের যত দূর দূর ঢেউ
শরৎ এমনই আহা! এসে ওই চলে যাচ্ছে কেউ …
সার্থক রায়চৌধুরী
তুমি
তিরিশ বছর আগের একটা দুপর মনে পড়ছে তিনা দি,.. একটা নিঝুম দুপুর আর আমি তিরিশ বছর আগের আমি হয়ে পাইপ বেয়ে তিনতলার ছাদ হয়ে কার্নিশ থেকে তোমাদের দু’তলার ছাদে নেমে দেখে নিলাম পুতুল ঘুমিয়েছে কিনা…তারপর হওয়ায় পা দিয়ে বেড়ালের মত ঢুকে আসলাম তোমার আধো অন্ধকার ঘরে,..
সূর্য অপ্রখর হবার আগে অবধি কি এক গন্ধের জন্য কি এক শব্দের জন্য.. মাথায় হাত বুলিয়ে ‘পাগল একটা’.. দু টাকা ঘুড়ির জন্য..
আম গাছ বেয়ে নেমে যেতাম নিচে,..
তোমার হাতে নির্মল দা র চিঠি
আমার লেখা গুলো শুনে একটা বই গুঁজে দিতে হাতে,…
কবিতা কি তিনা দি?..
আমি কাল একই পথে পৌঁছে যাচ্ছিলাম আর তখনই নির্মল দা বলে উঠলো- ‘কে রে?…
বাপুন? বাপুন??.. আমি তো চোখেই দেখিনা, দেখ কি একটা রাখা আছে তোর জন্য, ওই তাকে, ওষুধের পাশে’…
আমার সমস্ত লেখা নিয়ে নিচে নাবছি আজ
সিঁড়ি বেয়ে, থেমে থেমে, তিরিশ বছর পর
তুমি পেচ্ছাপে রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছ সব,..
অভিশাপ দিচ্ছে মাইনে করা আয়া,..
একটা গন্ধ লেগে আছে কয়েকটা শব্দের
অব্যক্ত ছায়ায় ছায়ায়..
সুকল্প চট্টোপাধ্যায়
যেভাবে
যেভাবে মেখেছ জীবন
খ্যাপা নদীর পারাবারে
বুকের ভিতর মরা জোনাকি আর
দু চোখে ক্লান্ত স্বদেশ
নিরন্ন নির্ঘুম
যেভাবে বেঁধেছ জীবন
আঁচল পেতেছ জলে
সাদা-কালো-ধূসর মাছেদের খেলায়
থেকেছ, যেন তুমি নেই
কোনওখানে
যেভাবে রেখেছ জীবন
নদীবক্ষে অপরাহ্নের জালে
এ প্রাণের তুফান কুড়িয়ে
ফিরে গেছ অন্য কোনও প্রাণে
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
ঘৃণা
তুমি যাকে ঘৃণা করো তার মতন কেন হবে তুমি
নিরাময় নেই এতে, বস্তুরও অধিক এক চাঁদ
ঊর্ধ্বে জাগে রোজ , তুমি তাকে দেখে কিছুটা অন্তত
শিখো শোন ছাড়ো ছাড়ো প্রতিহিংসা ঘৃণার করাত
তুমি যাকে ঘৃণা করো তার মতন হয়ে যাবে ব’লে
তর্ক করো , বলো : শোনো প্রকৃতিও শ্রীগোপাল নয় !
সেও হিংস্র ! তুমি তাকে রুগ্ন করো ধ্বংস করো, সেও
চারিদিকে আনে রক্ত, মহামারী মৃত্যু , অপব্যয়
শুধু কি প্রশান্ত ওই নদীজল , অবস্থা পাল্টালে
সেও হয় তিমি-ঢেউ হাঁ-মুখী অপয়া সর্বনাশী !
আমি বলি : শোনো তবে তার ধ্বংসে সৃষ্টি আছে, তুমি
নিজের হিংস্রতা নিয়ে কেন আজ এতটা বিশ্বাসী !
তুমি যাকে ঘৃণা করো তার মতন হতে চাইছ কেন ?
ধ্বংস নিয়ে কথা হবে ? তাহলে সহ্যের দাম নেই ?
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
সোমনাথ এখনও
ঘুম থেকে তুলে কাঁধে হাত রেখে কেউ যদি বলে:
সোমনাথ, এখনও এখানে?
তিরিশ বছর পর আজ তার কোনো হয় মানে!
যে আর মানুষ নেই,তবু তার, তাহাদের কথা
মাইল মাইল পথ মাইল মাইল নীরবতা।
আশ্বিন বিফলে যায়, স্বধর্মে নিধন হতে হতে
দিনগত পাপক্ষয়,বন্ধ রাখি মুখ,কান,চোখ
কে তুমি বিজনসঙ্গী, যেন তুমি পাশ্চাত্য পাড়ার
রিক্সা থেকে ডেকে বলো, সোমবার কেটে গেছে, চলো।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত এ শহরে করোনা অতীত
ট্রেন চলে কদাচিৎ, সদাশিব মানুষেরা ঢুকে গেছে তালাবন্ধ ঘরে
অনেক দূরের কন্ঠ মাঝরাতে টেলিফোনে বলে: তোমার ছেলেটি ভালো, দেশের মেয়েরা ভালো আছে?
মানুষ যাবেনা আর, কোনোদিন, মানুষের কাছে!
বামাক্ষ্যাপা অন্ধকার, ধর্ম যেন ষাঁড়ের উল্লাস
সরল শান্তির চেয়ে চপলতা ছিল বুঝি ভালো
আকাশ প্রদীপ জ্বলে খোলা ঘরে চিরুনি তল্লাশ।
কর্কট রোগের স্মৃতি অলিপাবে গ্যালন গ্যালন
বুদ্ধদেব,বুধসন্ধ্যা, মুখে মারি ওকাউরি কথা
হ্যাঙোভার কেটে গেলে মাইল মাইল নীরবতা।
বোতলে মেসেজ ভরে কারা ফ্যালে দুয়ারে গঙ্গায়?
তুমি কি তাদের চেনো যারা আর তোমাকে চেনে না
তোমার চোখের নিচে ঘন কালো নাগরিক ক্ষত
তুমি কি করেছ ক্ষমা,ব্যর্থ রোষে ভেঙেছ কলম?
এখনো কি স্বপ্ন দেখো, গল্প লেখো সোমনাথ লাহিড়ির মতো?
যাদের হৃদয়ে ছিল হঠকারী বিপ্লবীর ক্ষত
বন্দরে পকেটখালি নাবিকের ভালবাসাবাসি
তুমি কি তাদের চেনো, তুমি কি তাদের কথা লেখো?
বিভিন্ন পালক ছুঁয়ে তুমি নাকি তিমির বিনাশী!
ছাদের উঠোনে তবু টিউলিপ গন্ধরাজ ফোটে
রৌদ্রস্নাত মুখে আজো লেগে আছে ক্লান্ত স্ববিরোধ
বিচ্ছুরিত জলকণা মুছে গেলে ভয়াবহ অচেনা গলায়
সোমনাথ বলেছিল, সোমনাথ আজ তুমি মৃত।
বেবী সাউ
পাড় ভাঙা সনেটগুচ্ছ
আমার ঘুমের মধ্যে কে কুমির ভেসে ওঠে আজ
অন্ধকারপ্রিয় এক ছুরিকায় দেখি রক্ত লেগে
তুমি কি প্রেমের কাব্য, তুমি কি মধুর কারুকাজ?
আমি তো আগুন খেয়ে দেখি সূর্য অন্ধকারে জেগে।
কে তুমি এমন করে আমায় শোয়াও নদীজলে
কে তুমি লম্বাটে এক বারান্দায় কৌতূহলী মুখ
সাহস পুড়েছে তাই পোড়া দাগ ধুয়েছি, বদলে
সে আমার সব নিয়ে দিয়ে গেছে ভাষার অসুখ।
এ তবে আমারই গান, সুরে যার আঁকা প্রজাপতি–
কবেকার মৃত ডানা, তবুও রঙিন উড়ে যাওয়া
এখনও ফুলের গর্ভে শুনি প্রেম করেছে আরতি
এ ঘন সন্ধ্যার চুল শুকিয়েছে দক্ষিণের হাওয়া।
এই তো জীবন প্রিয়, এ জীবনে শান্তিজল চাই।
তোমার মুখের দিকে খিদে নিয়ে আমিও তাকাই।
কস্তুরী সেন
নেতি
না দিয়ে কবিতা শুরু করি
না রোমাঞ্চ, না না যাত্রা
নদীদৃশ্য ছেড়ে আসা অন্ধ মফস্বল
না সাঁতার, উঠে চলো, পতঙ্গটি অবাধ্য করুণ
অথচ জীবনে উড়ছে, না সেই জীবনজোড়া ওড়া
তুমি ভিক্ষে নিলে,
না সন্ধ্যা, পাণিগ্রাহী
একঝলক কেঁপে ওঠা ‘সত্যি বলো’ কররুদ্ধ জল
না বিশ্বাস…
আবার নতুন পঙক্তি এল কি জীবনে?
নাগো প্রেম এজন্মের
এই অন্ন খুঁজে চলা হাতে, যেটুকু নতুন তা তো
উৎসর্গের পাতাজুড়ে এই
একান্ত রঙিন শুধু চিহ্নটুকু লিখে রাখা ফের –
না সমাজ, না সাক্ষাৎ
মনে, মনে, মনে
শাশ্বতী সান্যাল
খেউড়
গলা টিপে মেরেছিলে। তারপর ফেলে রেখে গেছ।
পুরোনো পাখিরা এসে দুবেলা চারবেলা
আমারই শরীর থেকে খুঁটে নিয়ে গেছে শস্য ধান
মাকড়ের হাঁটাচলা চোখের উপরে
ক্রমশ স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে
তুমিও তো শ্মশানমাটিতে বসে খেউড় লিখেছ
কেউ কোনোদিন সেই খাতা থেকে, শব্দকোষ থেকে,
ছ্যাঁকালাগা শরীরে, প্রায়-অর্ধেক নগ্ন হয়ে
উঠে আসতে পারে- ভেবেছিলে?
এসেছি, দাঁড়িয়ে আছি তোমারই সম্মুখে
মুখে জ্বলন্ত কাঠের ছাই,
জামা পুড়ে গেছে দাউদাউ
অথচ নগ্নিকা মূর্তি দেখে
তোমাদের শিশ্ন আজ, কী আশ্চর্য, বেঁকে যাচ্ছে
ভয়ে, ব্যর্থতায়…
অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়
পাথরের ভ্রূণ
পৃথিবীকে উলটো করে ঝুলিয়েছি হিংস্র বাঘটির পাশে। সে অনন্তকাল ধরে বসে আছে সুতোর রাস্তায়। সুতোটি নম্র ভারি। এতকাল না ছিঁড়ে কীভাবে যে ধরে রাখে প্রান্তর, টিলা, বন্যপ্রাণ সব, সেই ভেবে গম্ভীর হয়ে যাই। সহাস্যে বলতে পারি না কোনো শ্লোক। দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসে বরফের সিঁড়ি।
আমার উল্লাস আজ ফেলে দিয়ে যাবো এই নিঃস্ব জঙ্গলে। যেখানে বৃক্ষের হাতে দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে মানুষ। আকাশ ফেটে গিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। সমস্ত ঝোরার ভেতর থেকে উঠে আসছে পাথরের ভ্রূণ। এমন স্থানের কাছে নতজানু হয়ে ফেলে দিয়ে যাবো সব কাঙ্ক্ষিত ভুল।
আমাকে ক্ষমার কোনো প্রশ্ন তুলো না। তার চেয়ে জ্ঞানীর কাছে যাও৷ দেখো কোন কুটির থেকে বেরিয়ে এসে পাখিরা ছড়িয়ে দিচ্ছে বীজ। আগামী ক্ষুধার মাসে তার থেকে জন্ম নেবে শ’য়ে শ’য়ে নগ্ন তলোয়ার।
দাঁত খুব স্থির। হাঁ এর মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শূন্যতার রং। একটি গর্জনে কেঁপে ওঠে শিরা। পৃথিবীকে উলটো ঝুলিয়ে রেখে আমি বাঘটির কাছে যাই অপার সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিতে।
তৃষা চক্রবর্তী
দুটি কবিতা
১.
আমি বর্ষার মেয়ে
মুষলধারে এন আর এস
হাসপাতাল, বারবার
আমার মা, পদার্থবিদ্যা স্নাতক
দুই হাত জোড় করছিল
না ডাক্তারবাবু, শনিবার নয়
এ মেয়ে কপালে অলক্ষণ আনবে
এল।
সেই তার ঘর জোড়া কাণ্ডকারখানা
নিয়ে বসে আছি
আমার নাম কেন শাওন নয় মা?
সুন্দর একটা নামের শখে বেলকুড়ি
তুলে তুলে মালা গেঁথেছি,
পরা হয়নি
‘ওরে হতচ্ছাড়ি, কেউ আসবে না
তোর মালা নিজেই পর’
মা বুঝি বলেছে
আর লোডশেডিং সন্ধে চিরে
দু একটা সাইকেল ঘন্টি
আমার পেরুলো কত আষাঢ়-শ্রাবণ
২.
এ শহর কোনোদিন কবিকে বোঝেনি, তুমিও তেমন
মেঘের হৃদয় দেখে দুর্বলতা ভেবে নিলে– আড়ালে
প্রকান্ড সূর্য নিশিদিন ছাই হচ্ছে পুড়ে কী জ্বালায় সে
শুধু আখর জানে, আর জানে কবির পাঠক, হঠাৎই
মিল খুঁজে পায়, উত্তর কলকাতার অলিগলির মতো,
নিজের সঙ্গে কী ভীষণ এক মনে হয়। কবি জানে, বেদনা
তার, অসীম ও অটুট। ভেঙে পড়বে, চুরমার হতে থাকবে
যন্ত্রণায়– পৃথিবীর আদিম মানবীর মতো একা, অসহায়
সায়ন রায়
তথ্যচিত্র
একটা হাঁ-মুখ থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের গোলা।এক দুই অগুনতি।এতসব দাহ্য বিষ হজম করা ভগবানের বাপেরও আসাধ্য।আমি এক মনুষ্যেতর।নিয়তি নির্ধারিত পথে হেঁটে যাচ্ছে সরীসৃপের জীবন। পথমধ্যে শব ও সুন্দর দুই-ই দেখে যুগপৎ আনন্দ ও হতাশায় ঢেউয়ের আশ্চর্য ওঠানামা।দুরন্ত ইথারের ঢেউ,পাগল ঝাপট, হাওয়ার উচ্ছ্বাস, মহাজাগতিক রশ্মির প্রপাত—এতসবের মাঝে একচিলতে আলো এবড়োখেবড়ো ভাঙা মোমবাতির দপ্ করে যদি নিভে যায়, যদি প্রাণের নরম মুছে গিয়ে মরুভূমির বালি এসে ঢেকে দেয় ঘাসের সবুজ, যদি খরস্রোতে ভাসতে ভাসতে পাথরে ধাক্কা খেয়ে শতটুকরো হয়ে যায় নৌকোর শরীর—সে তো খেলারই অংশ। বড় নিষ্ঠুর শূন্য হাহাকারে ভরা দগ্ধ কঠিন এক ভয়ংকর খেলা।প্রামাণ্য জীবন।বিষাদের তথ্যচিত্র।
সন্দীপন চক্রবর্তী
বৃষ্টি
জানি না বৃষ্টি কেন বিষণ্ণতা বয়ে আনে এত
ঝমঝম করে ঘন ভারী এক পর্দা নেমে আসে
কিসের বিরহ? এত মসীময় নরম প্রকৃতি
জলের ভিতরে নেমে ঘুম পায়…নেশা নেশা শ্যাম…
সমস্ত জীবন থামে, ধারাপাতে শব্দপাতে থামে
মাথায় ঝাঁপিয়ে নামে
বৃষ্টি নামে হৃদয় অতলে
ভেজা কাক বসে থাকে বারান্দার ভাবুক রেলিঙে
সেও কি আমারই মতো স্মৃতিময়, শূন্য, এলোমেলো?
সমস্ত বাহির যেন ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে
সবুজ বাতাস থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে শ্লোক
বৃষ্টি কি আমারই মতো আহাম্মক?
অকাজের কাজী?
বৃষ্টির বল্লম ভেঙে কয়েক মাইল যেতে রাজি
যদি সে আমার কাছে আমায় ফিরিয়ে দিতে পারে
এই জল, মেঘে মেঘে এই কৃষ্ণ আলো
আমার ভিতরে যদি জমে থাকে, ভালো –
নাহলে কোথায় যাবে?
আমি এই বৃষ্টি থেকে তুলে আনি মুঠো মুঠো ঘুম
তুলে আনি অনন্ত নিঃঝুম
তুলে আনি বিগত জন্মের স্মৃতিকণা
বৃষ্টিও তুলেছে ফণা –
আমি তার প্রথম শিকার
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
গোপন কাজ
ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় হরিণ
মায়া-হরিণ-রাক্ষস
তোমার দীঘি কাঁসার গ্লাসে তাকে
সবুজ মেঘের ষড়যন্ত্র দিত
শর্ত ছিল জলের উঠোন পার!
যখনই বাজ পড়বে শিমূল
সাদা থানে খুলবে নিজের স্বর্গমাখা লাল
বৃষ্টি শেষে বিরহী স্টোর্স
জড়ির পাড়ে কিনে আনবে নতুন বেনারসি
আয়না বলে: দাঁত ফোকলা বুড়ির মনের সাধ কত লো দ্যাখ!
সবুজ মেঘের তলায় তখন হাসির আওয়াজ
জলে ডুবছে শশী…
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
জ্যামিতি
অসংখ্য জন্ম।তারকাও অগনন।নক্ষত্রকালের কৌণিকগতি নির্ণয়ে ব্যস্ত ছিলাম আমরা।পথের দৈর্ঘ্য চিরকালই অভিন্ন। রঙের উচ্চতাও ঘনকের দিক প্রকাশের অন্তরায়। উত্তর মিলে না হেতু শূন্য কেবলই প্রসারিত হয়।কম্পাসও বিঁধে যায় দূরত্বমাফিক।আচার্য বলেন দিক ও সময়ের রহস্যে ঘনক বরাবর ছায়ায় আচ্ছন্ন।ফলত ত্রিকোণমিতির ভঙ্গুর ধারণা থেকে যথাবিহীত জ্যামিতিক সন্ধানে উদ্যোগী সকলেই। স্রোতের নতুনতর বিভাজনে দৃষ্টি হতবাক।অবশেষে ঘনকের সরলতা হইতে টার্নকেটেড প্রিজমের জটিলতর পথটিতে দিবস সম্পূর্ণ হইল।প্রদোষে আলোক প্রজ্জ্বলন ও পঠনপাঠন আচার্যের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।নতমুখ অপরাহ্ন চক্ষু মুদিলে তিনিও গ্ৰন্থাদির পত্রমুদিত করিয়া গাত্রোত্থান করেন।বৈকালিক দীপ্তি শীতার্ত হইবার পূর্বেই নৈশাহার সমাপনে নিদ্রাগমন তাহার নির্দেশ।কেননা আকাশ দ্বিধাহীন।কেননা স্বপ্নমাত্রই এই সমাহার!এইকালে প্রাচীন ছায়াপথের কিনারে পৌঁছিলেই অপরাপর সাক্ষাৎ সম্ভব। তিনি জানেন আলো কিংবা আঁধার যথার্থই অতিরেখ।অপচয় বন্ধ করো!নির্দেশ আসে তাই অতিদূর নক্ষত্রের রঙে।অভিমুখী হও!তথাপি নিদ্রাহীন আমাদিগের চেতনা গাণিতিক ধাঁধায় তীক্ষ্ণ হইতেছে পুনঃ পুনঃ স্বপ্নদংশনে।ঘুম ও জাগরে আকাশ ক্রমেই অসিতাভ।দৃষ্টি মেলিলেই প্রিজমের উপরিতলে রঙের বহুস্বর ভাঙিয়া পড়ে। চক্ষুর স্নিগ্ধ চরাচরে আচার্যের পশ্চাতে পুনরায় যাত্রা শুরু হয়…
সন্মাত্রানন্দ
চিহ্নময়ীকে
তোমার স্বভাব রোজ চিহ্ন রেখে যাওয়া ।
যেমন চিরুনিতে চূর্ণকেশ
দেওয়ালে মাথার দাগ
আয়নাতে সোয়েটের টিপ
বট বা অশ্বত্থের ডালে বেঁধে রাখো বাসনা মলিন
প্রত্নপ্রাসাদের গাত্রে লিখে যাও প্রণয়ের নাম
তোমার স্বভাব এই — চিহ্ন রেখে যাওয়া ।
স্মরণের উপাদান দুপাশে ছড়িয়ে তুমি কোন্ তৃপ্তি খোঁজো?
আদরের দাগ এঁকে রেখে অশ্রুজলে চিরত্ব চেয়েছ?
শাশ্বতী সম্বিৎ তুমি, নও নারী এ অচিরাবতী ।
সোনালী ঘোষ
মধ্য দুপুর
এখনো মধ্য দুপুর। দ্রুত হালকা হয়ে আসছে শরীর। নির্জন পথ কত যে দীর্ঘ হয় জানে কেবল নিঃসঙ্গ পথিক।গাছেদের পাতায়, প্রতিশ্রুতির রঙ হলুদ । হরিনাম খসছে বিষন্ন বাতাসের বুক থেকে,বিন্নিধানের খইয়ে হাহাকার; কত শোক ধারণ করলে তবে শুভ্রতা আসে…মাঠের দু’ধার থেকে সরে যায় ছায়া ,কেঁপে ওঠে জল, স্নান সেরে উঠে আসে শাঁখা পরা এঁয়োতির দল, শঙ্খের মতো তীব্র স্তন তাদের, মেঘ জানে তার তীব্রতা কতখানি। এ মুহূর্ত খসে যাবে জানি, যেভাবে বিষাদ নিয়ে পাখি ওড়ে তার শূন্য নীড়টির দিকে।
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে
হে দেহাভিমানী জীব।তুমি
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখো
উত্তরের জানলাকবাট আজ
খুলবে না দোহাই।নিরাপদে
বিষদোষে আবদ্ধ তুমি আমি
এখনও বোঝোনি হে বিবেক
আরোগ্য আসবে নিশ্চিত।তাই
বিমূর্ত আরোগ্যভারে ঝরে পড়
কতো বছরের পর পদাবলী গাথা
নীরবে লিখছো তুমি।যেন উপাচার
যাতায়াত পথ অবরুদ্ধ নিরাপদে
কথা ছিল প্রায়ান্ধ কথোপকথনের
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে
হে দেহাভিমানী জীব।তুমি
আরও একটিবার সরে এস
বিষযাপনের পর নিশ্চিত সন্ন্যাস
এতকাল
বোঝোনি সে কথা।
ঈশানী বসাক
দুটি কবিতা
পূরণ
মাথা নীচু করে থাকার মধ্যে একটা জ্যোৎস্না আছে
লড়াই করা মোরগের ঝুঁটি সেই চাঁদের আলোয়
রাখি হয়ে মিশে যাচ্ছে চরাচরে
এপারে দশাশ্বমেধ ঘাটে আলো জুড়ে যে সাধু বসে
তার চোখে চোখ রেখে তেতে যাচ্ছে সাদা নোনতা বালি
আমরা যারা খুব ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে
ভোর থেকে রাত চিবিয়ে খাচ্ছি গোল রঙ বেরঙের তেতো জেমস
তারা হয়তো খাতার পাতায় একটা করে সই করি অজান্তে
নীচু হয়ে সব কিছু মেনে নেওয়ার সই
রাতের নীল আকাশ জোড়া তারার নীচে ওই লাল ঝুঁটি ঝলসায়
রাখি পরায় আমাকে ডানহাতে
তুমি একবার আমার জন্য পুতুল এনে দেবে?
কাপড়ের পুতুল যার মধ্যে হাড় থাকবে না
আসলে নিজেকে একা এতটা চাঁদ মাখা হতে দিতে
খুব খারাপ লাগে
নিয়তি
জুতো কেনার সময় সোল টিপে দেখি
নরম কিনা যাচাই করি
পায়ের তলায় যেন আরাম থাকে
যেমন বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলে হয়।
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল সবটা যেন
ফেরত দিয়ে যেতে পারি
একটা গাছ সেটা যত্ন করে রাখবে।
জামা কেনার নানারকম অদ্ভুত ভয়
কে জানে কেমন লাগবে দেখতে?
নিজেকে জামা জুতো দিয়ে ঢেকে রাখি
যে কটা দিন বাঁচি না কেন
আমাদের তো আসলে কোনো শাখা নেই।
চা বাগানের মাঝখানে এক আশ্চর্য চক্র
সবাই মিলে নুয়ে পড়ার ছায়া
চা গাছের ছায়া দেখা যায় না
একে অপরকে বেঁধে নিয়ে বাঁচা
ছায়াকে দেখার চক্করে ওটুকুও যদি তেতো হয়!!
জাতিস্মর
প্রণয়
নিজের উপর এতটাও বীতশ্রদ্ধ হয়ো না যেন নিজের বিছানায় শুতে গেলেই তোমার মনে পড়ে গতজন্মের ফুটে যাওয়া কাঁটার ক্ষত, অন্ধকার কেবিন ও একটি নির্জন হাতুড়ির সংলাপ।
সকাল থেকে কাঠ-চেরাইয়ের মিস্ত্রি মুহূর্মুহু কাঠ-চেরাই করে চলেছে আর দুজন ভিন্নরক্তের মানুষ বারবার তোমার হাতের শিরা টিপে টিপে দেখছে—
রক্ত ও আগুন বড় বিষম বস্তু দেখো কেমন প্রতিটি জাহাজ প্রতিটি জাহাজের জন্য বন্দরের গায়ে আঁচড় কাটছে আর দূরে একা বিষণ্ণ লাইটহাউসের গায়ে ফুটে উঠছে আগুনের যন্ত্রণা ও রক্তাক্ত প্রণয় সংকেত
সকাল থেকে তবুও কাঠ-চেরাইয়ের মিস্ত্রি মুহূর্মুহু কাঠ-চেরাই করে চলেছে।
আর সময় নেই—
এবার আরও আঁটোসাঁটো হও। আগুন যেন একসাথে দুজনের রক্তকে স্পর্শ করতে পারে…
রণজিৎ অধিকারী
সময়
সময় আমাদের ব্যবহার করছে।
গ্রীষ্ম যেখানটায় এনে রেখে যায়, একটা প্রান্তে,
— বর্ষা ঠিক সেখান থেকেই তুলে নেয় আমাদের।
একদিন তার ইচ্ছে মতো লম্বা গাছগুলোর নিচে
দাঁড় করিয়ে দিয়ে দুজনের সর্বস্ব ভিজিয়ে দেয়,
তারপর এক ভ্যাপসা ঘরের ভেতর কদিন পুরে রাখে,
তখন খুব ঘন হয়ে তোমার দিকে তাকাতে তাকাতে
ভাবি,
— পুরো জগৎটাই কেমন স্যাঁতসেঁতে।
এই নিরক্ষীয় অঞ্চলের অবিরাম বজ্রপাতের ভয়
আরো কাছাকাছি এনে দিলে আমরা মিলনের জন্য প্রস্তুত হই,
আর ঝমঝম বৃষ্টিপাতের শব্দ যখন কামাতুর করে তোলে আমাকে, তখন তোমারও শরীর থেকে
সোঁদা গন্ধ উঠে আসতে থাকে।
এবং সংগমের মাঝখানেই আবিষ্কার করি, সময়
একইভাবে আমাদের ব্যবহার করে চলেছে।
কিন্তু আমরা থামি না,
যতক্ষণ না সময় এসে দুটো ক্লান্ত রেখার মতো
দুজনকে পাশাপাশি শুইয়ে দেয়।
অদিতি বসুরায়
মাস্তানি
এই যে রাত তিনটেয় উঠে বসে আছি
আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই ।
যে সমস্ত ভোর, রোদ্দুর আনতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে
তাদের ডাক ফিরিয়ে দেওয়ার মাস্তানি আমি বহুদিন রপ্ত করেছি।
রপ্ত করেছি , ফিরে না – তাকানোর অভ্যাস
নতুনচারাগাছেদের জন্য আমাকে জায়গা খুঁজতে হয় নি
এবং পুরোনো ছেঁড়া জিন্সে এখনও ফুল ফোটে ।
জ্যোৎস্নাহীন রাতে চালচিত্র ফেলে আমি বেড়িয়ে পড়ি
পথে , বন্দরে মশাল জ্বলে
বোতাম ফেলে যাওয়া নাবিক , চিঠি লেখার ঠিকানা চায় –
আমি হেসে হাঁটা শুরু করি
রাত তিনটেয় যারা ওঠে ,
তাদের শেকড়ের মাটি বসন্তগামী জানা গেছে।
সৌভিক গুহসরকার
দুপুর, শেফালী ও শরৎ
দুপুর দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ
নির্জন গাছের আড়ালে, ঘুঘুর ভেতরে
শেফালির জন্য; সে তবু আসে না
ঝরবার দিন তার আজও হয় নি
শেফালি পিত্রালয়ে গাছে, সুখে আছে
অথচ দুপুর ডাকে― মিলন মিলন
নদীতে স্রোত; পুকুরে পানা; শেফালি ঝরবে কি?
ঝর, ঝর― মর!
শেফালি আলুথালু ঝরে যায় দুপুরের বুকে একরাশ
রোদ্দুরে ডানা ঝাড়ে বকফুল, হাঁস
শরৎ এসব দ্যাখে দূর থেকে, আকাশের নীলে
তার কোনও উপায় নেই, সে শুধুমাত্র অনুঘটক―
দুপুরের খবর শেফালিকে দিয়ে সে চুপ করে গেছে
কাশের বনে মেঘের ভেতরে
শরতের বুকফাটা রোদ নিঃসঙ্গ ভূতের মতো ঘোরে
প্রগতি বৈরাগী একতারা
মা
স্মৃতি এক নাছোড় শত্তুর
কানে কুমন্তর দেবে
আলো ফেলবে চক্ষের ভিতরে
স্মৃতি এক কথার খেলাপী
ব্রীজ-ট্রীজ ভেঙে দিয়ে
অন্য পাড়ে নিয়ে যাবে বলে
তিন লাফে ঘুরে আসে তিরিশ বছর
এতটুকু করে দেয়, পুরোনো সকালে
“আর না, আর না” বলে ঘড়ি দেখছে
জামরুল ফলের মতো বোঁটায়
মেখে নিচ্ছে নিমপাতা রস
জিভ ছুঁয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি
দাঁত বসাচ্ছি, লাথি মারছি
ছিটকে গেল ব্যাগ আর টিফিনের বাটি
সারা গায়ে ভাত মেখে
মা আমার মুখে ভালো বুকটি গুঁজে দিচ্ছে
আমার মায়ের ঘা ধুয়ে দেব
আমাকে সাঁতার দাও, স্মৃতি,
ওই পাড়ে যাবো।
শর্বরী চৌধুরী
কূটাভাস
শব্দের কূটাভাস জাগ্রত করে সুষুম্না
স্বভাব-সন্ন্যাসীর উত্তরণে ভরা প্রার্থনাগৃহ
যে মৌন জঞ্জাল, তাকে ছুঁড়ে ফেলি নীল
জাহাজের অতলে। শেষ প্রান্তের উপেক্ষা বয়ে
আনে দীর্ঘ কৌতুক। চলে যাওয়ার আগে
মৃদু বানভাসি। ভরে যাবে হৃৎপিন্ডের
অলিন্দ-নিলয়।
শীর্ষা
পরজীবী আত্মার বই
১
পারদের মরাই বেঁধে ঘুম দিচ্ছে জ্বর,
কাচের শরীর বেয়ে ওঠানামা করছে
একটি সিঁড়ির রহস্য। তোমার ধাতব তাপমাত্রার ঢেউ
পড়তে পারছে না কেউই! পারদের দামিটুকু দেখছে—
এক অপরাজেয় ক্যাম্বিসের ব্যাগ কী নিপুণ
মিথ্যে হয়ে যেতে পারে তেতো ঠোঁটের
মৃদুমন্দ হাসির নূপুরে
২
জলের সমার্থক খুঁজবে বলে তুমি
অভিধান কিনে নিলে— এখন যার
প্রতিটি পাতায় নদী বয়ে যায়,
যতখানি আমার অনুরাগ
৩
উপুড় করা কলসির মতো নিজেকে
খালি করে দিচ্ছ তুমি— এক অপমায়ার পায়ে!
আমি দেখছি এক শৌখিন বকের ঠোঁট কীভাবে তার
সমস্ত রং ঢেলে দিচ্ছে আদিম অরণ্যটির
ফলন্ত শরীরে
৪
কিছু হস্তশিল্পের সুতোর কাছে হেরে যাচ্ছে
জিভ, অবলা কুকুরের লেজের মতো
গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে— আর এভাবেই
সূক্ষ্মতার পায়ের কাছে জমা থাকছে
জয়ের নিখুঁত বানান
৫
অশরীরী আত্মার মতো তোমার
চলে যাওয়া দেখি— ক্যাকটাসের গোপন আশ্চৰ্য
যাকে মুড়ে রাখে সাবলীল। শুধু একবার
পিছু ফিরে তাকালেই, মরুভূমির পিঠে
প্রজাপতি এসে বসে, হাজার হাজার— যেন বা দীপাবলির
অরূপশহর!
স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষদৃশ্য
১।
কাঠ চেরাইশব্দ কোনখানে
কোনখানে বৃষ্টিধরা মাছগাঙ
উন্মুখ নামছে
ক্ষয়াটে বাতাস
আশরীর ভিজে ঘাম ঘাম
২।
চমক
রাখতে গেলাম
গড়িয়ে গেলো
ঠিনঠিন শব্দ
শব্দাবলী
ছায়া কাটছে
করাতের তীব্র
৩।
যা ইচ্ছে তাই বলি
হতভাগা লুচ্চা নরকের কীট
পাঁক মেখে ফিরে আসো
দু’হাতে শরীর ঝুলিয়ে
৪।
গান কিশোরী হয় রাতে
জানলারা গভীর সুরঙ্গ
সপ্তকে নিষাদের গুণভরা তির
হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে
মা ডাকে
মা মা ডাকে
আমি আসছি করে
একডুবে
কুয়ো হয়ে যাই
৫।
সে নিঝুম ছিলো
অন্ধকার ছিলো সে-ই
আমি তার মুখ দেগে রাখতে গিয়ে
তাকে ছাড়িয়ে আলোকে দেখলাম
মনোতোষ আচার্য
জন্মান্তর
ভাঙচুর ঘটে যাচ্ছে প্রতিটি প্রহরে
ঈশানের উপবনে নরম আখরে লিখি
অগ্রপত্তনের জ্বরজ্বালা…
প্রবল মদের ঘোরে ঝুঁকে পড়েছে গলিগুলি বড়রাস্তায়
প্লাস্টিক কুড়ুনির সর্বহারা পায়ে ফুটে গেছে কাচ
মিথ্যার ঔরসে জন্ম নেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি
সচিত্র ব্যানারে ফুটে উঠেছে মোড়ের মাথায়
পুঁজিহীন রূপকথার দেশে নিতম্ব দুলিয়ে ওঠা সন্ধ্যার মেঘে
রহস্য প্রাচীন কোনো স্মৃতিস্তম্ভে খুঁটে নিই বিপ্লবের পাঠ
বোধহীন প্রশ্নগুলি খবরের পাতায় পাতায়
নাগরিক আরোগ্যের ঘুমের ওষুধ
সীমাহীন অন্ধকারে পণ্য হয়ে দর হাঁকায় শরীরের লোম।
সমুদ্রের ছলাৎছলে জেগে আছে ধ্বনি শুশ্রূষা
রাতের ভয়কে নিঃস্ব করে দেওয়া দুর্ধর্ষ দিনগুলি
প্রতি মুহূর্তে এইভাবে কেন বেঁচে আছি বলে ধমকায়
তাই তো অনন্ত অশ্রুর গাঙে সময় বেচে বসে আছি।
ঠিক ডেকে নেবে তুমি অথবা ডাকতে ভুলে গিয়ে
কোনো এক নতুন ভুলের দেশে
আমাদের জন্ম হবে শিকড়ের খোঁজে…
নীলাদ্রি দেব
আমি
যন্ত্রগান থেকে মায়া ভেসে ওঠে
ঘুমন্ত শহরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে
ভীষণ তুচ্ছ মনে হয় শ্বাস
ঘন কুয়াশার শেষে যে রেখা
হাঁটতে থাকি
মুখোমুখি থমকে দাঁড়াই
এরপর অজস্র আমি ঘিরে ধরে
প্রতিটি একক আমি আমার থেকেই
পালাতে চেষ্টা করছে
রুমা তপাদার
টেলিফোনিক
নমস্কার!
অন্ধকারে সর্বোচ্চ পর্যন্ত বুক ডাঁটো হয়ে উঠল
কান থেকে মাথা থেকে গলা, ঘাড়, দুটি পায়ে
শব্দরূপ ধাতুরূপ সবকিছু অতিক্রম করে
স্বর এসে বাড়ি ঘিরে ফেলল…
নমস্কার!
হুম।
সাবধানে ফেরো, সুবাতাস, মেধা শেষ হয়ে গেছে।
আকাশের কাছে সত্যি বলতে
কোনও অভিমান ঢাকতে নেই
জড়োসড়ো হাসি ঠোঁটে যতদূর বলা যায়…
আপনার দিনটি শুভ হোক।
শব্দ শেষ।
নির্জন বিশ্বাসে ভর করে সামান্য আকাশ এল
লজ্জা লজ্জা মুখের গড়ন নিচু চোখ
একাকী ফুরিয়ে যেতে থাকি
সারারাত মনে পড়ে তার তাকানোর দিগন্ত দিগন্ত গন্ধ-ঝোঁক।
গা শিউরে ওঠে, আপনারও…
(দিনটি শুভ হোক)
আর
আপনার শুভ হোক…
প্রত্যূষা সরকার
আদিম জানলা ও সমুদ্র পার্বণ
–
যে বিশেষ সম্ভবনার কথা তুমি বলো
হাঁটু-ভাঙা জীবনের টক্সিক মুখরতা।
সম্পর্কে ভোকাবুলারি বেড়ে যায়
দর্শনে হাইব্রিড রোম্যান্স…
এই পাশাপাশি জীবন ধর্মনিরপেক্ষ, হিপোক্রিট
অশ্বখুরাকৃতি পূর্ণিমায় থকথকে ঢেউসুখ।
তুমি ঝাউ পাতা, হিজিবিজি ভ্যাকেশন
কক্ষপথ সংক্রান্ত ভুলে
আমি পরিপূরক ভুলে যাই…
অরিজিৎ চক্রবর্তী
পুষ্প বনে পুষ্প নাহি
আফ্রিকার রাইজিং স্টার গুহায়
আমি তাকে খুঁজে পেয়েছিলাম
আর প্রপিতামহের
নীল হ্যারিকেনে আক্রান্ত হবার পর ভেবেছিলাম
আমার প্রেমিকার বিষণ্ন দুটি স্তন আসলে মেনহীর…
যার ফলে আঙুলের প্রয়োজনীয়তা কমে গিয়েছিল!
স্তব্ধতা রাঙিয়ে বুদ্ধ বলেছিলেন যাও
ধ্বনিভস্মে অশ্রুভস্মে যাও…
অতিনিবিষ্ট অন্ধ সন্ন্যাসীর
আমৃত্যু পার হয়ে বলো, ” কৃষ্ণ নেই !
ভগবান স্বয়ং অবতংশ”
তোমার প্রভূত বাঙ্ময় ও অস্থিরতা
তোমার প্রভূত উপাচারহীন আলো…
রাজেশ্বরী ষড়ংগী
চূড়াটি মোহন
১.
এসো বৃষ্টি চিরসবুজ বাঁশরির চোখে
যমুনা উজাড় করে একদিন ঠিক
মৃত্যু চেয়ে নেবো- মধুঅভিসারে।
খন্ডিত আলোরেখা,তমালের ছায়ায় খুলে রাখে
জোছনাকপালে।
হৃদয়ের মেঘ পরবাসে এঘন কদম্ব বসতি আমার আকুলি লুটায়।
২.
এমন কোকিল আগুন
অনুতাপে বিছালো শরীর, এ মরম কোথায় রাখি!
প্রিয়ভাষ্য মৃদু চোখে তার?
আপাতত প্রপাত হলেই বেঁচে উঠবে
ছলনায় ক্ষয়ে যাওয়া হতাশাময়ূর
স্থিরগুচ্ছ কাঁকনের ধ্বনি।
এ যাতনা আপনি পুড়ায়।
বৈরাগ্য বাঁধে না পায়ে
হৃদ মধ্যে চূড়াটি মোহন।
৩.
মুগ্ধ স্মৃতির দিনে কিছু পত্র অনিবার্য ডাকে। কিছু পত্র শুষ্ক ঝরে যায়
এজন্মে ধুলোর বিষাদ
গোপনে রেখেছি কিছু – তরঙ্গদিন।
মোহহীন। ভাসা ভাসা দৃষ্টিপ্রতিমায়।
শূদ্রক উপাধ্যায়
দীর্ঘস্থায়ী অসুখ
সমীকরণের মতো সমস্ত রাস্তাই আসলে এক দীর্ঘস্থায়ী অসুখ।
দেবদারুর মতো বেড়ে উঠতে গিয়ে হলুদ ছাউনির নিচে আমাদের
প্রাত্যহিক গতিবিধি ও প্রতিবিম্ব নির্দ্দিষ্ট ভরকেন্দ্রে সেতু তৈরি করে;
শর্তহীন অসুখের মতো বাড়ির ভেতর মেঘ জমা হয়, সাদা কালো মেঘ।
দেখি ঘরের মধ্যে এলোমেলো রাস্তা কাটা, প্রতিটা রাস্তার পাশে মানুষের
সমস্ত চরিত্রগুলি সরল রৈখিক নিয়মে দাঁড়িয়ে…
হয়ত ঢেউময় নদীর কোনো তল থাকে না, যতদূর নরম মাটি
ততদূর আঁচড় কাটে নির্ভুলভাবে যুগ যুগ ধরে, মাটির কোনো
অসুখ হয় না, এভবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে চলে যাবে জলের সাথে,
স্রোতের সাথে রাস্তা হয়ে…
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে মাঝে মাঝেই দেখি, জ্যামিতিক অধ্যায়ের
পৃষ্ঠা থেকে সমীকরণগুলি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা বানায় আবার মিশে যায়…
আমার মাথার পাশে পিথাগোরাস মৃদু হাসে, আমিও হাসি
সাথে সাথে মানুষের সমস্ত চরিত্রগুলিও ঘরময় হাসতে থাকে …
অত্যন্ত নিপুণভাবে কৌতূহল লুকিয়ে রাখে প্রতিটা রাস্তাই,
পা বাড়ালেই অসুখ
আলোড়িত শব্দের মতো আমাদের ঘিরে ধরে…
পৌলমী গুহ
কেন কোথাও যেতে পারিনি
ভেবেছিলাম জঠরের-জ্বালা’র মতো কিছু একটা লিখলেই
শ্রান্ত চোখ থেকে উপচানো অশ্রু,
নোনা বেড়া ঘিরে বেড়ে উঠবে না আর।
ততোটা কুলোয়নি মুঠোয়।
তাই গৌরচন্দ্রিকায় নিজেরও ইতিহাস গুঁজে দেওয়ার
তীব্র ইচ্ছে থামাই। এই শহরে ইতিহাস কারা খোঁজে?
এখানে জঠর-জ্বালার মতো শব্দ মানাচ্ছে না।
কিন্তু কেনই বা ইতিহাস বলবো?
আসলে সব বর্তমান। এই আমি, আমার বুকের ভেতরে
পাঁজরের পোড়া ছাই, এইসব মিলে বর্তমান।
একবার করে এগোচ্ছি,
পিছিয়েই যাচ্ছি বেশি, অথচ স্বীকার করছি না।
জন্মমুহূর্ত
মায়ের চিৎকার থামিয়ে নিজের যন্ত্রণা বোঝাতে পারলে
এই সামান্য ধুলো-বালি অন্ধকার হজম হবে না?
আলবত হবে, হবে বলেই আসা।
হবে বলেই অনায়াসে ভেঙে যাওয়ার গল্প
একটি সুদৃশ্য কলমে বারবার লিখে ফেলি।
নীচে অবশ্য স্বাক্ষরের জায়গায় চাপ চাপ রক্ত লেগে
থাকে,থাক!
ভালোবাসা
কতোদিন বাড়ি ফেরা হয়নি।
কে জানে, তুলসীর টবে কতোটা শ্যাওলা?
উঠোনে ছেঁড়া পাতা গেল শীতে,
আমার ধুলোপড়া কবিতার খাতা।
সব রেখে তোমার কাছে এসে দেখি,
তুমিও নতুন ভাড়াটের হাতে
আমার মৃত্যু-পরোয়ানায় সই নিচ্ছো।
শুভম চক্রবর্তী
ছায়া পড়ে
অন্য কোনো দিক থেকে হাওয়া আসছে। শিকুলি পাকিয়ে আছে খড়ের ভেতরে। এ সময় ওম নিতে গিয়ে পাহাড়তলির গ্রামে দাঁতউঁচু আজাজুল মিঞা মিলেমিশে গেল ওই হাওয়ারই আগুনে। দেখে দেখে পা ফেলি তবু আঁচ লাগে। কৃষকের উদ্বন্ধন ছায়া ফেলে মনের অতলে। তাতে জল টলটল করে, তন্নতন্ন ক’রে খুঁজি ছেঁড়া রজ্জু, উঁকি মারা জিভ। কাঁধে পিঠে নিরাকার রাষ্ট্রকল্প আঁচড়ের দাগ। পরাগ মূলত আছে গাছে গাছে এবং মিলন। মরা আজাজুল কেন ফেলেছে নিকষ কালো অপর মননে।
হিন্দোল ভট্টাচার্য
অবলোকিতেশ্বর
লিখেছি তোমাকে, ভাসা-ভাসা। জন্ম-মৃত্যু কিছুই না জেনে যেমন মানুষ বড় হয়। বাঁচে।
ভালবাসার দিকে তাকিয়ে থাকে আজীবন। লেখে দস্তাবেজ।
তার পর ঝাপসা চোখে দেখে যায় বিছানার পাশে সাজানো কমলালেবু, আপেল, আধ গেলাস আয়ু।
তেমন লিখিনি আমি, তোমায়, যেভাবে, রাস্তায় পড়ে থাকে বেওয়ারিশ পাগল।
একটি জীবিত গান মুখে মুখে ঘোরে, যার ভিটেমাটি নেই। লোকে বলে, জারজ সন্তান।
চমৎকার গোছানো একটি সংখ্যা হয়েছে।