আফগানিস্তান — কী হচ্ছেটা কী
নীলাঞ্জন হাজরা
কাবুলসহ প্রায় পুরো আফগানিস্তান দখল করেছে তালেবান। কুড়ি বছর সম্পূর্ণ যুদ্ধ চালিয়ে মার্কিন ও নেটো সেনা ফিরে যাচ্ছে। কী ঘটল এত কাল? না-জানা-অর্ধসত্য, জেনে-ছড়ান-অর্ধসত্য, মিথ্যে, গুজব এ সবের মধ্যে থেকে ঘটনাক্রম বোঝার চেষ্টা।
মুখখোলা
ভাবিনি আফগানিস্তান নিয়ে লিখব। কিন্তু গত এক সপ্তাহে (এ লেখা ২১-২২ অগাস্ট লিখছি) সে দেশ নিয়ে মিথ্যে, না-জানা-অর্ধসত্য, ইচ্ছে-করে-ছড়ান-অর্ধসত্য আর গুজব মিলিয়ে যে বিচিত্র, প্রায় আজগুবি, প্রচার-ঝড় চলেছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে, তা শুনতে-শুনতে দেখতে-দেখতে মনে হল যাঁরা সত্যিই আগ্রহী তাঁদের জন্য অন্তত আমার জ্ঞানবুদ্ধিমত কিছু পুরনো, কিছু নতুন অপ্রচারিত তথ্যের ইঙ্গিত রেখে যাই, যাতে পরিস্থিতিটাকে খানিকটা তার প্রকৃত প্রেক্ষিতে দেখা যায়। মার্কিন বিদেশনীতিতে আমার বিশেষ তালিম এ ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা কাজে দেবে।
ভবিষ্যৎবাণী অসম্ভব
আগামী দিনে আফগানিস্তানে কী হবে তা নিয়ে আমার কোনও ধারণা নেই। নেই এই কারণেই যে, এ মুহূর্তে সেখানে কী ঘটছে তা নিয়ে আমার কাছে প্রায় কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। আমার ধারণা কারুর কাছেই এমন তথ্য নেই যা থেকে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া যেতে পারে। কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সেনাপ্রধানের কাছেও নেই। সাংবাদিকদের অধিকাংশই যখন এই হবে সেই হবে বলে গলা ফাটাচ্ছেন, দেখে ভালো লাগল তখনই ২০ অগাস্টের ভাষণে দুনিয়ার সব থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাবান পদে আসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক ভাষণে স্পষ্ট বলে দিলেন — ‘I cannot promise what the final outcome will be, or that it will be without the risk of loss’ (পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক ভাষণটির লিঙ্ক দিয়ে লেখাটা শেষ করেছি)। তিনি এটুকুও জোর দিয়ে বলতে পারছেন না সব মার্কিন নাগরিককে আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে বার করে আনা সম্ভব হবে কি না। তা হলেই বুঝুন। তবে আমরা যারা সংবাদমাধ্যম-নির্ভর তাদের থেকে তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই অনন্তগুণ বেশি তথ্য আছে— তবু পুরোটা নেই। থাকতে পারে না। কাজেই এ লেখায় কোনও জ্ঞানগম্ভীর ভবিষ্যৎবাণী থাকবে না।
থাকবে মূলত যুদ্ধের প্রেক্ষিত ও তার পরিণতির কিছু ঝলক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (নেটো)-র চালান আফগান যুদ্ধ এক নজরে
যুদ্ধ শুরু: ৭ অক্টোবর, ২০০১
যুদ্ধে মৃত: মোট: ১ লক্ষ ৫৭ হাজার মানুষ।
(আফগান সরকারি সেনা: ৬৪১২৪। নিরস্ত্র আফগান সাধারণ মানুষ: ৪৩০৭৪। তালেবান যোদ্ধা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর যোদ্ধা: ৪২১০০। মার্কিন কন্ট্র্যাকটর: ৩৮১৪। মার্কিন সেনাকর্মী: ২৩০০। নেটো ও জোটের সেনাকর্মী ১১৪৫। আফগানিস্তানে কর্মরত সামাজিক নানা প্রকল্পের কর্মী: ৪২৪। সাংবাদিক: ৬৭। * সব হিসেব নভেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত ও আনুমানিক। সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, মার্কিন বিদেশ দপ্তর, ‘কস্ট্স অফ ওয়ার প্রজেক্ট’, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রপুঞ্জ, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট্স)
যুদ্ধের মোট আর্থিক খরচ: ১০ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার (সূত্র: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন)।
উল্লেখ্য: এটা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ। তালেবান ও অন্যান্য গোষ্ঠীর খরচের হিসেব পাইনি।
ভূরাজনৈতিক অবস্থান
ভূগোল
শুরু করি।
অধিকাংশ মানুষ চোখ বুজলে আফগানিস্তানের মানচিত্রটা মনের মধ্যে দেখতে পাবেন না। আফাগানিস্তানের ‘আ’ বলার আগে সেটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। খুব খুঁটিয়ে। আশ্চর্য এই দেশটার সর্বনাশের গোড়া সেখানেই। মানচিত্রে। আসুন দেখি—
যদি লেখাটা মোবাইলে পড়ছেন ল্যান্ডস্কেপ মোডে দেখুন ম্যাপটা — আড়াআড়ি ঘুরিয়ে।
প্রতিবেশি দেশগুলি কী কী? উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজ়বেকিস্তান আর তাজিকিস্তান। তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে। নিচে সবুজ দাগ। তারপর উত্তরপূর্বে দেখুন একটা লাল গোল দাগের মধ্যে পাখির দেহের মতো একটা সাদা অঞ্চল— ওটা ওয়াখান দেহলিজ়— দেহলিজ় মানে চৌকাঠ। তারপরে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল যার পশ্চিমের খানিকটা পাকিস্তানের দখলে। তারপরে পুরো পূর্ব ও দক্ষিণ জুড়ে পাকিস্তান। তারপরে পুরো পশ্চিম জুড়ে ইরান।
এর মানে কী?
দুশানবের তলায় সবুজ দাগ, কারণ সেখানে রয়েছে বিশাল রুশ সামরিক ঘাঁটি। হালফিলের নয়, ১৯৪১ সাল থেকে। যা হালফিলের তা হল— দুশানবের সামরিক ঘাঁটিকে আরও অনেক শক্তিশালী করে তুলবে রাশিয়া শীঘ্রই, জানাচ্ছে রয়টার্স, গত ২১ জুলাই। দুশানবে থেকে আফগানিস্তানের উত্তরসীমান্তের কাছে বড় শহর মজ়ার-এ-শরিফের দূরত্ব কম-বেশি মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে মালদার দূরত্বের থেকে একটু বেশি। ওই দুশানবে থেকে নাক বরাবর উত্তরে গেলেই কাজ়াখস্তান পার করে রাশিয়া। রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। তাজিকিস্তান কার্যত তার করদ রাজ্যের মতো।
এরপরে ওই ওয়াখান দেহলিজ়। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে এই দুরন্ত মানচিত্রটা দেখুন—
ভয়ঙ্কর সুন্দর। উত্তরে পামির পর্বতমালা, দক্ষিণে কারাকোরম পর্বতমালা। লম্বায় প্রায় ৩৫০ তিনশো কিলোমিটার— কলকাতা থেকে মালদা। আফগানিস্তানের দিকে যেখানে পাখির ল্যাজ, সেখানটা চওড়ায় ১৩ কিলোমিটার। আর তার উল্টোদিকে, মানে পূর্বে যেখানে ওয়াখান চৌকাঠ শেষ, সেখানটা ৬৫ কিলোমিটার। মাঝখানে গড়গড়ান ময়দান, যার পূর্ব দিকের উচ্চতা ১৬ হাজার ফুটের বেশি, পশ্চিম দিকের উচ্চতা প্রায় ১০ হাজার ফুট। প্রকৃতি এখানে যেমন অপরূপ সুন্দর তেমনই দারুণ রূক্ষ । একপাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে পাহাড়ী ওয়াখান নদী। যুগযুগ ধরে এই পথ ধরে হাজারে হাজারে খচ্চরের পিঠে মাল চড়িয়ে পশ্চিমে বদকশান অঞ্চল আর পূর্বে ইয়ারকন্দ অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এই ইয়ারকন্দ আসলে আজকের চিনের শিনজিয়াং-উইঘুর স্বশাসিত অঞ্চলে। যে অঞ্চলে আনুমানিক ১ কোটি ২০ লক্ষ উইঘুর গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস, যাঁদের অধিকাংশই মুসলমান। এই উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে একটা অস্থিরতা রয়েছে। শোনা যায় তা বিগত এক দশকে বেড়েছে। পশ্চিমী দেশগুলোর অভিযোগ, সেই অস্থিরতা দমনে কম সে কম ১০ লক্ষ উইঘুর মুসলমানকে বিভিন্ন শিবিরে আটক রেখেছে চিন। তাঁদের জোর করে ‘সভ্য’ করার চেষ্টা চলছে। সরকারি ইস্কুল-কলেজে ভর্তি করা হচ্ছে। কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। বাইরে থেকে মূল ধারার চিনাদের এনে বসবাস করান হচ্ছে হাজারে হাজারে। চিন বলছে, সব বকোয়াস। এদের মধ্যে অনেকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত। তাদের শায়েস্তা করা হচ্ছে কেবল। এই উইঘুর অঞ্চল দিয়ে ওয়াখান চৌকাঠ পার করেই চিনা সেনা হনহনিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়তে পারে যেদিন খুশি। চিন পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। আপাতত চিনের দিকের ওয়াখানে বাইরের লোকের যাতায়াত কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। ভেড়া চরাতে যাওয়া যায়। আর সাপ্তাহিক হাটে মালপত্তর নিয়ে স্থানীয়রা যান।
এরপরে ভারতীয় মানচিত্রের জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল। তার পশ্চিম দিকটা পাকিস্তানের দখলে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। কাশ্মীর অশান্ত। সে অঞ্চল নিয়েই সরাসরি ভারত-পাকিস্তান দু-দুটো পুরোমাত্রার যুদ্ধ চালিয়েছে— ১৯৪৭-৪৮-এ, আবার ১৯৬৫-তে। সেই থেকে ছায়াযুদ্ধ অব্যহত। পাকিস্তানের সেনা ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর কর্তারা ধারাবাহিক ভাবে মনে করে এসেছেন কাশ্মীর পুরোপুরি ছিনিয়ে নিতেই হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আর কোনও কথাই চলতে পারে না ভারতের সঙ্গে। ভারতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই অবস্থানে অটল যে, কাশ্মীর সম্পূর্ণ ভারতের, এ নিয়ে কোনও কথা হবে না — ‘নননেগোশিয়েবল’। এরই মধ্যে অনেক কাশ্মীরী আছেন, যাঁদের বিশ্বাস উভয় দেশের কোনওটারই অংশ নয় কাশ্মীর, কাশ্মীর চিরকাল স্বাধীন রাজ্য ছিল, তাই হওয়া উচিত। পাকিস্তান ও ভারত দুটিই পারমাণবিক অস্ত্রে বলীয়ান। আফগান-পাক সীমান্ত প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার, সম্পূর্ণ খোলা, যাতায়াত প্রায় অবাধ।
আর আফগানিস্তানের সারা পশ্চিম জুড়ে ইরান। ১৯৭৯ সাল থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র। পারমাণবিক অস্ত্র না থাকলেও, সেনা খুবই উন্নত। তালেবান সেনার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। কোনও স্থলভূমি অঞ্চল নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে ইরানের কোনও ঝগড়া-ঝগড়ি নেই। জল নিয়ে আছে বহু কাল। হেলমুন্দ নদী আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে ঢুকেছে ইরানের পূর্বাঞ্চলে। সেখানের চাষাবাদে জল চাই। আফগানিস্তান দেয় না ঠিকমত। ঝামেলা লেগে থাকে। আর ইরান মূলত শিয়া দেশ। আফগানরা মূলত সুন্নি। তালেবানরা কট্টর সুন্নি। আফগানিস্তানে বেশ কয়েক লক্ষ হাজ়ারা শিয়া মানুষের বাস। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাজত্বের সময় তালেবানরা তাঁদের ওপর ভীষণ অত্যাচার চালিয়েছিল। তাই সেবার তালেবানদের মার্কিন সেনা ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় ইরান কিছুটা সহায়তাই করেছিল।
সার কথা— চারটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ — চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ভারত ক্রমাগত নিশ্বাস ফেলছে এমন একটা দেশের ঘাড়ে যার কার্যত কোনও বিমানবাহিনী পর্যন্ত নেই। ১৫ অগাস্ট ক্ষমতা দখল-করা তালেবানরা যুদ্ধ করে হয় পাকিস্তানের দেওয়া কিছু অস্ত্রশস্ত্রে নয় মার্কিনিরা আফগান সরকারকে যে অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল তা লুট করে।
ইতিহাস এক নজরে
এই গেল ভূ। এবার রাজনীতি। সেটা বুঝতে হলে একটু পিছনে তাকিয়ে ইতিহাসের মাইলফলকগুলো জানতেই হবে। আমাদের কাহিনি ব্রিটিশ জমানা থেকে শুরু করলেই হবে—
১৯ শতক— ব্রিটিশরা বার বার আফগানিস্তান পাকাপাকি দখলের চেষ্টা করেছে। কিছুদিন লিটির বিটির করে কাবুল দখল রেখে ঠেঙানি খেয়ে ফিরে এসেছে ভারতে। ১৮৩৮-৪২, ১৮৭৮-৮০।
১৮৯০: আব্দল রহমান আফগান আমিরশাহির আমিরের তখ্ত দখল করলেন। ভারী পিছিয়ে পড়েছে দেশটা। পশ্চিমি শিক্ষা-প্রযুক্তি আদব-কায়দা আমদানি শুরু হল।
১৮৯৩: ব্রিটিশ আর রাশিয়া নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নিয়ে ডুর্যান্ড লাইন বলে একটা আন্তর্জাতিক সীমারেখা দেওয়া মানচিত্র তৈয়ার করে আফগানিস্তানকে বলল, বাপু তুমি আমাদের মাঝখানে থাক, যাতে আমাদের মধ্যে লড়াই না বাঁধে।
১৯০১: আব্দল রহমানের পুত্র হাবিবুল্লা খান আমির হয়ে দেশের পশ্চিমীকরণের পথে আরও চার কদম এগিয়ে গেলেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে খুব দহরম। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে ব্রিটিশ-বিরোধী হাওয়া জোর বইতে শুরু করেছে। এমনকী তৃতীয় পুত্র আমনউল্লা খানও ব্রিটিশদের পক্ষে নয়।
১৯১৯: হাবিবুল্লা খুন। আমানউল্লা খান ক্ষমতা দখল করে আমির হলেন। হটাও ব্রিটিশ প্রভাব। তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ শুরু। ফের মোক্ষম ঠ্যাঙানি খেল ব্রিটিশ রাজ। এদিকে ততদিন বিপুল রুশ সাম্রাজ্যে বলশেভিক বিপ্লব হয়ে গিয়েছে।
১৯২১: আমানউল্লা খান সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ফেললেন। সোভিয়েত শাসনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম হাতে গোণা ক’টি দেশের মধ্যে একটি ছিল আফগানিস্তান। সেই বন্ধুত্ব গভীর হতে হতে পাকাপাকি ভাবে সোভিয়েত ব্লকে ঢুকে পড়ল আফগানিস্তান।
১৯২৬: আমানউল্লা খান আফগানিস্তানকে আমিরশাহি থেকে রাজতন্ত্র করে ফেললেন। নিজেই রাজা। আফগানিস্তানে সেই মধ্যযুগ থেকে চলে আসা ‘লোয়া জির্গা’, সমস্ত দেশজুড়ে স্বীকৃত বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বরিষ্ঠদের নিয়ে গঠিত সভার ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। অমনি ধুন্ধুমার।
১৯২৯: আমানউল্লা খান দেশ ছেড়ে ভাগলওয়া।
১৯৩৩: জ়াহির শাহ হলেন রাজা। দেশে শান্তি ফিরল। বিরাজ করল পরের চল্লিশ বছর।
১৯৩৪: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম আফগানিস্তানকে সার্বভৌম দেশের স্বীকৃতি দিল।
১৯৪৭: ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন। আফগানিস্তানের গোটা পূর্ব জুড়ে পাকিস্তান।
১৯৫৩: জ়াহির শাহের প্রধানমন্ত্রী ও তুতো ভাই জেনারেল মহম্মদ দাউদ খান সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করলেন। মহিলারা অবাধে বাইরে আসার স্বাধীনতা পেলেন।
১৯৫৭: মহিলাদের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দেওয়া হল।
১৯৬৪: জ়াহির শাহ বললেন, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চালু হোক। লোয়া জির্গার বরিষ্ঠরা বললেন তাই হোক। তৈরি হল ‘ওয়ালেসি জির্গা’, লোকসভা— ২১৬ জন নির্বাচিত সদস্য। আর ‘মশরানো জির্গা’, বরিষ্ঠসভা— ৮৪ সদস্য, একতৃতীয়াংশ নির্বাচিত, একতৃতীয়াংশ রাজপ্রতিনিধি, একতৃতীয়াংশ নবগঠিত প্রদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত।
১৯৬৫: গোপনে আফগান কমিউনিস্ট পার্টির পত্তন করলেন বারবাক কারমাল ও নূর মহম্মদ তরকি।
১৯৭৩: মহম্মদ দাউদ খান আফগানিস্তানের শেষ রাজা মহম্মদ জ়াহির শাহকে তাড়িয়ে দিলেন বামপন্থীদের সমর্থনে। ইসলামী মতাবলম্বিদের বিরুদ্ধে অত্যাচার শুরু হল। অনেককেই দেশ থেকে তাড়ান হল। ১৯৬৪-র সংবিধান বাতিল করে প্রতিষ্ঠিত হল আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র। নিজে হলেন তার প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭৩-১৯৭৮: মহম্মদ দাউদ খান সোভিয়েত ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে একের পর এক পদক্ষেপ করলেন। ১৯৭৭ সালে ‘লোয়া জির্গা’ নানা সংশোধনের পর তাঁর নয়া সংবিধানে সিলমোহর দিল।
২৭ এপ্রিল, ১৯৭৮: মহম্মদ দাউদ খান ও তার পরিবারকে হত্যা করে আফগান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। কমিউনিস্ট নূর মহম্মদ তরকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। বারবাক কামাল ও হাফিজ়উল্লা আমিন উপপ্রধানমন্ত্রী। মহিলাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ডিক্রি জারি হল। ভূমি সংস্কারের ডিক্রি জারি হল। আফগান আদিবাসী সমাজ ভেঙে খান খান করার চেষ্টা। রাজনৈতিক বিরোধীদের ব্যাপক ধরপাকড়। এটি পরিচিত ‘সয়ুর ইনকিলাব’ বা ‘এপ্রিল বিপ্লব’। চারপাশে ভয়ঙ্কর আশান্তি ও অসন্তোষ। বিদ্রোহ প্রায় দেশ জুড়ে।
১৯৭৯: হাফিজ়উল্লা আমিন প্রধানমন্ত্রী হলেন। বিদ্রোহ আরও বাড়ল। আফগান সেনা স্রেফ চম্পট দিল। আমিনকে সাহায্য করতে ব্যাপক সেনা পাঠাল সোভিয়েত রাশিয়া। আমিন নূর মহম্মদ তরকিকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৯: সোভিয়েত রাশিয়ার সেনা আফগানিস্তান দখল করে নিল। হাফিজ়উল্লা আমিনকে হত্যা করে বারবাক কামালকে প্রধানমন্ত্রী করা হল।
১৯৮০-র দশক: মূলত পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সৌদি আরব এবং ইউরোপের নানা দেশের অর্থে ও সামরিক সাহায্যে একটা গোষ্ঠী তৈরি হল, যাঁরা শীঘ্রই পরিচিত হলেন ‘মুজাহিদিন’ নামে— যাঁরা জিহাদ করছেন। এই ‘জিহাদ’ চলতে লাগল প্রধানত পাকিস্তান সেনা ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর তত্বাবধানে, মার্কিন অর্থ ও সামরিক সাহায্যে। দুনিয়া থেকে দলে দলে মুসলমানকে এই লড়াইয়ে সামিল করা হতে লাগল। সৌদি আরব থেকে চলে এলেন বিপুল বিত্তবান যুবক ওসামা বিন লাদেন।
১৯৮৭: আফগান গোপন পুলিশের প্রাক্তন প্রধান মহম্মদ নাজিবুল্লাকে প্রেসিডেন্ট করা হল। ততদিনে সোভিয়েত রাশিয়ার তত্বাবধানে ১৯৭৮ থেকে তৈরি হওয়া আফগান সেনার প্রায় সবাই চম্পট দিয়েছে। নাজিবুল্লা বললেন, ভাই, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, চলো সবাই মিলে আবার শান্তি ফেরাই। মুজাহিদিন ও পাকিস্তান বলল, কোনও চান্স নেই। ভাগো ইঁহাসে।
১৯৯১: সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন
১৯৯২: মহম্মদ নাজিবুল্লাকে তাড়িয়ে মুজাহিদিনরা কাবুল দখল করে নিলেন। বুরহানউদ্দিন রব্বানি প্রেসিডেন্ট হলেন। দেশজুড়ে অরাজকতা চলতেই লাগল।
১৯৯৪: এক নয়া যুদ্ধবাজ গোষ্ঠীর নাম শোনা গেল— তালেবান। ‘ইসলামি তালিম নেওয়া ছাত্রগোষ্ঠী’। দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার অঞ্চল থেকে এঁদের উত্থান। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন-পাকিস্তানি অর্থ-অস্ত্র-সাহায্যে চালান জেহাদের ঝলমলে স্টার মোল্লা উমর এঁদের গুরু। এই তালেবান পাস্তুন আদিবাসী গোষ্ঠীর। তারা বললেন, কী? তাজিক গোষ্ঠীর রব্বানি করবে কাবুলে রাজত্ব? কভি নেহি। শুরু হল আর এক যুদ্ধ।
১৯৯৬: কাবুল দখল নিলেন তালেবান। বুরহানউদ্দিন রাব্বানি কাবুল ছেড়ে পালিয়ে নির্বাসিত আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট হয়ে রইলেন। তাজিক গোষ্ঠীর আরেক নেতা মহম্মদ শাহ মাসুদ ‘জভা মুত্তহিদা ইসলামি মিল্লি বরাই নজাত-ই-আফগানিস্তান’ (আফগানিস্তানের মুক্তির উদ্দেশ্যে গঠিত ইসলামি জোট) তৈয়ার করে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখলেন উত্তরাঞ্চলে। ২৬ সেপ্টেম্বর তালেবান মহম্মদ নাজিবুল্লাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাড়ি থেকে বার করে হত্যা করল।
১৯৯৭ – ২০০১: আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরশাহি চালাতে থাকল তালেবান।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসবাদী হামলা।
অক্টোবর, ২০০১: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করল এই হামলার পিছনে আছে আল কায়েদা নামের এক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, যার প্রধান ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে আছেন আফগানিস্তানে, তাঁকে মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হোক। অস্বীকার করে তালেবান। মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা শুরু করল ব্যাপক বোমারু বিমান হানা।
২২ ডিসেম্বর, ২০০১: পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা পাস্তুন নেতা হামিদ কারজ়াইকে ডেকে এনে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট করে দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২০০১ – ২০০৬: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেটো দোসরেরা কার্যত সারা আফগানিস্তানের সামরিক দখল নিল। ২০২১ পর্যন্ত এই দখল কায়েম থাকে।
২০০৫: বিদেশী সামরিক তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হামিদ কারজ়াই জয়ী ঘোষিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন।
২০১১: পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে গোপন হামলা চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করল মার্কিন সেনা।
২০১৫: প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা ঘোষণা করলেন আফগানিস্তান থেকে ২০১৭-র মধ্যে সব মার্কিন সেনা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার সময় আফগানিস্তানে ৫৫০০-র বেশি মার্কিন সেনা থেকে গেল।
২০১৯: বিভিন্ন জায়গায় তালেবানের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায়।
এপ্রিল, ২০২১: প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা তুলে নেওয়া হবেই।
১৫ অগাস্ট, ২০২১: কাবুল দখল নিল তালেবান।
ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচ
আফগানিস্তানের ভূগোল বুঝতে গিয়ে আমরা দেখেছিলাম চার পারমাণবিক শক্তিধর দেশ— চিন, পাকিস্তান, রাশিয়া, ভারত— এবং শক্তিশালী ইরান আফগানিস্তানের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। কেন নিশ্বাস ফেলছে? একে একে দেখি।
পাকিস্তান
এই চারের মধ্যে সব থেকে বিষাক্ত নিশ্বাস নিঃসন্দেহে পাকিস্তান সেনা ও আইএসআই-এর। এই দুই প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে পাকিস্তানের মানুষের গলা টিপে রেখেছে ১৯৪৮ সালে মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ মারা যাওয়ার পর থেকেই। এদের কর্তারা পাকিস্তানের বিপুল চাষাবাদযোগ্য জমির মালিক— লক্ষ লক্ষ একর। তাঁরা নিজেরা পাঁচতারা জীবন যাপন করেন, নিজেরা বিদেশে পড়াশুনা-করা ও পরিবারকেও তাই করান, সব থেকে দামি মদ্যপান করেন, সব থেকে দামি গাড়ি চড়েন, আলিশান প্রাসাদে থাকেন ব্যক্তিগত প্রহরীদের ঘেরাটোপের মধ্যে। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, প্রখর বুদ্ধিধর। এঁদের নিজেদের পরিবারের মহিলারা যাবতীয় স্বাধীনতা ভোগ করেন। অনেকেই খুবই উচ্চশিক্ষিত। এঁরাই পাকিস্তান দেশটাকে চালান, যদিও ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পরভেজ় মুশররফের সেনা শাসনের পরে টানা গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম আছে— যদিও সেনা ও আইএসআই-এর দীর্ঘ ছায়ায়। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাক সেনার নয়নের মণি।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর আফগান সরকার সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তাকে স্বীকার করতে যে গড়িমসি করেছিল, তাতে এই সেনা কর্তাদের আঁতে খুব লেগেছিল। কিন্তু আসল কারণ হল — ১৯৪৭ থেকে ২০০১ অবধি তো বটেই, আজও পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিবিরেরই দেশ বলা যায়। আর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া উবে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আফগানিস্তান ছিল সরাসরি সোভিয়েত শিবিরের দেশ। ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিনকালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত-বিরোধী ইসলামী আবেগকে উস্কে সশস্ত্র জঙ্গী তৈরি করা, তাঁদের অর্থ দেওয়া, তাঁদের পালাতে হলে আশ্রয় দেওয়া— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এই সব কাজ খুব পারদর্শিতার সঙ্গে করে এসেছে পাকিস্তানি সেনা ও আইএসআই। তা ছাড়া এলাকা দখল নিয়েও দু’ দেশের মধ্যে ক্রমাগত ঝগড়া লেগেই থেকেছে। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের ঘণিষ্ট তালেবান সরকারও বলে দিয়েছিল তাঁরা ডুরান্ড লাইন সীমা মানেন না।
যদিও ২০০০ সাল থেকে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়ে তা ক্রমাগত বেড়েছে। সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনের ইস্যুতে। দুনিয়ার অন্যান্য নানা অঞ্চলে বিশেষত বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে — যেমন কিউবার বিরুদ্ধে — সশস্ত্র লড়াইয়ে নিযুক্ত নানা গোষ্ঠীকে সরাসরি সমর্থন করলেও, মার্কিন সরকার পাকিস্তানি কর্তাদের খুব ধমকায় আফগানিস্তানে তালেবানকে সমর্থনের জন্য। ধমকাক। পাকিস্তানি সেনা ও আইএসআই কর্তারা বিলক্ষণ জানেন তাঁদের হাতে এক মোক্ষম জুজু আছে যা মার্কিন সরকার ও সেনাকে সামলে রাখবে— পারমাণবিক অস্ত্রের জুজু। সেটা এরকম— আমাদের সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেবেন স্যার, দিন। কিন্তু ভেবে দেখবেন পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে পড়ে পারমাণবিক অস্ত্রের ছিটেফোঁটাও যদি ইসলামি জঙ্গিদের হাতে চলে যায়, কী সব্বোনাশটাই না হতে পারে। তা ছাড়া, আজকাল পাকিস্তানেও ‘পাকিস্তানি তালেবান’ নামে এক গোষ্ঠী নাশকতামূলক হামলা চালায় মাঝেসাঝেই। কাজেই আফগানিস্তান তো যাবেই, আমরা দুর্বল হলে পাকিস্তানও চলে যেতে পারে তালেবানের হাতে। আমরা সবল থাকলে, আফগিন তালেবানকে সমঝে রাখতে পারব। এই জুজুতে ধারাবাহিক মার্কিন প্রশাসন কাবু।
১৫ অগাস্ট তালিবানের কাবুল দখলে পাকিস্তানি সেনা ও আইএসআই-এর মনে লাড্ডু ফুটছে তা সন্দেহাতীত। পাকিস্তান সেনা ও আইএসআই প্রথমে মুজাহিদিন ও পরে তালেবান এই দীর্ঘ বিনিয়োগের সুদ চাইবেন এবার। তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এবার আফগানিস্তান থেকেই কাশ্মীরে ঝামেলা বাড়ান যাবে। ইসলামের দোহাই দিয়ে জঙ্গি শিবির ফের তৈয়ার করা যাবে আরও বেশি সংখ্যায়। পরিবর্তে পাকিস্তান তালেবানি আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক মান্যতা ছাড়াও, সামরিক তালিম ও কিছু অর্থ ও পরিকাঠামোগত সাহায্য করতে পারে। এবং নিজেদের প্রায়-প্রভু-গোছের দোসর চিন সরকারকেও সাবধানে তালেবানকে মেনে নিতে প্রভাবিত করতে পারে।
এই অংশ নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। আমার খটকা, তালেবান এই সুদ কতটা দিতে রাজি হবে। এই খটকার একাধিক কারণ আছে। সে প্রসঙ্গে ফিরব। আপাতত দেখতে থাকি অন্যান্য দেশগুলোর আফগানিস্তানে কী ধান্দা।
ভারত
ভারতের স্বার্থ স্পষ্ট। কাশ্মীর। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাশ্মীর-নীতির মাথার ওপর মহাখাঁড়া আফগানিস্তানে তালেবান সরকার। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করে, স্বাধীনতার সময় থেকে চলে আসা সে অঞ্চলের মানুষের নানা বিশেষ অধিকার এক কলমের খোঁচায় গায়েব করে দিয়ে, কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙে দিয়ে, এতাবৎ নির্বাচনের কোনও সূচি ঘোষণা না করে, কাশ্মীরকে সেনাবলে ভারতের অন্তর্গত করে রাখার যে নীতি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তা কোনও অঞ্চলের মানুষের পছন্দ হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে হলে বাঙালিরাও খেপে লাল হতেন। কাশ্মীরীদের ‘আত্ম-পরিচয়-ভিত্তিক-সমাজবোধ’ ইতিহাসের প্রাচীন কাল থেকে। ব্রিটিশ আমলেও কাশ্মীর করদ রাজ্য ছিল। এই আত্মপরিচয়-ভিত্তিক-সমাজবোধকে বলা হয় কাশ্মীরিয়ৎ। আফগানদের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। তদুপরি, একদিকে দশকের পর দশক ধরে নিবিড় ভাবে মোতায়ন করা ভারতীয় সেনা-বিরোধী মানসিক মনোভাব অন্যদিকে পাকিস্তানের মদতে চলা নানা গোষ্ঠীর ক্রমাগত উসকানির ফলে কাশ্মীরের বহু মানুষের মধ্যেই একটা ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ বেশ ধারাল হয়ে উঠেছে বলেই আমার ধারণা। সেই ধারণায় কি তালেবান আরও শান দেবেন, বা দিতে পারবেন?
তেমন প্রচেষ্টাকে কুঁড়িতেই ছেঁটে ফেলাই আপাতত আফগানিস্তানে ভারতের প্রধান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হবে। চিন, রাশিয়া, ইরান (পাকিস্তানের কথা ছেড়েই দিলাম) বহু মাস, এমনকী বছর, আগে থেকে প্রকাশ্যেই তালেবান নেতৃত্বের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন নিজ নিজ দেশে ডেকে। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে খবর বেরিয়েছে। গোপনে আরও কী করেছে এই তিন দেশ জানিনা। ভারত, অন্তত প্রকাশ্যে, তালেবানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। কেন? জানি না, আমার হাতে তথ্য নেই। তালেবান আর যাই হন বোকা নন। তাঁরা এটা মনে রাখবেন বলেই আমার ধারণা। উল্টোদিকে, কাবুল দখল করেই তালেবান নেতৃত্ব বিবৃতি দিয়েছে— আমরা আশা করি ভারত আফগানিস্তানের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ অব্যহত রাখবে। চোখে পড়ার মতো কূটনৈতি ‘ফিনেস’।
সামরিক ভাবেও ভারতকে আরও অনেক বেশি সজাগ হতে হবে কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে ঢোকা সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায়। তালেবান শেষ পর্যন্ত কী করবেন বলা অসম্ভব। দ্বিতীয় কাজটা খুব কঠিন হয়ে উঠতে পারে প্রথমটায় ধ্যাড়ালে। ধ্যাড়ান দিয়েই শুরু করেছে মোদী সরকার।
এ ছাড়াও ভরতের শঙ্কার কারণ আছে। সেটা বুঝতে গেলে নিচের এই মানচিত্রটা দেখে নিলে সুবিধে হবে।
ওই লাল দাগটা এক মহামহাউদ্যোগ। গ্যাস পাইপলাইন। তুর্কমেনিস্তানের গালকিনিশ গ্যাসভূমি থেকে পাইপে গ্যাস পুরে দেওয়া হবে— ৩৩৩০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস প্রতি বছর— সেই গ্যাস তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান পার করে ভারতে ফজ়িলকা শহর পর্যন্ত চলে আসবে। আপনি জলের দরে সিলিন্ডার পেয়ে প্রাণ ভরে ঘন্টার পর ঘন্টা খাঁটি দমপুখ্ত রান্না করবেন। চার দেশের ইংরেজি নামের আদ্যক্ষর নিয়ে এ পাইপলাইনের ডাকনাম ‘তাপি’। দৈর্ঘ্য কম-বেশি ১৮৪০ কিলোমিটার। খরচ আনুমানিক ১০০০ কোটি ডলার। তুর্কমেনিস্তান এর মধ্যেই আফগান সীমান্ত পর্যন্ত পাইপ বসিয়ে ফেলেছে। এবার সে পাইপ বসাতে হবে আফগানিস্তানের পেট ফেঁড়ে, বিশেষ করে তালেবানের পীঠ কান্দাহার পার করে। তালেবান চটলে, তালেবান পাকিস্তানের কথায় উঠবোস করলে, তালেবান চিনকে বেশি ডরালেই কাম সারসে! খবরে প্রকাশ মার্কিন জমানায় ব্যাপারটার দিকে ভীষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল চিন। এবার?
চিন
ওয়াখান চৌকাঠের ওপরা যে অশান্ত উইঘুর মুসলমানদের বাস, আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল কি তাঁদের আরও অশান্ত করবে? আপাত দৃষ্টিতে মুশকিল। এ অঞ্চলের মানুষ খুব বেশি আফগানিস্তানে যাওয়ার সুযোগ পান না। স্থানীয় হাটে আফগানরা মাল নিয়ে আসে। ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে থাকে চিনা সেনা। তবু বিদ্রোহের বাতাস বড়ো গোলমেলে, কখন যে কী ভাবে ছড়ায় কেউ ঠাওর করতে পারে না। তাই কড়া নজর রাখবে চিন। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কারণ আছে।
আবার কষ্ট করে ম্যাপ দেখতে হবে—
এই মানচিত্রের ওপরে যে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরই) লেখা আছে সেটাকে বলা যায় বর্তমান চিনের বিদেশনীতির কেন্দ্রবিন্দু — সেন্টারপিস। খুব সরল ভাষায় সংক্ষেপে ব্যাপারটা এ রকম— মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া জুড়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগে যে অজস্র বাণিজ্যপথ ছিল সেগুলিকে আবার চালু করা। স্থলপথ ও জলপথ। ‘তাপি’ যদি মহামহাউদ্যোগ হয়ে থাকে, এ তার হাজার গুণ। রাস্তা ও রেলপথ তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে। পুরোদমে চলছে এই এতগুলো দেশের সঙ্গে নানা কিসিমের কূটনীতি ও অর্থনৈতিক দরকষাকষি। অধিকাংশ দেশই এর পক্ষে। লক্ষ্য করুন এই লাল-নীল আঁকিবুকি আফগানিস্তানকে এড়িয়ে গেছে। মার্কিন দখলের আফগানিস্তানে সেটা মুশকিল ছিল। এবার কী ওখানেও দাগ পড়বে?
চিনের চেষ্টা চলেছে জোর। ২০১৬ সালের অগাস্টে পশ্চিম চিন থেকে রওয়ানা হয়ে কাজ়াখস্তান, উজবেকিস্তানের মধ্যে দিয়ে ৭৩০০ কিলোমিটার পথ চোদ্দ দিনে পাড়ি দিয়ে প্রথম ট্রেন — মালগাড়ি — পৌঁছে গেছে আঘগান হায়রতন শহরে। বিআরআই বা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবোর) উদ্যোগে দোসর হওয়ার মৌ-তেও সই করেছে আফগানিস্তান। এটা যদি সফল হয়, এই বিপুল অঞ্চল ও ইওরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক ধমণীর অধিকর্তা হয়ে বসবে চিন। মার্কন যুক্তরাষ্ট্রের মুখ থমথম করছে। আর মুখ থমথমে ভারতের। ভারত ওবোরের অঙ্গ হতে অস্বীকার করেছে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনকে চিন কাজে লাগাতে পারবে কী?
রাশিয়া
রুশদের আফগানিস্তানে নজর দীর্ঘকালীন। গত কুড়ি বছর তাতে সমস্যা হয়েছে। তালেবান জমানায় কী হবে? একটা ভয় আছে— ধর্মীয় কট্টরপন্থা ছড়িয়ে পড়ার ভয়। একেবার ওপরের মানচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে অফগানিস্তান আর রাশিয়ার মাঝখানে রয়েছে কাজ়াখস্তান, কিরগিজ়স্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান। প্রত্যেকটা মুসলমান প্রধান দেশ। এদের থেকে অনেক দূরে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে ল্যাজের ডগায় চেচনিয়া। সেই চেচনিয়াও মুসলমান-প্রধান। সেখানেও স্বদেশী আত্মপরিচায়ের আবেগতাড়িত বিদ্রোহ দমনে ১৯৯৪-৯৫ এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে দু’ দুটো পুরমাত্রার ঘোষিত যুদ্ধ লড়তে হয়েছে রাশিয়াকে। গুঁড়িয়ে দিতে হয়েছে রাজধানী গ্রোজ়নি শহর। খোয়াতে হয়েছে রুশ সরকারি হিসেবে ছ’ হাজার সেনা। সে সাংঘাতিক হাত পোড়ান। মধ্য এশিয়ায় কোনও ক্রমে তার পুনরাবৃত্তি চান না ভ্লাদিমির পুতিন, যাঁর উত্থানই হয়েছিল চেচেনদের দমন করে। আর একটা সমস্যা নিয়েও চিন্তিত রাশিয়া, আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ পোস্ত চাষ শেষে বিবিধ নেশাসামগ্রী হয়ে মধ্য এশিয়া পার করে সহজেই ঢুকে পড়ে রাশিয়ায়। তালেবান আমলে কি তা আরও বাড়বে? কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না রাশিয়া।
আরও একটা ব্যাপার আছে। সেটা একটা হিসেব দিলেই পরিস্কার হবে। মধ্য এশিয়ার নানা দেশে মাটির তলা থেকে যে সোডার বোতলের মতো ভুসভুসিয়ে গ্যাস ওঠে সে সংক্রান্ত হিসেব। ২০১৮ সালে কাজ়াখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান আর কিরগিজ়স্তান থেকে মোট ৪৬৮০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস চালান গিয়েছিল চিনে, আর রাশিয়ায় গিয়েছিল ১৬১০ ঘনমিটার গ্যাস (সূত্র: অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজ)। গত এক দশকে ঘটেছে এই সাংঘাতিক রদবদল। এই গ্যাস আগে যেত উত্তরে এখন পূবমুখী বাতাস । চিনের ‘ওবোর’ প্রকল্পর সঙ্গে এই হিসেব খাপে খাপে বসালে বোঝা যায় মধ্য এশিয়ায় কী কাণ্ডটা ঘটাচ্ছে চিন। চিনের সঙ্গে সংঘাত পুতিনের বিদেশ নীতির বর্তমান লক্ষ্য নয়। কিন্তু নজরদারি তো রাখতেই হবে। মধ্য এশিয়ার এই অঞ্চলের ওপর রুশ দখল তো সেই রুশ সাম্রাজ্যের আমল থেকে। সোভিয়েত জমানায় তা আরও আঁটোসাঁটো হয়েছিল। ১৯৯১-এর পর ফের ঢিলে হয়ে গেছে বটে, কিন্তু রুশ রাষ্ট্র মোটেই ইতিহাস ভুলে মারেনি। সেখানে সীমান্তপারের নয়া তালেবান শাসন কী প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়েও কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না রাশিয়া। কাজেই দুশানবেতে তাই তো বিপুল ভাবে বাড়ছে রুশ সেনার উপস্থিতি।
বুঝলেন ব্যাপারটা! রুশ বিদেশমন্ত্রী সার্গেই লাভরভের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিরা
এবং তার থেকেও বড়ো কথা গত এক বছরে রাশিয়া অন্তত তিন বার তালেবান প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ করে আলোচনা করেছে। অগাস্টে এমনই এক আলোচনায় চিনা, মার্কিন প্রতিনিধি তো ছিলেনই, রাশিয়া পাকিস্তানকেও আমন্ত্রন করেছিল কিন্তু ভারতকে ডাকাই হয়নি।
ইরান
আফগানিস্তানে ইরানের নজরের কারণ তিনটে ছোটো অনুচ্ছেদ। এক, ইরানের সঙ্গে বিরাট সীমান্ত আফগানিস্তানের। তা পার করে হেলমুন্দ নদীর জলের ওপর ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চাষাবাদ নির্ভরশীল। আর তাই নিয়েই দুই দেশের ঝগড়া দীর্ঘকালীন। কিন্তু সে ঝগড়ার ফলে এখুনি জলে আগুন লাগবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
দুই, আফগানিস্তানের ঠিক মাঝখানে, একটু উত্তরপূর্ব ঘেঁষে, হাজ়ারজাত বা হাজ়ারেস্তান প্রদেশ। বর্তমানে এখানে হাজ়ারা নামের এক জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানেই সেই বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিদ্বয়। ভারী সঙ্গীতপ্রিয়, খোলামেলা এই গোষ্ঠীর মানুষের শিয়া মুসলমান। ১৯৯২ থেকে ২০০১-এর তালেবান শাসনে এঁদের এপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়েছিল তালেবান। এ প্রসঙ্গে আমরা ফিরব। আপাতত এইটুকুই যে ইরাকের মত, এখানের শিয়াদের বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইরানি ইসলামি সরকার। কাজেই এবারে তালেবান কী করে সে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে ইরান। এবং তালেবানের সঙ্গে আলোচনা অনেক আগেই শুরু করেছে ইরান।
তেহরানে তালেবান প্রতিনিধিরা
তিন, পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানে ইসলামি শাসকদের দীর্ঘকালীন সংঘাত। ইসলামি শাসন হওয়া সত্বেও, শরিয়া আইন লাগু করেও ইরান যে ১৯৭৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত মার্কিন-নেতৃত্বাধীন দুনিয়ার ভয়াবহ অবরোধের মুখে তুড়ি মেরে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে তা নিজে চোখে দেখে এসেছি। দেখে এসেছি ইরানে মহিলাদের ওপর নানা বিধি নিষেধ চাপিয়েও তাঁদের শিক্ষার এবং চাকুরির কী বিপুল আয়োজন করেছে ইরান সরকার। যদিও এ সবই হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীদের কড়া হাতে সমঝে রেখে। পাকিস্তানের শাসকরা এ সব কিছুই করেননি। দেশ যে তিমিরে সেই তিমিরেই। সাধারণভাবে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় চূড়ান্ত অন-ইসলামি সেনাকর্তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জিগির জিইয়ে রেখেছেন বরাবর। নিজেরা ভয়ঙ্কর দুর্নীতিপরায়ণ এক জটিল শাসনযন্ত্র কায়েম করে জাতীয় অর্থনীতির সব রস নিজেদের পানপাত্রে ঢেলেছেন। মার্কিন মদত আর সৌদি পেট্রোডলারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বরফট্টাই। তার একটি উদাহরণ ইসলামাবাদের ফয়জ়ল মসজিদ দেখে চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল। আর এই দুটি দেশেরই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইরানে ইসলামি শাসন খতম করা। কাজেই পাকিস্তানের আর অন্য চাল হয় কী করে! কথা হল, তালেবান কি পাকিস্তানের পুতুল হয়ে শিয়া ইরানেও ঝামেলা পাকাতে চেষ্টা করবে? সজাগ থাকবে ইরান।
এই হল মোটামুটি আফগান চাইনিজ চেকারের পাঁচ বিদেশী ঘুটির অবস্থান। এবার বুঝতে হবে আসল ঘুটিটিকে— তালেবান।
তালেবান
তালেব মানে ‘ছাত্র’, তালেবান, উচ্চারণ ভেদে তালিবান তার বহুবচন— ‘ছাত্ররা’। ইসলামি ছাত্র। কিন্তু তার বাইরে তাঁরা কারা? এটা বুঝতে এই অংশটায় আমি সরাসরি তরজমা করে দেব একটি অতি সম্মাননীয় গবেষণা-প্রতিষ্ঠান, ‘থিংকট্যাঙ্ক’-এ প্রকাশিত একটা লেখা থেকে— ‘কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তাদের অনেকেই যে মার্কিন সরকারের প্রাক্তন বড়কত্তা ছিলেন সে বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল। কিন্তু অনেক খুঁজেপেতে আমার মনে হয়েছে এখানে জিল দোররোনসোরো যে লেখা লিখেছেন তেমন সৎ লেখা আমি আর কোথাও পাইনি। কে এই জিল দোররোনসোরো? ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। সোবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। সারা জীবন কাজ করেছেন গৃহযুদ্ধ নিয়ে। আফগানিস্তান নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন ১৯৮৮ সাল থেকে। লেখাটার নাম ‘হু আর দ্য তালেবান’। প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর। প্রশ্নোত্তরের চলনে লেখা। ছোটো ছোটো কিছু কিছু জরুরি অংশ এ রকম।
‘প্রশ্ন: আমরা প্রায়ই শুনি ৯০ শতাংশ তালেবান ভাড়াটে। এটা কি ঠিক, যদি না হয় তা হলে লোকে তালেবান গোষ্ঠীতে যোগ দেয় কেন?
উত্তর: না। যে সব বিশ্লেষকরা বলেন তথাকথিত ‘‘১০ ডলারের তালেবান’’ দুভাগে বিভক্ত ৯০:১০ অনুপাতে — যাঁরা টাকার জন্য লড়েন : দায়বদ্ধ মূল যোদ্ধা, তাঁরা পার্টটাইম, অপেশাদার যোদ্ধা বলতে যে দায়বদ্ধতাহীন যোদ্ধা বোঝাচ্ছেন তা সত্য নয়।
যোদ্ধাদের অধিকাংশই টাকার জন্য তালেবান গোষ্ঠীতে যোগ দেন না। তাঁর যোগ দেন কারণ আফগান সরকার ন্যায়হীন, দূর্নীতিপরায়ণ, কিংবা স্রেফ অনুপস্থিত। তাঁরা এ কারণেও যোগ দেন যে মার্কিনিরা তাঁদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিংবা তাঁরা যা কিছুকে শ্রদ্ধেয় মনে করেন তার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। যুবাদের কাছে তালেবান গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া সম্মানের ব্যাপার।
তালেবান যোদ্ধাদের অর্থ দিতে পারেন, যেমন, যদি তাঁরা বিয়ে করতে চান। কিছু পার্ট-টাইম যোদ্ধা অর্থের জন্য যুদ্ধ করতে পারেন, তবে আমার অভিজ্ঞতায় তা উত্তরোত্তর বিরল হয়ে আসছে। আপনি যদি এমন কোনও অঞ্চলে থাকেন যা পুরোপুরি তালেবান দখলে, তা হলে তালেবান গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আপনার পরিবারের কোনও সদস্যের ওপর চাপ দেওয়া হতে পারে।
তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্বার্থে তাঁদের কিনে নেওয়া প্রসঙ্গে বলতে পারি, আমরা কোনও দিন তালেবানকে কিনে নিতে পারিনি। এটা কোনও দিন কার্যকর হয়নি। আপনি তাঁদের অর্থ দিতেই পারেন, তার মানে এই নয় যে আপনি আন্দোলনটা ভেঙে দিতে পারবেন। কিংবা কৌশলগত ভাবে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন। তাঁরা আপনার অর্থ নিয়ে নেবেন, কারণ সেই মুহূর্তে তাঁদের সেটা দরকার, কিন্তু তালেবানকে কিনে নেওয়া কোনও বাস্তবানুগ বিকল্প হতে পারে না, কারণ অর্থ তাঁদের প্রধান লক্ষ্য নয়।…
তাই তালেবানকে বিভাজিত করা কঠিন। জেহাদের ধারণাটা খুব প্রবল।’
‘প্রশ্ন: তালেবান কী চান?
উত্তর: আন্তর্জাতিক জোটকে তাড়াতে এবং আফগানিস্তান ইসলমি আমিরশাহির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, যার সমাজ হবে শরিয়া-নির্ভর।’
‘প্রশ্ন: তালেবান কি স্থানীয় মানুষ?
উত্তর: হ্যাঁ, অধিকাংশ তালেবান যোদ্ধা স্থানীয়, পাশ্তুন-প্রধান অঞ্চলে তাঁরা সাধারণভাবে স্বীকৃত। সাধারণ ভাবে একটা বোঝাপড়া আছে, আপনি ওঁদের সঙ্গে ঝামেলা না করলে, ওঁরা আপনার ঘরে ঢুকবেন না। তাঁরা বিচারপতি নিয়োগ করেন ও শরিয়া-মোতাবেক বিচারের ব্যবস্থা করেন। মানুষ আফিম চাষ করলে তাঁরা হস্তক্ষেপ করেন না, যদিও তাঁরা কর আদায় করেন। তালেবান কর খুব চড়া মানুষকে এমন অভিযোগ করতে আমি কখনও শুনিনি।
পাশ্তুন-প্রধান অঞ্চলে তাঁদের স্বীকৃতি আছে কারণ তাঁরা যা করছেন তার একটা মানে আছে। তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা বিদেশীদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালাচ্ছি,’’ অধিকাংশ পাশ্তুন সেটা বিশ্বাস করেন।’
‘প্রশ্ন: তালেবান কী কোনও আদর্শের প্রবক্তা (আইডিয়োলোগ)?
উত্তর: আফগানদের অধিকাংশই নিরক্ষর। আমরা রাজনৈতিক শিক্ষা বলতে যা বুঝি, তা তাঁদের অধিকাংশেরই নেই। কাজেই আধুনিক অর্থে তাঁরা ‘‘কোনও আদর্শের প্রবক্তা’’ নন, কিন্তু তাঁদের মূল্যবোধ আছে। পরম্পরাগত পাশ্তুন মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে— নারীর সম্মান রক্ষা, সংযত পোষাক, এবং অন্যান্য গোঁড়া ইসলামি আচার।
অধিকাংশ পশ্চিমি মানুষ মনে করেন তালেবানের খুব গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক চর্চা নেই, তার মানেই তাঁদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এই যোদ্ধারা মূলগত ভাবে কৃষক। তাঁদের অধিকাংশই নবীন। তাঁদের বিশ্ববীক্ষণ খুব জটিল নয়, কিন্তু তাঁদের অবশ্যই একটা বিশ্ববীক্ষা আছে। তার কাহিনিটা হল নৈতিকতা, ন্যায়, ধর্ম, এবং বিদেশী সেনার হাত থেকে মুক্তি। এই মূল্যবোধ গভীর। পাশ্তুনরা হয়তো সব গুছিয়ে বলতে পারেন না কিন্তু তাঁদের জীবনধারা এখনও পুরোমাত্রায় বর্তমান।’
‘প্রশ্ন: তালেবান কি এখন আগের থেকে কম আবেগপ্রবণ ভাবে ধর্মগুরুর বার্তা-নির্ভর (মেসিয়ানিক)? তাঁরা কি এখন আদৌ কিছুটা নরমপন্থী হয়েছেন?
উত্তর: কিছুটা, আমরা তালেবানের একটা বিশ্ববীক্ষা তৈরি করেছি। ঐতিহাসিক ভাবে তালেবান বিদেশী শক্তির বিরোধিতা করেননি। তাঁরা ছিলেন মূলত স্থানীয়, জাতীয় আন্দোলনে, পশ্চিমী দেশের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না, পশ্চিমীদের বিরুদ্ধে কোনও প্রকৃত ক্ষোভ ছিল না। তালিবানের জঙ্গীকরণ, বা আমি বলব আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে তাঁদের ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া ঘটে ১৯৯৮-এ, বিন লাদেন প্রশ্ন ওঠার পর এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের অবরোধের পর, যেটাকে তাঁরা অন্যায় মনে করেছিলেন। তাঁদের এই বিশ্বাস জন্মাল যে পশ্চিমীদেশগুলো আফগানিস্তানের শাসক হিসেবে তাঁদের কোনও দিন মেনে নেবে না। এর পর তাঁরা নিজেদে দৃষ্টিকোণ বদলে ফেললেন।
২০০১-২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁদের এও মনে হতে লাগল তাঁদেরকে মনুষ্যেতর প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, বিশেষ করে বন্দি হিসেবে যেভাবে তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। বিদেশীদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটাকে এটাই গভীর ভাবে বদলে দিল। তাঁদের সঙ্গে শত্রুপক্ষের মতো ব্যবহার করা হয়নি, কিছুটা সম্মান দিয়ে, তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল অপরাধীর (ক্রিমিনাল্স) মতো। এবং তাঁরা নিজেদের অপরাধী মনে করেন না। তাঁরা নিজেদের দেখেন মুজাহিদিন হিসেবে— মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
এখন তালেবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া (ডিল) করতে তৈরি, তবে একটাই শর্তে, মার্কিনিদের আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাঁরা শুধু এই একটা বিষয়ই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান, আমাদের চলে যাওয়ার সূচি।’
‘প্রশ্ন: তালেবান আল-কায়েদার থেকে পৃথক কোথায়?’
‘উত্তর: সব দিক দিয়ে। আল-কায়েদা যোদ্ধারা অধিকাংশই শহুরে, তাঁদের ধর্মীয় তালিম সামান্যই, এবং তাঁরা আন্তর্জাতিক জিহাদ চালান। তাঁদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক।
অন্যদিকে, তালেবান অধিকাংশই গ্রামের মানুষ, তাঁদের নেতাদের ধর্মীয় তালিম অনেক বেশি, এবং তাঁদের লক্ষ্য মূলত স্থানীয়। তাঁরা শুধু আফগানিস্তান ফিরে পেতে চান।’
এরপর আমি এইটুকুই যোগ করব যে, তালেবান ২০০১-এর পর ২০ বছরের যুদ্ধে, কাতারের দোহায় দফায় দফায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে, চিন, রাশিয়া, ইরানের সঙ্গে আলোচনায় কিছুই শেখেননি আন্তর্জাতিক বিদেশনীতি, কূটনীতি ও ভূরাজনীতির খেলা এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা কী শিখেছেন আমার জানার কোনও উপায় নেই। এই ভিডিওটা এ বিষয়ে কী বলে?
https://www.youtube.com/watch?v=nR2pSHSH6V4
এই যে তিনি চোস্ত ইংরেজি শিখেছেন, ওয়ার্ড্সওয়ার্থ পড়ার আগ্রহে নয় নিশ্চয়ই। তেমনই তাঁদের আন্তর্জাতিক ক্ষমতার অলিন্দের ভাষাও শিখতে হবে। ঠেকে এবং দেখে।
কয়েকটি নাম যা নিয়ে সংবাদমাধ্যম উত্তেজিত
হাক্কানি নেটওয়ার্ক: পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সক্রিয় সব থেকে বেশি তালিম পাওয়া জঙ্গি সংগঠন। স্থাপন করেন জালালউদ্দিন হাক্কানি। ১৯৭০-৮০-র দশকে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সদস্যদের গেরিলা যুদ্ধে সরাসরি তালিম দেয় সিআইএ এবং আইএসআই। জালালউদ্দিন হাক্কানি আফগানিস্তানকে সোভিয়েত আগ্রাসন-মুক্ত করার অন্যতম নায়ক। তিনি ১৯৯৬-২০০১ সালে তালেবান সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। এখন এই গোষ্ঠীর নেতা জালালউদ্দিনের পুত্র সিরাজ়ুদ্দিন। এই গোষ্ঠীটাই বর্তমান তালেবানে সব থেকে সক্রিয় সাবেকি ‘মুজাহিদিন’ গোষ্ঠী। পাকিস্তানের সেনা ও আইএসআই-এর কোলের ছেলে বলে পরিচিত, যদিও পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে।
নর্দার্ন অ্যালায়েন্স
প্রতিষ্ঠা করেন আর এক সোভিয়েত-বিরোধী তাজিক গোষ্ঠীর জঙ্গি নেতা আহমদ শাহ মাসুদ। ২০০১ সালে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৬-এ পাশ্তুন তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি ও তাঁর অনুগামীরা উত্তরপূর্ব আফগানিস্তানে ঘাঁটি তৈরি করে লড়াই চালাতে থাকেন। এখনও এঁরা তালেবান আধিপত্য মানেন না।
মিথ্যে, প্রপাগান্ডা না কিংবদন্তি?
এবার আমি কয়েকটা সাধারণ ধারণা নিয়ে আলোচনা করব।
১। তালেবান বর্বর। নির্ভর করে বর্বরতা আপনি কাকে বলবেন?
ক) তালেবান যে আফগানিস্তানে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শাসনে বিরোধীদের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার, তাঁদের হত্যা, দেশছাড়া করেছেন তা সন্দেহাতীত। এবার ইতিহাস থেকে কয়েকটা উদাহরণ নিই।
১৮৯০: আব্দল রহমান আফগান আমিরশাহির আমিরের তখ্ত দখল করলেন। ভারী পিছিয়ে পড়েছে দেশটা। পশ্চিমী শিক্ষা-প্রযুক্তি আদব-কায়দা আমদানি শুরু হল। ইনি পরিচিত আফগানিস্তানকে আধুনিক করার জন্য। ইনি ১৮৯৩ সালে হাজ়ারজাত বা হাজ়ারেস্তান প্রদেশ দখল করে ৬০ শতাংশ হাজ়ারাকে মুছে ফেলেন। ইনি তালেব ছিলেন না। কোনও সাংবাদিক, কলমচি এঁকে কখনও ‘বর্বর’ বলেননি।
২৭ এপ্রিল, ১৯৭৮: মহম্মদ দাউদ খান ও তাঁর গোটা পরিবারকে হত্যা করে আফগান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। কমিউনিস্ট নূর মহম্মদ তরকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এটা বামপন্থীদের প্রিয় আফগান সায়ুর বিপ্লব। রাজনৈতিক বিরোধীদের সপরিবার খতম তালেবান আমদানি করেনি।
১৫ অগাস্ট (তারিখটা কেমন ফিরে ফিরে আসছে তাই না?), ১৯৭৫ সালে আমরা বাঙালিরাও ক্ষমতা দখলের রদবদলে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান, হাতের কাছে পাওয়া তাঁর পরিবারের সব সদস্য এমনকী তাঁর বাড়ির কাজের লোকেদেরও গুলি করে করে হত্যা করেছিলাম।
এবার একটা ছবি।
মনে পড়ছে? মাই লাই। ভিয়েতনাম। ১৬ মার্চ, ১৯৬৮। ছবি রোনাল্ড এল হায়েবেরি। মার্কিন সেনাবাহিনী। ২০ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট, ১ ব্যাটেলিয়ন, কোম্পানি সি এবং ২৩ (আমেরিকা) ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, ১১ ব্রিগেড, ৩ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট, কোম্পানি বি-এর কিছু সেনা ৩৪৭ থেকে ৫০৪ জন নিরস্ত্র ভিয়েতনামীকে হত্যা করে। হতদের মধ্যে ছিলেন পুরুষ, নারী, শিশু ও দুধের শিশু (ইনফ্যান্ট)। কিছু মহিলাকে ও ১২ বছর বয়স পর্যন্ত কিছু শিশুকে মার্কিন সেনা যূথধর্ষণ করে, তাঁদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়।
বিচার হয়। ২৬ জন সেনার বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা রুজু হয়। একজনের শাস্তি হয়— লেফটান্যান্ট উইলিয়াম ক্যালি জুনিয়ার, সি কোম্পানির এক প্লেটুন লিডার। প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পরে তিনবছর গৃহবন্দী রেখে ছাড় দেওয়া হয়।
আমি তালেবানকে এ কাণ্ড বা এর ধারেকাছে কোনও কিছু করতে শুনিনি।
২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেটো দোসররা রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমতিক্রমে আফগানিস্তান আক্রমণ করে
এটা সব থেকে বড়ো অপপ্রচার। ৭ অক্টোবর, ২০০১ মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা আফগানিস্তানে বোমা বর্ষণ শুরু করার পর রাষ্ট্রপুঞ্জে দুই দেশের রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপুঞ্জকে পৃথক দুটি চিঠি দিয়ে জানায় ‘আত্মরক্ষার স্বার্থে’ এই আক্রমণ চালান হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘চার্টার’ অনুযায়ী এক দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করলে, আক্রান্ত দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের দ্বারস্থ হবে, এবং যতক্ষণ না রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ কোনও ব্যবস্থা নেয় ততক্ষণ ‘আত্মরক্ষা’ সুনিশ্চিত করতে আক্রান্ত দেশ পাল্টা হানা চালাতে পারে। এখানে ‘আত্মরক্ষা’ কথাটা জরুরি। এই শর্তে পাল্টা হামলার ছটি সুস্পষ্ট শর্ত আছে— ১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই সময়ে অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত ছিল, ২। সেই সশস্ত্র আক্রমণ চালাচ্ছিল আফগানিস্তান, ৩। সেই আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে সশস্ত্র পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না, ৪। নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিস্পত্তি করার মত কোনও সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পায়নি, ৫। আক্রান্ত দেশ আক্রমণ প্রতিহত করতে সঠিক ভাবে নিজের সেনা ব্যবহার করবে, ৬। যে ক্ষতি এড়ানোর জন্য পাল্টা আক্রমণ চালান হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলা চালাবে।
এই শর্তগুলি মানা হয়েছিল কি?
মার্কিন ন্যাশনাল লয়ার্স গিল্ড-এর সভাপতি মার্জরি কোহ্ন এ প্রসঙ্গে যে বিবৃতি দেন তার সরাসরি তরজমা: ‘[রাষ্ট্রপুঞ্জের] চার্টার অনুযায়ী একটি দেশ আর একটি দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সেনা ব্যবহার করতে পারে কেবল আত্মরক্ষার স্বার্থে অথবা নিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদন করলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালানর আগে এদুটির কোনও শর্তই মানা হয়নি। ৯/১১-তে তালেবান আমাদের আক্রমণ করেননি। উনিশজন ব্যক্তি — যাঁদের ১৫ জন সৌদি আরবের — করেছিলেন, এবং আফগানিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কিংবা রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্য কোনও সদস্য দেশের ওপর হামলা করতে চলেছে এমন কোনও আশু আশঙ্কা ছিল না। নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বা অন্য কোনও দেশকে আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ চালানর অনুমোদন দেয়নি। আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ বেআইনি।’’ (উদ্ধৃতি সূত্র counterpunch.org)।
বেআইনি বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করলে তাকে স্বাধীনতা বলা হয়।
আশ্চর্য, এই মূল প্রশ্নটাই কেউ তুলছেন না দেড় লক্ষ মানুষকে হত্যা করা এক বেআইনি যুদ্ধ যাঁরা চালালেন তাঁদের কি বিচার হবে?
৩। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হঠাৎ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন
২০১৫: প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা ঘোষণা করলেন আফগানিস্তান থেকে ২০১৭-র মধ্যে সব মার্কিন সেনা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার সময় আফগানিস্তানে ৫৫০০-র বেশি মার্কিন সেনা থেকে গেল।
২০২০, ২৯ ফেব্রুয়ারি — মার্কিন সরকার ও তালেবানের মধ্যে চুক্তি হয়। তাতে চারটি শর্ত দিয়ে বলা হয় শর্তগুলি মানা হলে, ‘The United States is committed to withdraw from Afghanistan all military forces of the United States, its allies, and Coalition partners, including all non-diplomatic civilian personnel, private security contractors, trainers, advisors, and supporting services personnel within fourteen (14) months following announcement of this agreement…’। (মার্কিন সরকারের প্রেস রিলিজ) তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ৮ জুলাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঘোষণা করে ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই সব সেনা প্রত্যাহৃত হবেন। ২০২০-র ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ জুলাই, ২০২১ হিসেব করুন।
তিন তিন জন প্রেসিডেন্ট জনপরিসরে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলেছেন ও কিছু কিছু করে এগিয়েছেন। শর্তগুলি মানা হয়েছে কী? মার্কিন প্রশাসন জানে।
৯ ডিসেম্বর, ২০১৯। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করে তাঁদের হাতে চলে আসা (আসলে মামলা রুজু করে আদায় করা, এবং মামলার শেষ রায় প্রকাশের আগে তা জনসমক্ষে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়) ২০০০-এরও বেশি পৃষ্ঠার সরকারি নথি। সেই সংবাদের গোড়ায় লেখা ‘ইন্ট্রো’ টুকু তরজমা করে দিলাম — ‘‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর পাওয়া গোপন সরকারি নথির একগুচ্ছ থেকে স্পষ্ট হয় মার্কিন সরকারি আধিকারিকরা অভিযানের ১৮ বছর ধরেই আফগানিস্তানের যুদ্ধের বিষয়ে সত্য কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন। যুদ্ধ যে কিছুতেই জেতা যাবে না তার অকাট্য প্রমাণ লুকিয়ে তাঁরা নানা সুন্দর সুন্দর বিবৃতি দিয়েছেন, সেগুলি সব মিথ্যে জেনেও।’’
সাধারণ মানুষকে যাঁরা ভুল বুঝিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়ার), প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই নথিগুলি ‘ওয়াশিংটন পেপার্স’ নামে পরিচিত।
এটা হঠাৎ?
উপসংহার
তালেবান কী ভাবে আফগানিস্তান দেশ শাসন করবে না করবে সেটা মূলত তাঁদের ও আফগানদের বোঝাপড়ার ব্যাপার। কিন্তু আফগানিস্তান রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশ। যদি তালেবান সরকার গঠিত হয়, এবং তাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যান্য সদস্য দেশের মান্যতা পেতে হয়, তা হলে সেই সরকারকে কিছু মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষার শর্ত মানতেই হবে। তালেবান যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন, হয়তো সরকারও গড়বেন শীঘ্রই। কিন্তু সেই সরকারকে কোন দেশ মান্যতা দেবে কোন দেশ দেবে না এটা প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। পাগলা দাশুর মত, ‘তা হলে আমার পটকা আমিও যা খুশি করব’ এই বলে দেশ শাসন করা যায় না।
তালেবান অন্য বহু দেশের তুলনায় কোনও অতিরিক্ত ‘বর্বরতা’ দেখায়নি। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি অশান্তই হয়। ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবি। আফগানিস্তানের মানুষ ও তালেবান উভয়ই যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। স্নায়ু টানটান। মার্কিন ও নেটো সেনা বাড়ি চলে গিয়ে অবসর ভাতায় দিব্যি জীবন কাটাবেন। বই লিখবেন। অনেক টাকা দিয়ে কপিরাইট কিনে তা থেকে হলিউড ছবি করবে। সেটাই কাম্য।
আফগানদের কাজ সম্পূর্ণ বেআইনি যুদ্ধ ও দখলদারির পর বিধ্বস্ত, স্বাধীন নিজের দেশকে স্বাভাবিকতায় ফেরান। তালেবান মুখে বলছেন সেটাই তাঁদের লক্ষ্য। তাঁদের বিশ্বাস করার সময় এখনও আসেনি।
তবে মনে রাখতে হবে ইতিহাস। যেমন— রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন সর্বস্বান্ত হয়ে শরণার্থী হয়েছিলেন। বিভিন্ন গবেষণার হিসেবে, ৭৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় খুন হয়েছিলেন যে কত মানুষ তার কোনও সঠিক হিসেব মেলে না, ২ লক্ষ অন্তত। পশ্চিমী পণ্ডিতদের একাংশ আক্ষেপ করেছিলেন, এই জন্যই এই ‘বর্বরদের’ আরও সাবধানে স্বাধীন করা দরকার ছিল। আফগান স্বাধীনতায় সে তুলনায় আশান্তি বিশেষ হচ্ছে না এখনও।
সুযোগ এসেছে, তালেবান ইরানের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। নেবে কিনা জানি না। জটিল পরিস্থিতি। চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো, তারা তালেবানকে এ বিষয়ে চাপ দিতে পারে। পাকিস্তানের সেনাকর্তারা উল্টো চাপ দেবে।
ভালো লক্ষণ এই যে, আফগানিস্তানে ছোটো ছোটো হলেও তালেবান-বিরোধী বিক্ষোভ আয়োজিত হচ্ছে, এই লেখা যখন চলছে তখনও কোনও বিক্ষোভকে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়নি। এটাই বোঝাপড়ার লক্ষণ। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, ২০ বছরের ভয়াবহ যুদ্ধে পাওয়া সাফল্য তালেবান বিক্ষোভের মুখে ছেড়ে দেবে। যা দেখার কতখানি সহ্য করা হয়। এখনও লক্ষণ মন্দের ভালো।
কিন্তু এই সব শহুরে বিক্ষোভ নয়, তালিবানের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কার্যকর সমর্থন আদায়। তাজিক, হাজ়ারা, নুরিস্তানি, বালোচ, তুর্কমেন… আরও কত কী। আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ হক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা ও অনুগামীদের আন্তর্জাতিক ইসলামি জেহাদি প্রবণতাকে লাগাম পরান। ভীষণ কঠিন কাজ।
সেটা কী ভাবে সম্ভব তা বাইরে থেকে কেউ বলতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে লোয়া জির্গাকে তালেবান কী ভাবে ব্যবহার করছেন, বা আদৌ করছেন কি না সেটা দেখা জরুরি। আফগানিস্তানের মানুষ পশ্চিমী ধারণায় যাকে ‘প্রগতিশীল’ বলা হয় তেমন দিনকাল দেখেছেন, অল্প কিছুকাল হলেও। আবার তালেবানি শাসনও দেখেছেন। তাঁদের সভ্যতা চার হাজার বছরের পুরনো, বেশি বৈ কম নয়। তাঁরা ‘আহা বেচারা’ নন, ‘অশিক্ষিত প্রাগৈতিহাসিক জমানার আদিবাসী’-ও নন। তাঁদের লড়াই তাঁরা লড়বেন, চিরকাল লড়েছেন।
ভারতের উচিত কিছু গোপন কথাবার্তা চালিয়ে যে সরকার গঠিত হবে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। দ্রুত স্বীকৃতি কূটনৈতিক সুবিধা দেবে। ভারত আফগানিস্তানে যে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ চালাচ্ছিল তা অব্যহত রাখা জরুরি।
এ কাজটা মূলত করবে চিন। তালেবান কাবুলে পৌঁছনর আগেই ২৮ জুলাই বেজিংয়ের কাছে তিয়ানজিন শহরে চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই তালেবান রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা বরাদরের সঙ্গে বৈঠক সেরে নিয়েছেন।
ওদিকে নয় জনাব এদিকে দেখুন! মোল্লা বরাদর এবং ওয়াং ই
চিনের কূটনীতি দীর্ঘমেয়াদী ও শান্ত, প্রায় অজান্তে। আফগানিস্তানে চিনের সঙ্গে টক্কর না নিয়ে অনুরূপ নিচু গলার কূটনীতিতে তালেবানের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করতে হবে ভারতকে, ৫৬ ইঞ্চির বরফট্টাই ওই ময়দানে একেবারে ল্যাজে গোবরে হওয়ার আশঙ্কা। কোলাকুলি, জাপটাজাপটি, এক জায়গার জন্য রওয়ানা হয়ে মাঝপথে প্লেন ঘুরিয়ে কাবুল চলে যাওয়ার পুলাপান্যামো সপাটে চড় খাবে নয়তো গোপন রক্তপাতে অক্কা যাবে (অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সেই দিল্লির পথে রওয়ানা হয়ে সহসা লাহোর হাজির হওয়া পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের বাড়িতে নাশ্তা করবেন বলে। হয়তো তাঁর উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, কিন্তু…!)।
আসল কথা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করবে। দুটো ইঙ্গিত আছে। প্রথম, একটা বই এখনও প্রকাশ হয়নি কিন্তু এর মধ্যেই মার্কিন সংবাদমাধ্যমে হইচই ফেলে দিয়েছে— The Strategy Denial। লিখেছেন এলব্রিজ কোলবি। মাঝ-চল্লিশের এই ঝকঝকে ভদ্রলোকের ঠাকুর্দা ছিলেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময় সি.আই.এ-র ডিরেক্টর উইলিয়াম কোলবি। তিনি নিজে ইয়েল ল স্কুল থেকে পাশ করেছেন। ইতিমধ্যেই তিনি ট্রাম্প সরকারের প্রথম প্রতিরক্ষা সচিবের ‘এইড’ হিসেবে পেন্টাগনের বারান্দায় ঘোরাফেরা করে নিয়েছেন। রিপাবলিকান মহলে তিনি সোনার ছেলে। এই কেতাবের মূল কথা, এবার রাজনীতিকদের কাজ হল, মার্কিন জনগনকে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সেটা ঘটাতে হবে তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবিতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এটা একটু সুদূরপরাহত আশা।
দুই, জো বাইডেন যদি দ্বিতীয় দফাতেও প্রেসিডেন্ট থাকেন, তা হলে, আমার আন্দাজ, আগামী প্রায় এক দশক পেন্টাগন নয় সি.আই.এ অনেক বেশি সক্রিয় হবে। কারণ, এই প্রথম সম্ভবত একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনপরিসরে স্বীকার করলেন ‘অন্য দেশের গৃহ যুদ্ধ লড়া আমাদের সেনার কাজ নয়। অন্য দেশ গড়ে দেওয়া (নেশনবিল্ডিং) আমাদের সেনার কাজ নয়’। এবং এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই ফিরে গেলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে। এবং ফিরে এল তাঁর মুখে সেই বহুল প্রচলিত প্রবচন— আফগানিস্তান হরেক সাম্রাজ্যের কবরখানা।
এই ভাষণটা নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক, আফগানিস্তানের সেনা অপসারণে অটল থাকার জন্য নয়, ওটা হতেই হত, ঐতিহাসিক নানা স্বীকারোক্তির জন্য, অবশ্যই শুনুন—
সমৃদ্ধ তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বহু প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এই প্রবন্ধে। ধন্যবাদ।
Fantastic lekha. Bohudin por banglay emon detailed, balanced, sposhto aar nuanced rajnoitik lekha porlam. Nilanjanbabur theke erokom aaro lekhar prottashay… – Kingshuk Sarkar
নীলাঞ্জন হাজরা মহাশয়কে জানাই হার্দিক অভিনন্দন ও প্রণাম ।কি অসাধারণ বিশ্লেষণ! ইতিহাস ভূগোল রাজনীতি দর্শন পরিক্রমা সেরে সত্যের সমূহ সারাংশে পৌঁছে দিলেন অনায়াসে ।কিন্তু ভয় হচ্ছে এত গভীরে জেগে ওঠার আগে ভারতীয় সেই উর্দু কবির তালেবান প্রীতি বেড়ে না যায় ।
খুব সুন্দর তথ্য মূলক, গবেষণাধর্মী আলোচনা।
তবে,
তালিবান এর উৎপত্তি এর ব্যাপারে কিছু লেখা হয় নি, যেটা খুব ই প্রয়োজন ছিল।
দ্বিতীয়ত তারা কখনোই কোনো ড্রাগ এর ব্যাবসা করবে না। যেহেতু উনি সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন তাই উনি সন্দেহে আছেন। কিন্তু লেখক যদি ওদের ধর্মীয় মানসিকতাটা বুঝতে পারতো তাহলে স্পষ্টভাবেই এটা নিশ্চিত থাকো বিগত শাসনকালের মতো এবারেও তারা ড্রাগের ব্যবসা, পাচার সবকিছু বন্ধ করে দেবে ।
এই দুটো বিষয় বাদ দিয়ে বাকি লেখাটা সুন্দর, বেশ নিরপেক্ষ উপকারী।
Eto informative lekha kom porechi. Nilanjan Babu ke kurnish.