অমিতাভ সেনের কাব্যগ্রন্থ ‘আজানে-আহ্নিকে’ নিয়ে কয়েকটি কথা <br /> সোহম দাস

অমিতাভ সেনের কাব্যগ্রন্থ ‘আজানে-আহ্নিকে’ নিয়ে কয়েকটি কথা
সোহম দাস

কবিতা এক নবজাতকের মতো। ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে আকুল কান্নায় যখন ঘোষিত হয় সে নবজাতকের অবিমিশ্র আগমনবার্তা, সে কান্না তো আসলে কবিতাই – হয়তো এ পৃথিবীর বিশুদ্ধতম কবিতা। সহজ তার প্রকাশভঙ্গি, খাঁটি তার অন্তঃকরণ, গভীর তার চালিকাশক্তি। আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক কবির কাছে শ্রেষ্ঠ কবিতার সৃজন হয়ে ওঠে ‘সমস্ত অসঙ্গতির জট খসিয়ে কোনো একটি সুসীম আনন্দের দিকে’১ ধাবিত এক যাত্রা, কোনও কবি আবার উত্তরাধিকারকে উপহার দিতে চান ‘কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা’-র২ মুহূর্ত, অন্যদিকে বৃদ্ধ জমিদারের তরুণী স্ত্রীর মানসিক টানাপোড়েন দেখে ঔপন্যাসিক ঘোষণা করেন – “মানুষের সভ্যতা যুক্তি-তর্ক অপেক্ষা কাব্যের উপরেই নির্ভর করে বেশী।”৩
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবিতার কাছে মানবসভ্যতার ঋণ বড়ো কম নয়। যাঁরা আমাদের ঋণী করেন, তাঁদেরকেই আবার আমরা ভাঙি-গড়ি বেশি, ঠিক যেভাবে কোনও বৈজ্ঞানিক গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পেলের ক্রস-সেকশন করে তাকে অনুবীক্ষণের তলায় ফেলে দেখতে চান তার অন্তঃস্থলকে। কবিতাকে নিয়েও তাই কবিদের নানাবিধ খেয়ালখুশির পরীক্ষানিরীক্ষা।
সনেট – এ নামটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে খুব অদ্ভুতভাবে। একই সময়ে যখন পাঠ্যক্রমের তাগিদে আমাদের রুল-টানা খাতায় ঢুকে যাচ্ছে মধুকবির ‘বঙ্গভাষা’, তখনই গড়িয়ার লক্ষ্মীনারায়ণ কলোনির ওদিকে বড়ো রাস্তার ওপরেই চোখে পড়ছে, একটা আবছা আলোর বইয়ের দোকান, তার রঙিন সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করে সাদায় লেখা নামটা, ইংরাজিতে – SONNET.
ও দোকানের নাম কে দিয়েছিল, কিংবা মাধ্যমিক দিনের বন্ধু সনেট চৌধুরীর নামটিই বা কার দেওয়া, সেই দুজন মানুষ আদতে কতখানি কাব্যপ্রেমিক ছিলেন, এসব নিয়ে ভাবনা এলেও পারিপার্শ্বিকের স্তূপে তা চাপা পড়ে গিয়েছিল। যেটুকু স্মৃতি, তা কেবল বাবার সংগ্রহের মধুসূদন রচনাবলী থেকে ‘কবিবর আলফ্রেড টেনিসন’ বা ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে’-র আস্বাদ নেওয়ার, অবরে সবরে।
সেই বিশেষ পদ্যনির্মাণের কাছে আবারও ফিরতে হল। যাঁর সৌজন্যে এই ফেরা, কাকতালীয় ভাবে তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছিল ওই বঙ্গভাষা বা সনেট বুক স্টোরের দিনগুলোতেই।
তিনি অমিতাভ সেন। এই মুহূর্তে বাংলায় সনেট কবিতা নিয়ে নিয়মিত চর্চা ও নির্মাণের এক আবর্তে নিজেকে মগ্ন রেখেছেন এই কবি। যদিও, ‘কবি’-র চেয়ে নিজেকে পদ্যনির্মাতা বলতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। ‘চতুর্দশপদী অন্তরিন’ (২০২১), ‘চতুর্দশপদী ক্রমবর্ধমান’ (২০২২) ও ‘আজানে-আহ্নিকে’ (২০২৩) – পরপর তিনবছরে ধানসিড়ি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই তিনখানি সংকলন তাঁর সেই নিরন্তর কবিতাযাপন থেকে উঠে আসা কিছু ক্ষণিক উদযাপন। আপাতত, এ আলোচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকছে শেষোক্ত বইটি, যা পাঠক-সকাশে পৌঁছেছে চলতি বছরের গ্রীষ্মে।
চার ফর্মার বইটির ‘বই’ হয়ে ওঠার সার্বিক যাত্রাপথটিতেই ছোঁয়া থেকেছে কবির। কবিতা তো বটেই, প্রচ্ছদ ও অলংকরণের গুরুদায়িত্বটিও পালন করেছেন সযত্নে। প্রচ্ছদের কথাই যদি ধরি – গেরুয়ার নানা শেডের ওপর জ্বলজ্বল করছে বাঁকানো অক্ষরে লেখা বইয়ের নাম, ‘আজানে-আহ্নিকে’। আজকের পরিস্থিতিতে ত্যাগ ও সাহসিকতার প্রতীক গেরুয়া রং যখন হিন্দু ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সমার্থক, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই রঙের ওপর এমন শব্দবন্ধের ব্যবহার ভীষণভাবেই রাজনৈতিক। সে ধারণা ক্রমশ স্পষ্ট হয় বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সংলাপে।
বোর্ড কভারটি উল্টে এবার বইটি খুলি। বাঁদিকের ফ্ল্যাপের প্রথম কয়েকটি লাইন – “কালাবর্তে মথিত মানবসম্পদ যখন ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত, পরহিতৈষণা যখন অপ্রচল, প্রায় প্রত্যহ পরমসত্যের আরাধনা হয়তো-বা ধ্বনিত চতুর্দশপদে গ্রথিত পদ্যপঞ্চাশিকা ‘আজানে-আহ্নিকে’-এ।” শব্দের গাম্ভীর্য হয়তো খানিক সময় দাবী করে বোঝার ক্ষেত্রে, কিন্তু একবার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেলে সে বড়ো কাছের হয়ে ওঠে।
ফ্ল্যাপ থেকে আরও এগোলে আসে উৎসর্গের পাতা – “ক্ষণবাদী বর্তমানের প্রতি”। এখানে এই ‘ক্ষণবাদী’ শব্দের ব্যবহারটি বেশ ভাবনার উদ্রেক করে। নয়ের দশক-পরবর্তী যুবসমাজের যে ক্ষয়, সেই ক্ষয়ের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ, কিন্তু একইসঙ্গে যেন চলে আসেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি আবার নিজেও বাংলা ভাষায় শেক্সপিয়রীয় সনেটের অন্যতম অনুসৃজক। এই প্রসঙ্গ ধরেই আবার ফিরে যাওয়া যায় সুধীন দত্তদের কর্মকাণ্ডের কালে। তিনের দশকের মহামন্দা-পরবর্তী বিশ্ব, সাম্রাজ্যবাদের নড়বড়ে অবস্থার সুযোগে দাঁত-নখ বার করে জন্ম নিচ্ছে অন্য এক স্বৈরাচার, তাকে আমরা চিনছি ফ্যাসিবাদ নামে, তারপর দুই অত্যাচারীর ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ঘোরতর যুদ্ধ বাধছে, একসময়ে জড়িয়ে পড়ছে এই দুইয়েরই বিরুদ্ধ শক্তি সোভিয়েতও, সংকীর্ণ পরিস্থিতিতে তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত এক মিত্রতার জোট। ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ দুইয়ের প্রতিই তীব্র ঘৃণা উজাড় করে দিচ্ছেন স্বয়ং কবি সুধীন্দ্রনাথ, সেকারণে অনেকের কাছেই নিন্দিত হচ্ছেন তিনি, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, সমকালীন বাংলাদেশের সৃষ্টিক্রিয়ার দুর্বিষহ গৌরব প্রসন্ন মুখে বহন করার মানুষটির নামই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সেই যে শুরু হওয়া ক্ষয়, তারই তো নব্যরূপ এই নয়ের দশক, যাকে নিয়ে এত কথা, এত আলোচনা। অমিতাভ সেনের এই উৎসর্গপত্রের পাশে বসলে তাই মনে হতে থাকে, দিশাহীন, অনুভবহীন বর্তমানের কাছে তিনি বুঝি উজাড় করে দিতে চাইছেন তাঁর সবটুকু, সে সবটুকুর মধ্যে ভীষণভাবেই জড়িয়ে আছে তাঁর সচেতন ইতিহাসবোধ।
ফ্ল্যাপের যে বক্তব্য, তার প্রতিধ্বনি আসছে প্রাককথনেও – “সভ্যতাবিমুখতা আমার পদ্যের উপজীব্য নয়। মানবসভ্যতার অভ্রভেদী অহংবোধ ও জীবনবিচ্ছিন্নতা আমার কাছে অতি পীড়াদায়ক ও লজ্জার বিষয়। কারণ আমার জীবনও (ব্যক্তিগত মায় সামাজিক) মানবসভ্যতার নির্মাণে যাপিত।” ঠিক এর পরের অনুচ্ছেদেই আছে – “এমতদ্বন্দ্বজ প্রেক্ষিতে শোচনের পথ ধরে আধ্যাত্মিক উত্তরণের আর্তি নিঃসৃত হয়েছে বর্তমান সংকলনের প্রতিটি পদ্যের প্রতিটি চরণে।” প্রথম স্বীকারোক্তিটি যদি হয় সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে অবস্থান স্পষ্ট করার সৎসাহস, দ্বিতীয় বাক্যটি তাঁর নিজস্ব কৃষ্টির বৈজ্ঞানিক উন্নতিকরণের কথা বলে।
সূচিপত্রের পর কবিতার ঝংকার শুরুর আগে একটি পাতা প্রবেশকের জন্য ব্যয় করেছেন কবি – “মৃত্যু হারে, জন্মের জোরে/মৃন্ময় জাগে চিন্ময় ভোরে।” এই দুই লাইন আসলে এই বইয়েরই ‘স্পৃহা অজেয়’ কবিতার দ্বিপাদিকা।
এবং, এরপর পঞ্চাশটি কবিতার এক কার্নিভ্যাল। ‘নির্গমন’, ‘নগরবন্দি’, ‘দেহাতি বন্ধু আমার’, ‘দ্বন্দ্ব-আপদ’, ‘মেঘের গাড়ি’, ‘কালঘুম’, ‘বাইশে আষাঢ়’, এমন নানা কবিতায় অমিতাভ সেন সাজিয়েছেন তাঁর এই সংকলন। পঞ্চাশটি কবিতার সঙ্গে দুখানি সাদাকালো চিত্রকলা। এই বিষয়টি তাঁর প্রথম চতুর্দশপদী সংকলনেও ছিল। কালো রঙে মাখানো তুলির ভরাট দাগে ফুটে ওঠে যে অবয়ব, তা দৃশ্যতই বড়ো সুন্দর, সহজ। তার শিল্পরসের বিশ্লেষণ করা আমার সাধ্যাতীত। ছবি ও কবিতার এই সমন্বয়ের বিষয়ে কেবল একটি কথাই বলার। যেহেতু সনেট একটি বিশেষ কাব্যগঠনরীতি মেনে চলে, লেখার ক্ষেত্রে কবিকে হতে হয়েছে যথাসম্ভব সুসংবদ্ধ, তা নানা ক্ষেত্রে কবিতার শৈলীকে নানাভাবে প্রভাবিতও করেছে, সেই কবিই আবার চিত্রশিল্পী হয়ে উঠছেন যখন, তখন সেখানে রঙের ব্যবহার, তুলির স্ট্রোকে যেন এলোমেলো বাঁধনহীনতা। টানা কবিতা পড়তে পড়তে ক্লান্তি আসে, ছবিগুলো হয়ে ওঠে সার্থক উপশম।
কবিতার গঠনশৈলীর ক্ষেত্রে কবি অনুসরণ করছেন শেক্সপিয়রীয় সনেট রীতি, যেখানে মিলবিন্যাসটি এইরকম – কখকখ গঘগঘ ঙচঙচ ছছ। আবার, সনেটের বিষয়-নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ঋণী হচ্ছেন বাংলা কাব্যকে আক্ষরিক অর্থে যিনি সাবালক করেছিলেন, সেই মধুসূদনের কাছে, যিনি নিজে মিলটন-অনুপ্রাণিত। যদিও মধুকবির চতুর্দশপদীর যে মাত্রাসজ্জা, তাকে অমিতাভ সেন ভাঙছেন নিজের মতো করে। মাত্রাসজ্জায় তাঁর এই সচেতন স্বেচ্ছাচারীতার ক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছেন ষোড়শ শতকীয় ইংরেজ নাট্যদ্রষ্টা-কবি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেক্সপিয়রের ১৪৫ নম্বর সনেটটির কথা (Those lips that love’s own hand did make), যেখানে তিনি তাঁর সনেটের চিরাচরিত ‘ইয়াম্বিক পেন্টামিটার’ সিকোয়েন্সকে ভেঙে ‘টেট্রামিটার’-এর শরণ নিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে অমিতাভ সেনের নিজের কথা ধরেই বলি – “মাত্রার বিভিন্নতা ছন্দে-ছন্দে লড়াই লাগায়। আমি তাতেই সচেষ্ট থেকেছি। ছন্দ ধরতে ধাঁধাতে চাই পাঠককে। একবিংশ শতকে structured activity is basically an anarchy in disguise.”
কবি নিজে ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র, সনেট নিয়ে তাঁর চর্চা দীর্ঘ ও গভীর। সে ছাপ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম চতুর্দশপদীর সংকলন ‘চতুর্দশপদী অন্তরিন’-এর একদম শেষে দেওয়া ‘পাঠকের দরবারে’ শীর্ষক মুখবন্ধটিতে। সেখানে তিনি সনেটের বিবর্তন, পেতরারক-ওয়াইট-মিলটন-শেক্সপিয়র-মধুকবির কাব্যরীতির সার্বিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছেন নির্মোহ ভঙ্গিতে।
সনেটের দুই মহীরুহকে অনুসরণ করলেও অমিতাভ সেন সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছেন নিজস্ব এক শৈলী উদ্ভাবনের। প্রতিটি কবিতার প্রতিটি চতুষ্কের চারটি লাইনের প্রথম শব্দ ও দ্বিপাদিকার দুই লাইনের প্রথম শব্দের মধ্যে ধ্বনিগত মিল তাঁর সনেটের এক বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি চতুর্দশপদীর ক্ষেত্রে কোনও নির্ধারিত রীতি নয়, আমি এখানে শ্রব্যকাব্য নির্মাণের চেষ্টা করেছি, যাতে কাঠামোর সুসংবদ্ধতা বজায় থাকে।
কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এলোমেলো ভাবনা আসে। সে ভাবনা পাঠকের একান্ত নিজস্ব, কবির সঙ্গে নাও মিলতে পারে। এই দ্বন্দ্বই শিল্পের সার্থকতা। যেমন, ২৮ নং পৃষ্ঠার ‘দ্বন্দ্ব-আপদ’ কবিতাটির কথা বলতে পারি। কিছুদিন আগে বইটি পরিপাটি করে পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে পাতাটি খুলল, সেই পাতাতেই রয়েছে এই কবিতা –
গর্জনে গর্জনে খানিক ধরলে বারি,
গরবে গদগদ, বিজর বিজলি ঝরায় আলো, স্তরে স্তরে অম্বরে –
গতরে শিথিল, শাহিনাগরিক বারোমাস্যা, তবুও কেন জারি?
গয়ায় সাজাতে হবে যে পিণ্ডডেলা, বাপ যদি সজ্ঞানে যায় মরে।

ছেঁদো নামচা না যায় ছন্দে বাঁধা,
ছেঁকে ধরলে পিলপিলিয়ে পঙ্গপাল, উজার আবার আপামর খেতখামার –
ছেঁচে ছেঁচে কড়া, হল যে সারা, থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় রাঁধা –
ছেঁড়াখোঁড়া অহোরাত্রে, আদৌ গড়ব কি আমরা অমরাবতী, আমজনতার?

শান্তি নামলে দিনের স্থবিরতা শেষে,
শালপাতায় মুড়ে নিই, ডুবো-তেলে-ভাজা আমার প্রিয় কৃষ্ণকলি –
শামুকের পিঠে চড়ে, গোয়ালপোকা পুলিনে মিশলে এসে,
শালফুলের ঝুমকো বাহারে, কী জানি, কার সাথে বারে বারে খেলি হোলি।

এই মেঘ, এই রোদ,
এবেলাও সামনে কেন দ্বন্দ্ব-আপদ?
এই কবিতাটা পড়ে মনে হবে, প্রথম অষ্টকে এক ভীষণ ক্যাওসের চিত্র আঁকছেন কবি, সে ক্যাওসের মধ্যে কোনও সৃজনশীল চরিত্র নেই। তারপর শেষ ছ’লাইনে তিনি শোনাচ্ছেন অদ্ভুত প্রশান্তির খবর। দু’দণ্ড বুঝি বসতে চান তাঁর স্বস্থানে। দ্বন্দ্ব-আপদের জটিল পৃথিবীকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলতে চান। এই যে সহজ ইচ্ছা, এ আসলে সময়ের নাগপাশে পিষ্ট তাবৎ জনতার চিরকেলে আর্তি।
অনেকটা একইরকমের শান্তি-বাসনা ধ্বনিত হচ্ছে ‘মৃতপ্রায় চোখগুলো’ কবিতায় – “মৃতপ্রায় চোখগুলো নেভে না নিরাশায়/মৃত্তিকাতলে শান্তি-অবসর-বাসনায়।”
এই আর্তি আমায় মেল গিবসন-পরিচালিত ছবি ‘Hacksaw Ridge’-এর শেষ দৃশ্যটার কথা মনে করায়। ডেসমন্ড ডস, যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া নিরস্ত্র কমব্যাট মেডিক, গুলি-বোমার ভয় এড়িয়ে আহত সহযোদ্ধাদের বাঁচানো নায়ক তখন নিজেই গুরুতর আহত, তাকে পরম যত্নে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে হ্যাঙ্গারে। শুয়ে শুয়ে সে হাঁপায়, রোদেলা আলো তার মুখে খেলা করে, সে শুকনো হাসি হাসে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে একটা অদ্ভুত সুর, যাকে মেলানকোলি বলেও ভুল হতে পারে। কিংবা, পরিচালকদ্বয় রবার্ট ওয়াইজ ও জেরোম রবিন্সের ‘West Side Story’। দুই গুণ্ডাদলের জাতিবিদ্বেষের অমোঘ পরিণতি এক প্রেমিকের মৃত্যু, তারপর মৃত্যুশেষে মিলনের মহামিছিল। বিচ্ছেদ, হানাহানির শেষে এই শান্তি-প্রার্থনাটুকুই আমাদের বেঁচে থাকার পিদ্দিম, এর চেয়ে বড়ো সত্য আর কী আছে!
তবে, এ বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ‘কালঘুম’। এই কবিতায় গঠনরীতিকে সম্পূর্ণ অক্ষত রেখে বিষয়ভাবনা ও শব্দচয়নের মুন্সিয়ানায় যে চিত্রকল্প এঁকেছেন কবি, তা এককথায় অসামান্য। এখানে প্রতিটি স্তবক যেন এক-একটি স্বতন্ত্র কবিতা। প্রথম স্তবকটির কথাই ধরা যাক –
যে পথেই হাঁটি না কেন
যেখানে জমে ভিড়, বা নামে নিদালি নিঝুম –
যে কোনো কারণে ঘোর লাগে যেন
যেদিন বুঝি, আমার দু-চোখে ভর করেছে মায়াভেজা কালঘুম।
কালঘুম ঘোষণা করে অন্তিম মুহূর্তকে, তখন প্রতিটি অভিজ্ঞতাই এসে মেশে এক বিন্দুতে, এক অর্থহীনতায়। এই অসাম্যের পৃথিবীতে ঘুম আসলে তো এক রাজনীতি, ‘ভালো আছি’ বোঝানোর রাজনীতি। সে রাজনীতির সার কথাই যেন স্পষ্ট হয় এই কবিতার শেষ দ্বিপাদিকায় –
শেষতম ক্ষণ যখন আসে
শেকড়বাকড় যত অমিতির গভীরে মেশে।
নামকবিতা হিসেবে যেটিকে ধরা যায়, অর্থাৎ, ‘রুশদি – আজানে-আহ্নিকে’, সেই কবিতায় আবার ধ্বনিত হচ্ছে বিপন্নতাকে জয় করে ওঠার নৈঃশব্দ। ১২ আগস্ট ২০২২, নিউ ইয়র্কের শটোকোয়াতে সলমন রুশদি আক্রান্ত হচ্ছেন, দুমাস মরণপণ লড়াইয়ের পর বিপন্মুক্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে হারাতে হচ্ছে একটি চোখের দৃষ্টি। ঠিক তার পরপরই অমিতাভ সেন সাজাচ্ছেন এই কবিতা। কবির কল্পনালোক কোনও সীমানা মানে না, তাই সেদিন তাঁর মনে হতে থাকে – মধ্যরাতের যেসব মুক্ত সন্তানদের কথা একদিন বলেছিলেন এই আক্রান্ত কলমচি, তারা আজ স্বাধীন হয়ে উঠল, বাতাসে ঘোরাফেরা করছে আজানের সুর, আহ্নিকের কলরব।
কল্পনালোকের কথা উঠলে অবধারিতভাবে এসে পড়বে আরও এক কবিতার কথা। কবিতাটার নাম, ‘মেঘের গাড়ি’। এই কবিতার তৃতীয় চতুষ্ক আমার ভীষণ প্রিয় –
নোঙর-বাঁধা রুগ্ণ গাছগুলোর সারি
নোনাধরা আকাশের গায়ে আছড়ে পড়ে–
নোয়া-পলায় সেজে, বিকেলে মেঘের গাড়ি
নোংরা দিনের খোলস ছাড়ায় নগরকন্দরে।
মনে হতে পারে, কবি বুঝি, যাকে তত্ত্বের ভাষায় অধিবিদ্যক বাস্তবতা বা মেটাফিজিক্যাল রিয়্যালমের অবতারণাই করছেন। তেমনটা মনে হওয়াটা খুব অস্বাভাবিকও নয়, কারণ, উৎসর্গপত্রেও ক্ষণবাদী চেতনার কথা এসেছে। কিন্তু কবি স্বয়ং সেই পথের সমালোচনার কোনও সম্ভাবনাকে খণ্ডন করে দিয়েছেন প্রাককথন অংশেই – “পদ্যসমূহের সামগ্রিক চিত্রকল্পতায় উপমেয়-উপমা-উপমানের কাব্যালংকার-নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খল বারে বারে ছিন্ন হয়েছে কোনো অধিবিদ্যামূলক কাব্য আদর্শ বা দর্শনের প্রভাব ছাড়াই। কারণ মুক্তকল্পনাসাধনেই আমার শৈল্পিক স্বাধীনতা।”
সনেটের মতো একটি বিশেষ গঠন-আঙ্গিকের কবিতা লিখতে গিয়েও কবিমানসের এই যে বহুমাত্রিকতা, এটাই একজন কবিকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা সেই বহুমাত্রিকতার অন্যতম ধাপ।
সেদিক থেকে অমিতাভ সেনকে একজন সার্থক চিন্তক আখ্যা দেওয়া যায়।
এতদূর পড়ে পাঠক ভাববেন, তাহলে দুর্বলতা কি নেই তাঁর কবিতায়? আছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিল্প-নিদর্শনটিও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হয় না। সে বিষয়ে পাঠক নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
যে শৈলীর নিজস্বতা দিয়ে কবিতা বুনেছেন কবি, সেই নিজস্বতা বজায় রাখতে গিয়ে কোথাও কোথাও তাঁর কবিতার ভাষা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, যা কিনা তাঁর কবিতার অন্যতম শক্তি, সে-ই হয়ে উঠছে প্রধান দুর্বলতা। যেমন, ‘ভাবের ভুবন’ কবিতার শেষাংশের (দিন পেরিয়ে নতুন জীবন,/দিক হারিয়ে নতুন ভুবন) বক্তব্য সুস্পষ্ট, কিন্তু প্রকাশভঙ্গিটি খুব উৎকৃষ্ট মনে হয়নি। একই কথা বলব ‘জীবনের যাতনা’ কবিতার ক্ষেত্রেও। শব্দচয়নের আড়ষ্টতায় শ্রুতিমধুর ভাব গিয়েছে হারিয়ে, খর্ব হয়েছে কবিতার সামগ্রিকতা।
আরও একটি বিষয় এখানে আলোচ্য, যদিও সেটিকে ঠিক দুর্বলতা বলা যায় না। তা হল, কবিতায় তথাকথিত ‘গুরুগম্ভীর’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার। কবির অনায়াস যাতায়াত বর্তমানের অলিগলিতেই, কিন্তু লেখার সময়ে তিনি কথ্য চলিত শব্দকে সেভাবে ব্যবহার করেননি। এক্ষেত্রে, একটি কবিতার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়, সেটি রয়েছে ২৩ নং পৃষ্টায়, নাম ‘গর্জনশ্রান্ত বজ্রকেতু’। দ্বিতীয় চতুষ্কটি দিলেই বোঝা যাবে –
শবনমশবলিত, মধুমায়া-আবরিত, যেমতি পুণ্যা ধরিত্রী,
শবযানে আলোকিত, তেমতি একদা স্নিগ্ধকায়া শতরূপা–
শপতির শর্ত হায়, একালে বিস্মৃতপ্রায় সর্বমান্য অত্রি!
শবরপুঙ্গব যত তাপসিক্ত, নিরাকুল জঘনদেশে মিলেমিধে, যেন শসনমগন অচল অজপা।
এই কবিতার অনুপ্রেরণাও নিশ্চিতভাবেই আশেপাশের অলিগলিতে দেখা কোনও ক্যাকোফোনির দৃশ্য। কিন্তু তাকে কবি উত্থাপন করছেন এরকম এক সচল গাম্ভীর্যে। এর ফলে একটি বিশেষ শ্রেণির পাঠকের কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছেই।
আসলে, বর্তমানের অস্থিরতায় আক্রান্ত তাঁর মন, পৃথিবী জুড়ে নব্য কর্তৃত্ববাদের দামামা বাজছে, তার থেকে কবি মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন না। তাই বুঝি সাবেক কালের যে নির্যাসটুকু ভালো, তার গন্ধে ভেজাতে চান তাঁর কবিতাকে, এই সাবেক-যাপন তাঁর কাছে সুখানুভূতির মতো।
তত্ত্বগতভাবে দেখলে আবার সেই সপ্তদশ শতকের নিও-ক্লাসিক্যাল ঘরানার কথা চলে আসবে, যেখানে প্রাচীন গ্রিক-রোমান শিল্পরীতিকে অনুসরণ করে একদল শিল্পী গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব চেতনা। বিশ্বসাহিত্যের মগ্ন পাঠক অমিতাভ সেনের মধ্যেও সেই ধরনের এক প্রবণতা রয়েছে, তা আরও বেশি স্পষ্ট হয় ‘বসন্তবাহারে’ কবিতায়।
আদিকবির স্পর্ধা না-ই বা থাকল স্বরে,
আতান্তরে, আতুর পদ্যের আপাতঅস্ফুট ছত্রে ছত্রে–
আবার জ্বালাব প্রতিক্ষণে, প্রতিবাদী প্রতি অক্ষরে,
আগমনির দীপমালা, ন্যুব্জ বিল্বপত্রে, অগণিত অন্নসত্রে।
কবিতা নিয়ে এমন এলোমেলো আলোচনার পরিসর রচনার জন্য তো বটেই, এ বই শুরু থেকে শেষ অবধি আরও একটা কারণে পড়তে ভালো লাগে। খুব খুঁটিয়ে দেখলেও বইতে একটিও মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়বে না। বিশেষত, যেখানে এই ধরনের গুরুগম্ভীর শব্দ রয়েছে, সেখানে একটি বানান ভুল সমগ্র কবিতার ভাবকে নষ্ট করে দিতে পারে। তা যখন দেখছি নেই, পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কতখানি পরিশ্রম ও যত্ন রয়েছে প্রকাশকের তরফে। ছাপা, কাগজের মান, এবং নির্মাণের অন্যান্য খুঁটিনাটিতেও যথেষ্ট পেশাদারিত্ব। ধানসিড়ি প্রকাশন তো বটেই, বইয়ের সঙ্গে জড়িত সমস্ত অক্ষরকর্মীর প্রতিই তাই অশেষ শ্রদ্ধা।
এ-পাতা, সে-পাতা করতে করতে সময় হয় শব্দহীন হওয়ার। শেষ কবিতার শেষ লাইন পড়ি। মন ভারাক্রান্ত হয়। বন্ধ করি তখন। ব্যাককভারে জ্বলজ্বল করে সাদা-কালো আঁচড়ের দাগ, সেখানে দিব্যি একটা আয়না ফুটে উঠেছে।

তথ্যসূত্র
১. জীবনানন্দ দাশ। “কবিতার কথা”, কবিতার কথা, পৃষ্ঠা ১৪ (৭-১৮), প্রথম সংস্করণ, সিগনেট প্রেস, ১৩৬২ বঙ্গাব্দ।
২. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। “উত্তরাধিকার”, বন্দী, জেগে আছো, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ।
৩. বিশ্বপতি চৌধুরী। ঘরের ডাক, পৃষ্ঠা ৯৯, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes