
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
ঊনচল্লিশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩৯তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
৩৯
দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু চারদিন হয়ে গেল, সে আজও রওনা দিতে পারল না।মনিয়ারার খুব বুঝ আছে, সে বুকের ভেতর হাজার তোলপাড় করলেও কোনদিন মুখ ফুটে বলে না ‘আরেকটা দিন থেকে যাও’ পেটের ভাত যেখান থেকে আসছে, সেখানে যে বৌ মেয়ের দোহাই পাড়া চলে না, তা সে খুব বোঝে। মেয়েটা বড্ড ছোট, দুনিয়াদারির খবর অত বোঝার বয়স হয়নি, সে গলা জড়িয়ে বায়না করে, মানিব্যাগ লুকিয়ে রাখে। তবু সেসব পেরিয়েও ঠিক চলে যায় পটা। ট্রেনে সে যে কতবার চোখের জল মোছে। তার সবচেয়ে দুঃখ হয়, মেয়ে যখন বলে ‘বাবা, তুমি গাড়ি নিয়ে আসলে না তো? মা বলে তুমি নাকি মস্ত বড় গাড়ি চালাও, সেই গাড়ি নিয়ে এলে না কেন বাবা? আমি আমার বন্ধুদের চড়াতাম, ওরা খালি বলে, বিশ্বাস করি না তোর বাবার বড় গাড়ি আছে’
এইসব কথাগুলো ওর চোখে ঢুকে যাবে হাওয়ায় আসা বালির মতো, চোখ করকর করবে। দশটাকার মশলামুড়ির লংকাকুচির মতো জিভের ঝাল পৌঁছে দেবে ব্রহ্মতালুতে। ওর বুক ফেটে যাবে, চোখে জল আসবে, ও তখন ভাব দেখাতে চাইবে ওর খুব খিদে পেয়েছে। কাঁধের ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স বার করে দেখবে পাতলা পাতলা রুটি আর কুমড়ো বেগুনের তরকারি করে দিয়েছে শাশুড়ি বউয়ে মিলে। পটা এমন একজন লোক যাকে খাইয়ে সুখ হয় না ওদের। সে ঝাল মশলা সহ্য করতে পারে না, লুচি খায় না তেলের জিনিস বলে। হলুদ গোলা চারা মাছের ঝোল আর চিঁড়ে ভেজানো খেয়ে পারলে সারা জীবন কাটিয়ে দ্যায়। মনিয়ারার তো একটু তেল গরগরে রান্না রেঁধে বরকে খাওয়াতে ইচ্ছে করে, নাকি? মা নিরামিষ খেলেও চায় একটু লুচি, ভাজাভুজি, পিঠে পুলি করে খাওয়াতে। পটার তো সবেতেই না। তাই তারা ভয়ে ভয়ে ফেরার সময় রুটি তরকারি করে দিয়ে, তার সঙ্গে কটা মালপো দিয়েছে। একটা কৌটোয় শুখনো খোলায় ভাজা চিঁড়ে, বাদাম ছোলা, আরেকটা চালভাজা, নারকেল নাড়ু কিছু আর মুড়ির মোয়া। এইগুলো অবশ্য খুব পছন্দ করে পটা।
রুটি দুখানাই খেয়ে ফেলবে পটা, তারপর একটা মালপো। হাতে রস লাগবে, তাই সে মনে মনে রেগে উঠতে চাইবে মা আর বউয়ের বেয়াক্কেলেপনা দেখে। সেই মুহুর্তেই তার চোখ পড়বে একটা ছোট্ট প্যাকেটে কয়েকটা পেপার ন্যাপকিন রোল করে দেওয়া। সে অবাক হয়ে যাবে দেখে। কে এসব দিল? গ্রামে এসব পেলই বা কোথা থেকে? তখন তার চোখে পড়বে একটা ছবি, মেয়ের আঁকা। একটা গাড়ি চালাচ্ছে একটা লোক, তাতে বসে একটা বৌ, একটা বুড়ি মানুষ আর একটা ছোট মেয়ে।
নিচে লেখা ‘আমাদের গাড়ি’।
তার নিচে খুব ছোট করে মেয়ে লিখেছে- বাবা আমাদের শ্যামাকাকুর দোকানে সব পাওয়া যায়। এই কাগজের রুমালগুলো ওখান থেকেই কিনেছি, যাতে তোমার হাতে তেল না লাগে। এবার যখন আসবে, তোমার গাড়িটা নিয়ে এসো, বন্ধুরা সবাই চড়বে।
প্রণাম নিও।
তখন আর চোখের জল বাঁধ মানবে না পটার। সে ঝরঝর করে কাঁদবে আর ইচ্ছে করবে ভিড় ঠেলে পরের স্টেশনে নেমে উল্টোদিকের ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু না, তবু সে নামতে পারবে না। একবার গাড়িতে চড়ে বসলে, আর সে গাড়ি কলকাতার দিকে ছুটলে আর কি নেমে উল্টোদিকে যাওয়া যায়? এরকম ফেরার কথা সে অনেক কল্পনা শুধু করেনি, আগে আগে দু একবার ফিরেও দেখেছে। সে ভেবেছে গিয়ে দেখবে এক ঘরে মা, এক ঘরে বৌ মেঝেতে আঁচল পেতে শুয়ে আছে, চোখের জল বয়ে নদী, কেউ মুখে কিছু কাটেনি।কোথায় কী? গিয়ে দেখেছে টিভির সামনে মেঝেতে বসে খাচ্ছে শাশুড়ি বৌ, মেয়ের খাওয়া হয়ে গেছে। সে খাটে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। ওকে দেখে মেয়ে বই ফেলে ছুটে আসবে, মা বলবে, গাড়ি ফেল করেছিস নাকি? মনিয়ারা কিছুই বলবে না, সে খাওয়া ফেলে ভাত বসাতে চাইবে। সবই ঠিক, কিন্তু ওই যে পটা এসে দেখে ফেলেছে এরা সবাই নিজেদের রুটিন কাজে ঢুকে গেছে, কেউ তার জন্যে বসে বসে কাঁদছে না, অমনি তার খুব অভিমান হবে, একেবারে অযৌক্তিক অভিমান। কেন, কেন সে ফিরল? কত কী ভেবেছিল। তাকে ছাড়া সব মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, রামের জন্যে অযোধ্যা যেমন কেঁদেছিল।কোথায় কী। এরা দিব্যি তো সিরিয়াল দেখতে দেখতে ভাত খাচ্ছিল।ফলে বাড়ি ফিরে সবাইকে চমকে দেবার, সবার চোখের জল মুছিয়ে হাসি ফোটানোর যে ছবি আঁকতে আঁকতে সে ফিরেছিল, সেটা যেন টোল খেয়ে গেল কোথাও। সে এমনকি প্ল্যান করে এসেছিল, ফিরেই যখন এল, একেবারে কাল দিনটাও থেকে পরশু ফিরবে। মা বিশালক্ষী থানে পুজো দিতে চাইছে অনেকদিন, বেশি নয়, এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে, ধনবেড়ে বলে একটা গ্রাম, সরাসরি বাসে যাবার উপায় নেই, টোটো বা ভ্যান ভাড়া করে যেতে হয়, সেটা ঠিক করে উঠতে পারেনি তাকে ছাড়া, হয়তো পারে, কিন্তু ছেলে নিয়ে যাবে, এই আশায় বসে আছে। কাল ভোরে মাকে নিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। আর বাড়ি ফিরে বিকেলে টাউনে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে আনবে বৌ মেয়েকে, ওদের হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না, মেয়ে তো দেখেইনি হলে সিনেমা। সে কতবার বলেছে ‘ও বাবা, সিনেমাহলে ছবিগুলো আমাদের টিভির থেকে বড়? কত বড়? ও বাবা, আমাকে দেখতে নিয়ে চলো না?’ তারপর সিনেমা দেখা হয়ে গেলে ওদের রোল কিনে দেবে, নিজে এক ঠোঙা মুড়ি বাদাম খাবে যদিও। তারপর মেয়ের একটা ফ্রক আর মনিয়ারার একটা শাড়ি। এসব করতে কিছু খরচা হবে অবশ্য তার, কিন্তু ওদের মুখে যে আনন্দটা ফুটে উঠবে, তার কোন দাম হয় না। কিন্তু সেসব কেমন তেতো হয়ে আসে হঠাৎ। সে জামা জুতো ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়, বউয়ের হাজার ডাকেও খেতে ওঠে না, বিকেলে উঠে খেতে দিতে চাইলে বলে ‘আমার তো টিফিন বাক্সেই খাবার আছে’।শুনে খিলখিল হেসে ওঠে মনিয়ারা, বলে ‘সেসব কি আর আছে? মেয়ে খেয়ে নিয়েছে কখন? তোমার ব্যাগ থেকে টিফিন খেলে ওর নাকি মনে হয় ও কলকাতায় মস্ত চাকরি করে’
এই শুনে চোখে জল আসে পটার আর তার ভারি অপরাধ হয় এদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্যে। তখন সব মেঘ কেটে আবার ঝলমল করে ওঠে মন। মনিয়ারা গরম গরম পরোটা আর আলু ছোকা।পরোটা নিয়েও কোন অশান্তি সে করবে না। সোনামুখ করে খেয়ে নেবে। তারপর মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ইস্কুলমাঠের ধারে।মাঠের ধারে একটা খাল আছে, সেই খালে একসময় নৌকো চলত। একবার রাতে নৌকো নিয়ে বেরিয়েছিল অনেকে মিলে। প্রচুর গুলে মাছ ধরা হয়েছিল গামছা দিয়ে। চাঁদনী রাত ছিল সেদিন। জোছনা যেন গন্ধতেলের মতো রাতের শরীরে ছড়িয়ে আছে। এমন অপূর্ব রাত তার জীবনে কি আর এসেছে? আসেনি, আসবেও না।খালের ধারে জলের ওপর একটা নৌকো বাঁধা আছে, জরাজীর্ণ অবস্থা নৌকোটার, জলে ছাড়লেও সে নৌকা চলবে না, চলার সম্ভাবনা নেই। এই নৌকাটাকে চেনে পটা, এটা রামপ্রসাদ কাকার নৌকা, রামপ্রসাদ মণ্ডল। মাছ ধরাই জীবিকা ছিল তার। বাড়িতে বৌ আর মেয়ের ছোট সংসার, বাড়ির উঠনেই সারা বছরের সব্জি ফলাত বৌ, বেশ চলে যেত। হঠাত কী হল রামপ্রসাদ সনকা বউদির ঘরে যেতে শুরু করল।সনকা বউদির বর কানাই গাছ থেকে পড়ে মারা গেছিল কয়েক বছর আগে, সনকা তাড়ি তৈরি করে বিক্রি করে, সন্ধেয় ওখানে ঠেক বসে, গাঁয়ের বুড়ো ছোঁড়া সব জোটে ওখানে, হাড়ভাঙ্গা খাটনির পর মজা মন্দ হয় না, গান হয়, নাচ , তারপর যা যা হতে পারে, সব। সনকার ডবকা শরীর, নিজের ননদকেও সে টেনে নিয়েছে এই কাজে। সেখানে গুড়ে বসা মাছির মতো আটকে গেল রামপ্রসাদ, সব উপার্জন সনকা আর ফুলির পায়েই ঢালতে লাগল। অর্ধেক দিন বাড়িই ফিরত না, বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না এরকম অবস্থা, সেও একরকম সহ্য হয়ে যাচ্ছিল, বৌ কাজ করত অন্য বাড়ি, কিন্তু এদিকে ফুলির যে এক আশিক ছিলই, আলুর গুদামমালিক জলোর ছেলে বিন্দে, তার বয়স, রূপ, টাকা সবই রামপ্রসাদের চেয়ে ঢের বেশি, তক্কে তক্কে ছিল, দিল তার বুকে ছুরি বসিয়ে। টাকার জোরে তার কিছু হল না, সে এখন দিব্যি বিয়ে করে সংসারী, মাঝখান থেকে রামপ্রসাদের সংসার ভেসে গেল, এই নৌকোর মতো হাল তার, তার মেয়েকে দেখলে লোকে এখনো বলে রামপ্রসাদের বেটি না, সেই রামপ্রসাদ যে লোভে পড়ে মরল?
মেয়ে বলে এই নৌকো চলে না বাবা?
পটা হেসে বলে – নৌকা কোথায় চলবে মা? খালে জল কোথায়? খাল মরে গেছে।
মেয়ে অবাক হয়ে বলে মানুষের মতো খাল বিল নদী এরাও মরে যায়, ও বাবা? তাহলে নদীর কাছে শিখছি আমি আপন বেগে চলতে- আমরা চলব কী করে, ও বাবা? আমরা তো দাঁড়িয়ে পড়ব।
মেয়ের এই প্রশ্নের সামনে পটা কোন উত্তর খুঁজে পায় না। সে আস্তে আস্তে নৌকোটার গায়ে হাত বোলায়। তার হাতে কতদিনের ধুলো ময়লা লেগে যায়, সে পাত্তা দ্যায় না। এই নৌকোটা একটা সংসার টেনেছে। এর গলুইয়ে কত আশা, স্বপ্ন, ভাতের গন্ধ, নতুন জামার গন্ধ লেগে আছে। রামপ্রসাদ লোকটা তো খারাপ ছিল না। সনকা বউদিকেও কি খারাপ বলা যায়? সে যা করেছে, তা তো নিজের সংসারকে বাঁচাতে। চালাক লোক হলে দু নৌকোয় পা দিয়েও দিব্যি ব্যালেন্স করে চলত। এমন তো কত লোক আছে তাদের এই গ্রামেই। সাহু কার রেন্টালের ছোড়দা যে রুমকির কাছে শুক্রবার করে যায়, সে তো বাড়ির সবাই জানে। চাপা অশান্তি হয়তো আছে কিন্তু তা নিয়ে তা কোন বড় ক্ষতি ডেকে আনেনি।
মেয়ে আর বাপে আরও কিছুক্ষণ হাঁটবে খালের পাড়ে। ততক্ষণে খালের জলে ঝুঁকে পড়া বাবলা গাছ আর আশশেওড়া গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা একবার উঁকি দিয়েই ডুবে যাবে, লোকে সূর্য ওঠা, সূর্য ডোবা দেখতে হাজিপুর ছোটে, সেখানে মস্ত হুগলী নদীর ধারে কত আউট লোকের ভিড়। কিন্তু খালের জলে ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে পড়া এই শেষ রবির আভা কী অপূর্ব।
একবার এক বিদেশি টুরিস্ট নিয়ে রায়চক এসেছিল পটা। ফরাসি দেশের মানুষ। কী সব গবেষণা করতে এসেছিল কলকাতায়। সাহেব শুনেই সিঁটিয়ে গিয়েছিল পটা। কিন্তু সে দেখল সাহেব খুব ভালই বাংলা জানে। এখনকার ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা, তাদের মতো কথায় কথায়, ইউ নো, লাইক, ওয়াউ, মাউ বলে না। রায়চক থেকে ফেরার সময় সাহেব বায়না করল বাংলার সত্যিকারের গ্রাম দেখবে, গ্রামের লোকের বাড়িতে থাকবে, তাদের খাবার খাবে। এদিকে সাহেবের সেদিন অব্দিই বুকিং, পটার পরদিন থেকে অন্য ডিউটি আছে।
আতান্তরে পড়ে সে ছোড়দাকে ফোন করল তাড়াহুড়ো করে। কারণ সেদিন ছিল শুক্রবার। একটু পরেই ছোড়দা রুমকির ফ্ল্যাটে ঢুকে ফোন বন্ধ করে দেবে।তখন সে একা কী সিদ্ধান্ত নেবে?বড়দা আবার এসব ব্যাপারে থাকে না সে শুধু গাড়ির মেন্টেনেন্স, অফিস এইসব সামলায় সেদিন কলকাতায় ফিরে, শনিবার ভোরে তার মন্দারমনির ট্রিপ।
বিকেল চারটে নাগাদ ধরল পটা ছোড়দাকে। শুক্রবার করে ছোড়দার মুড ভালো থাকে।
দিলদরিয়া ভাবে বলল ‘দেখিয়ে দে দেখিয়ে দে। সব গ্রাম তো ওদিকে। এর আর আবার কী এত ভাবার আছে?’
‘আরে কাল তো আমার মন্দারমণি ট্রিপ’
‘তাতে কি? আকবরকে ফিট করে দিচ্ছি। ও অনেকদিন ডিউটি পায়নি। কালই ঘ্যানঘ্যান করছিল। সাহেব আমাদের অতিথি। নারায়ণ। তাঁর কথা রাখ রে পটা । অনেক পুণ্যি হবে’
আসল কথা তা না, সাহেব অনেক বেশি টাকায় গাড়ি নিয়েছে, সে একমাস গাড়ি আটকে রাখলেও ছোড়দা একপায়ে খাড়া।
পটা সেটা বুঝতে পেরে বলল ‘ কিন্তু কোথায় নিয়ে যাব সেটা তো বলবে। একটা অচেনা জায়গায় সাহেব নিয়ে হাজির হলে কত বিপদ হতে পারে জানো?’
‘আরে বোকা, অচেনা জায়গায় নিয়ে যাবি কেন? চেনা জায়গায় নিয়ে যা।’
চেনা জায়গা! পটার মাথায় কিচ্ছু খেলে না। মাথা যেন হাতুড়ি দিয়ে ঠুকলেও ভাঙবে না, এত শক্ত। কোথায় তার চেনা গ্রাম আছে, একজন সাহেবকে নিয়ে যাবার মতো, কিছুতেই মাথায় আসে না তার।
পটাকে চুপ করে থাকতে দেখে ছোড়দা অস্থির হয়ে ওঠে। ওদিকে রুমকি তার নয়ছল্লা শরীর, তার নখরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে, তার মধ্যে এসব কি উতপটাং আরম্ভ করেছে পটা। নাহ, এই সংসার, ব্যবসা, কোথাও দেখছি তাকে কেউ দুদণ্ড শান্তি দেবে না। বড়দা দেখো মহাদেব হয়ে বসে আছে। ড্রাইভারদের সঙ্গে ডিলিং কে করবে, না ছোটভাই। আর ড্রাইভারগুলো সব এক একটা অবতার। আর এখন দেখো, ড্রাইভারদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র নিরীহ ছেলেটা, তাদের পটা, যে কিনা একটা বিড়িও টানে না, সব মেয়েমানুষকে, পারলে নিজের বউকেই মা বলে পেন্নাম করে, সে কিনা তাকে এত ভোগাচ্ছে। একেই বলে কপাল খারাপ হলে পেঁয়াজের খোসায় পা কাটে। এতক্ষণ সে ফুরফুরে মেজাজে কথা বলছিল। সমস্যা হয়েছে, সে তো আকবরকে ফোনও করে দেবে। ফোন কাটলে তো সে কথা বলবে। শালা এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। একদিন একটু আনন্দ করে সে, দেরি করে গেলে রুমকি এমন খেপবে, যে সারারাত লেগে যাবে মান ভাঙ্গাতে। পুরো মজাই মাটি তখন। সে মেজাজ হারিয়ে বলে ‘আবে গান্ডু, তুই ফোন রাখলে তবে তো আমি আকবরকে ফোন করব’
পটা আমতা আমতা কর বলে ‘আকবর, বাবর যাকে খুশি ফোন করো, সেটা তো সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে আমি সাহেবকে কোথায় নিয়ে যাব?’
‘শালা সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে? তোর বাড়ি রে গান্ডু। এত চেনা গ্রাম আর কোথায় পাবি তুই? যতদূর জানি রায়চক থেকে এক ঘন্টাও নয় তোর নছিম পুর গ্রাম’
ছোড়দা তার গ্রামের নাম মনে রেখেছে! এতে তার আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।কিন্তু পটা চিন্তাক্লিষ্ট গলায় বলল ‘তুমি কি বলছ কী ছোড়দা? আমাদের ভাঙ্গাচোরা ঘর, দুখানা ঘর মোটে। ভালো তোশক চাদর বালিশ কিছুই নেই, কোথায় শুতে দেব সাহেবকে? তাছাড়া কল বাথরুম পরিষ্কার রাখে বটে আমার বৌ, কিন্তু সাহেব সে সব সরতে পারবে? খাওয়ার কথা না হয় বাদ দিলাম। সাহেব খুব দুধ ফল খায়, সে মা ঠিক জোগাড় করে ফেলবে’
‘আরে সাহেব জাতকে তুই চিনিস না, ওরা বই লিখবে বলে এদেশে এসে কী কষ্ট করে পড়ে থাকে। আমাদের ঘরের ছেলেরা, একটুতেই সব বাবু, সাহেবরা কষ্ট করতে পারে বলেই তো গোটা দুনিয়ায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে। সাধে কি ওরা আমাদের দুশো বছর শাসন করে গেছে’
পটার তখন মাথায় রাজ্যের চিন্তা ভেঙে পড়েছে। সে খেয়াল করল ছোড়দা ভুল বলছে। এদেশে দুশো বছর শাসন করেছে তো ইংরেজরা, আর এই লোকটা তো ফরাসি। সে এটুকু পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তার তখন ওসবে মন নেই।
ছোড়দা ততক্ষণে ফোন কেটে আকবরকে ফিট করে ফেলেছে। তারপর আবার ফোন করে বলেছে ‘পটা, ঘাবড়াস না, যাবার পথে একটা নতুন চাদর আর বালিশের ওয়াড় কিনে নিয়ে যাস, বিছানার ওপর পেতে দিলেই হবে। আর বাকিটা তোর মা বৌ ম্যানেজ করে নেবে। আর আমাকে কাল সন্ধের আগে ফোন করবি না। করলেও পাবি না’ বলেই কেটে দিল পটাকে অথই সাগরে ভাসিয়ে। কিন্তু যতটা খারাপ হবে ভেবেছিল পটা, মোটেই তা নয়। উপরন্তু ওই দুটো দিন একেবারে সোনার জলে বাঁধানো। বিশেষ করে তার মেয়ের কাছে। কত চকোলেট, ছবির বই, রঙ পেন্সিল, আঁকার খাতা দিয়ে গেছে ওকে সাহেব। কত গল্প করেছে। সাহেবকে নিয়ে এই খালের ধারেও এসেছিল ওরা। খালের ওদিকে যেখানে ঝোপগুলো আর্চের মতো তৈরি করেছে, সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সাহেব বলেছিল ‘অন্য দেশ হলে এই খাল সারিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলত’
কলকাতা তাকে শেষ করে দিয়েছে। আর তার মতো লোককেও কিনা হাজত বাস করতে হল! সেই এক বছরের কথা বাড়িতে কেউ জানে না। মা বা বৌ জানলে ঠিক আছে তাও। কিন্তু মেয়ে যদি জানে। ওর চোখে তো বাবা হচ্ছে ভগবান। সে যদি জানে তার বাবা জেল খেটেছে, কেন, কী সেসব তো সে বুঝবে না।
না এসব কিছু ঘটেনি এবার। পটা নিজেই দুদিনের জায়গায় চারদিন নিয়ে নিল। সে কলকাতা যাওয়া ঠেকাতে চাইছে।সেই ফোনটা বারবার আসত, সে ধরত না। কিন্তু এবার একটা অন্য নম্বর থেকে ফোন এল, বলছে দেখা করতে শিগগির। প্রচুর টাকা। তাকে খুব পছন্দ হয়েছে ওদের। কাদের? কীসের টাকা? নিজের গাড়ি কেনার মতো?
খুব লোভ হয় পটার। এই ডাকে সাড়া দিতেই পারে সে। এখনো সাহুরা দশ হাজার টাকাও দ্যায় না তাকে। আর কতদিন পড়ে থাকবে এখানে?